শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি জাতি তাঁর সভ্যতা সংস্কৃতি কাল ক্রমে চর্চা, গবেষণা, সভ্যতার বিকাশ ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টির কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখে। আর শিক্ষা কার্যক্রম ও প্রণীত শিক্ষা নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্র তাঁর নিজ সংস্কৃতি, আদর্শ, চিন্তা গুলোকে জনগণের মাঝে প্রোথিত করে এবং একটি আদর্শনির্ভর জাতি গঠনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব দরবারে নিজের শক্তিমত্তার জানান দেয় ও বৈশ্বিক নীতি নির্ধারণে নিজের আধিপত্যকে বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশ এমনি একটি দেশ। যা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক নীতি ও গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামো দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র। আর পুঁজিবাদি অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যই হল- পুঁজির স্বাধীনতা। যা মালিকানার স্বাধীনতার নামে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সকল বিষয়ে অর্থাৎ খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি সহ সকল বিষয়ে ব্যবসা করার অধিকার দেয়। ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রের জনগণের মৌলিক প্রয়োজন/অধিকার থেকে শুরু করে সকল প্রয়োজন ও চাহিদা ব্যবসায়ী পণ্যে রূপান্তরিত হয়। আর জনজীবনে নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের কুফর পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক সরকার!! এর প্রণীত বিলাসী বাজেটে সরকার তার আয় ও ব্যয় এর সামঞ্জস্য বিধানের জন্য নানা ভাবে নানা সেবা ও পণ্যের উপর ভ্যাট আরোপ করে। যার মধ্যে অন্যতম- একটি খাত শিক্ষা। যার উপর প্রথমে ১০% এবং পরবর্তীতে চাপের মুখে ৭.৫% ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্তে সরকার অটল থাকে। যা ৬০% তারুণ্য নির্ভর বাংলাদেশের শিক্ষার উপর চরম চাপ সৃষ্টি করে। আলোচনায় উঠে আসে- শিক্ষার উপর ভ্যাট ও পাবলিক ও প্রাইভেট শিক্ষা।
যদিও আপাত দৃষ্টিতে আন্দোলনের মুখে সাম্প্রতিক ভ্যাট বাতিল করা হয়েছে, তবে পুঁজিবাদি ব্যবস্থা এখনো বাতিল হয়নি, যার নিজের ভেতরেই এসব অন্যায় অর্থনৈতিক বোঝা চাপিয়ে দেবার বীজ নিহিত। বিগত সময়ের দিকে আলোকপাত করলে আমরা দেখতে পাব- বাংলাদেশের পাবলিক শিক্ষাকে বেসরকারিকরণের এক কৌশলী নীতি নিয়ে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নীতি নির্ধারণ করেছিল এবং তাদের এ ষড়যন্ত্র আজও চলমান। বিশ্বব্যাংক এর পরামর্শ অনুসারে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতকে বেসরকারিকরণ এবং বাজেটে শিক্ষা খাতে ক্রমান্বয়ে বরাদ্ধ কমিয়ে আনা ও না দেয়া ও প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে শিক্ষার ব্যয় ভার বহনের নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সান্ধ্যকালীন শিক্ষা কর্মসূচি পরিচালনার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মোড়ল, সরকার ও তাদের আজ্ঞাবাহকরা এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য মরিয়া। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্য, শিক্ষা কর্মসূচি নিয়ে নানা প্রতিবেদন, বেসরকারি শিক্ষা উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রদান করে বাংলাদেশে সরকারের অনুগত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। একদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সেশন জট, কর্মমুখী-কারিগরি শিক্ষা অপ্রতুলতা ও সীমিত আসন; অন্য দিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়বহুল শিক্ষা – উভয়ই রাষ্ট্রের জনগণ ও বিশাল তারুণ্যের জন্য বিষফোড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাঁর উপর সময়ে সময়ে বিভিন্ন ছুটোয় যোগ হচ্ছে টিউশন ফি এর উপর ভ্যাট।
আমরা দেখতে পাব- বিগত সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন বৃদ্ধি ও সান্ধ্যকালিন কোর্স চালু করার প্রতিবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। আজ একই ভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি এর উপর ভ্যাট আরোপে সচেতন মহলে ও রাজপথে আন্দোলন শুরু হয়। আর অন্য দিকে অতীতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন দমনে সরকার পুলিশ বাহিনী দিয়ে মামলা হামলার যে নীতির মাধ্যমে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করেছে আজ ও একই পদ্ধতি ও কৌশল এর মাধ্যমে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করেছে। যদিও আন্দোলন দাবানলের মতো আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে নাকি – এই ভয়ে পরবর্তীতে সরকার (আপাতত) ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এসকল কিছুর মধ্য দিয়ে এটাই প্রমানিত হয় – শিক্ষা নামক অধিকার এর নিশ্চয়তা দিতে সরকার ব্যর্থ, কিন্তু সে শিক্ষাকে সমাজের অসংখ্য মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানদের নিকট বিক্রি করে জাতীয় আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে সে একধাপ অগ্রসর।
এ ব্যর্থতা শুধু সরকার বা রাষ্ট্রের নয় বরং এ ব্যর্থতা পুঁজিবাদি অর্থনীতির। পুঁজিবাদী অর্থনীতি তাঁর পুঁজির অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা নীতির ফলে এবং আয়ের উৎস হিসেবে জনগণের চাহিদা ও প্রয়োজনকে পণ্য বানিয়ে এর উপর ভ্যাট আরোপ করে রাষ্ট্রের আয় বাড়ানোর নীতির ফলে আজ জনজীবন চরম দুর্ভোগ এর মুখোমুখি।
পুঁজিবাদ ও এর রাষ্ট্রীয় কাঠামো তথা সরকার যেখানে মানুষকে তাঁর প্রয়োজনীয় অধিকার ও চাহিদা বিনামুল্যে না দিয়ে বরং পণ্য বানিয়ে জনগণের কাছে বিক্রি করে আর নিজের দেউলিয়াপনা কে উন্মোচিত করে। সেখানে ইসলাম তাঁর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও কাঠামোর মাধ্যমে মানুষের শিক্ষা নিশ্চিত করে ও এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করে।
খিলাফত রাষ্ট্র কখনই শিক্ষার উপর কোন ধরণের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ তো দূরের কথা, কোন ধরণের টিউশন ফি ধার্য করবে না অর্থাৎ শিক্ষা হবে অধিকার।
খিলাফত রাষ্ট্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তিকে জীবন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় শিক্ষাদান রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। অন্তত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে এটি সবার জন্য বিনামূল্যে প্রদান করতে হবে। রাষ্ট্রের সর্বাত্মক চেষ্টা করা উচিত যাতে করে সবাই বিনামূল্যে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ অব্যাহত রাখতে পারে।
খিলাফত রাষ্ট্র বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে, রাষ্ট্রের যথেষ্ট পরিমাণ পাঠাগার এবং পরীক্ষাগার সহ জ্ঞান বৃদ্ধির সুবিধা প্রদান করবে যাতে করে যারা ফিকহ, হাদীস, তাফসীর, চিকিৎসা, প্রকৌশল, রসায়নবিদ্যা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা অব্যাহত রাখতে পারে। এর লক্ষ্য হবে রাষ্ট্রের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে মুজতাহিদ, সৃজনশীল বিজ্ঞানী ও আবিস্কারক তৈরী করা।
উপরোক্ত পর্যালোচনা থেকে এটা পরিস্কার- আমাদের সরকার সমূহ ও পুঁজিবাদি আদর্শের ব্যর্থতা কোথায়। তাই বাংলাদেশের তারুণ্য নির্ভর শিক্ষার্থীদের বুঝা উচিৎ- ভ্যাট প্রত্যাহার কিংবা ভ্যাট কমানো, প্রত্যাহার করা কিংবা ভ্যাট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপর ধার্য করার মধ্য দিয়ে পরোক্ষ ভাবে শিক্ষার্থীদের উপর আরোপের ষড়যন্ত্র কখনোই সমাধান হতে পারে না। বরং ইসলামি রাষ্ট্র তথা খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও খিলাফতের শিক্ষা নীতি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই প্রকৃত সমাধান।
আল্লাহ্র রাসূল (সা) বলেছেন-
“যে জ্ঞান অর্জনের কোনো পথে অগ্রসর হয়, আল্লাহ্ এর মাধ্যমে তাঁর জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন”।
মাহবুবুল আলম