বিদেশী মিউচ্যুয়াল ফান্ড আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে…… আসলেই?

“Foreign mutual funds……will be to bring in increasing foreign investments, which will then be available as a source of capital, investment in telecom, digitization, and the IT sector and in general (fields) as well.” — Oh really?

উপরের কথাগুলো বলেছেন সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয় [May 7, 2015 in Digital Investment Summit, Dhaka]। তিনি বিদেশী মিউচুয়াল ফান্ডকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে সরাসরি অপারেট করতে দেয়ার নীতি গ্রহন করতে যাচ্ছেন। তার এই নীতির সপক্ষে উপরের যুক্তি তুলে ধরেন। অর্থাৎ তিনি বলেন যে এই মুক্তনীতি আমাদের টেলিকম, ডিজিটাইজেশন, আইটি, এবং সাধারণ খাতে বিনিয়োগের পুঁজি যোগান দিবে। তাই কি? তবে বাস্তবতা একটু বিশ্লেষণ করা যাক।

আমাদের মত অনুন্নত অর্থনীতিকে বলা হয় প্রান্তিক বাজার (Frontier Market), আর এই প্রান্তিক বাজার হচ্ছে বৃহত্তর উদীয়মান বাজারের (Emerging Market) অন্তরভুক্ত। এই বাজারগুলোতে সাধারণত উচ্চ ঝুঁকি গ্রহণকারী Hedge Fund এবং Emerging Market Fund গুলোই বিনিয়োগ করে থাকে। অর্থাৎ তাদের বিনিয়োগের উদ্দেশ্যই হয় অগভীর বাজারগুলো থেকে স্বল্প সময়ে অভাবনীয় লাভ অর্জন করা। ফান্ডগুলো তাই Frontier Market-এ কোন দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে যায়না। সর্বোপরি বাজার অগভীর এবং অপক্ক হওয়ায় তারা বাজারকে সহজেই প্রভাবিত করতে পারে। বৃহৎ পুঁজির সক্ষমতার কারণে তারা নানা ম্যানুপুলেটিভ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। বৃহৎ দেশীয় ব্রোকারেজ হাউজ, সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি এবং মার্চেন্ট ব্যাংক এই বিদেশী ফান্ডের নানাধরনের সুবিধা লাভ করে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই তারা এই বিদেশী ফান্ডের স্বার্থ রক্ষার জন্য সবসময় সচেষ্ট থাকে। প্রয়োজনে তারা গুজব ছড়িয়ে বাজারকে প্রভাবিত করতেও কুণ্ঠিত হয়না।

আমাদের পুঁজিবাজার কত ক্ষুদ্র এবং অগভীর তা বোঝার জন্য কিছু পরিসংখ্যান দেখা যাক। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামগ্রিক পুঁজির বাজারমূল্য (Market Capitalization) হচ্ছে প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলার। এই অংক আমেরিকার যেকোনো একটি কোম্পানির চেয়ে বহুলাংশে কম। যেমন Du Pont এর Market Capitalization হচ্ছে ৬৪৭ বিলিয়ন ডলার, Apple এর ৬৭৩ বিলিয়ন, Wal-Mart এর ২৭৪ বিলিয়ন, Chevron এর ২২০ বিলিয়ন, Facebook এর ২০৪ বিলিয়ন, এবং Coca Cola এর ১৯৪ বিলিয়ন। অর্থাৎ আমাদের সব কোম্পানির পুঁজি মিলে ওদের যেকোনো একটি কোম্পানির চেয়েও হাস্যকর পর্যায়ের ছোট। আর নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের তুলনায় আমাদের বাজারের মূল্যপরিধি হচ্ছে ০.০০০০০০০০০২৮%!

আবার একটি Hedge Fund এর পরিমাণও আমাদের বাজারের প্রায় সমান। যেমন, Bridgewater Pure Alpha এর পরিমাণ হচ্ছে ৩৬ বিলিয়ন ডলার এবং Quantum Endowment Fund এর পরিমাণ ৩১ বিলিয়ন ডলার। আমাদের Frontier Market-এ এই ফান্ডগুলোর বিনিয়োগ তাদের মোট পোর্টফলিওর অনুপাতে দশমিকের ঘরে। তাই তাদের এই বিনিয়োগ যদি পুরোটা নষ্টও হয় তবুও তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের এই বৃহৎ পুঁজির সক্ষমতা এবং স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগ (Tactical Investment) প্রকৃতির কারণে তারা প্রতিনিয়ত পুঁজি উত্তোলন করে তাদের বেইস কান্ট্রিতে নিয়ে যায়। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের উপর কোন lock-in নাই। অর্থাৎ তারা যেকোনো সময় পুঁজি ফেরত নিতে পারে। শুধুমাত্র Pre-IPO বিনিয়োগের উপর ৬ মাসের Lock-in Period আছে। ফেরত নেবার সময় ডলারের আউট-ফ্লো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইন-ফ্লোর চেয়ে বেশী হয়। কারণ চাঙ্গার সময় শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধির হার টাকার দর পতনের চেয়ে বেশী হয়। বিনিয়োগ উত্তলনের সময় বাজার মন্দা থাকলে তারা বাজারে আরও বিনিয়োগ করছে এমন গুজব তাদের স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে ছড়িয়ে বাজারকে চাঙ্গা করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের বাজার গবেষণা-পত্রের মাধ্যমেও তারা বাজারের কনফিডেন্স ধরে রাখে। অথবা কিছু প্রকৃত বিনিয়োগ করে বাজারকে চাঙ্গা করে পূর্ববর্তী বিনিয়োগকে লাভজনাক ভাবে তুলে নেয়। এই সবই সম্ভব হয় তাদের পুঁজির সক্ষমতার কারণে। সুতরাং, বিদেশী ফান্ড আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পুঁজি সরাবরহ করবে এমন যুক্তি গ্রহন করা যাচ্ছেনা। বরং আমাদের ডলার রিজার্ভের নেট পজিশন হ্রাস পাবার সম্ভাবনাই বেশী। কারণ স্বল্প সময়ের ভিতর কোন প্রকৃত বিনিয়োগ আয় সৃষ্টি করেনা, বিশেষ করে টেলিকম এবং আইটির মত বৃহৎ বিনিয়োগের জন্য তা আরও সত্য। সর্বোপরি টেলিকম কোন বিদেশী মুদ্রা অর্জনকারী খাত নয়।

বিদেশী ফান্ডগুলো অনেক ক্ষেত্রে সরকারি নীতিকে তাদের অনুকুলে নেবার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের বাজার সমৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের অধীনে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ তাদের জন্য সুবিধাজনক নীতি বাস্তবায়ন করে থাকে। বিদেশী ফান্ডের সরাসরি বিনিয়োগের এই সুযোগ সৃষ্টির বর্তমান উদ্যোগ তারই একটা উদাহরণ। অধিকন্তু, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতার বক্তব্যের মাধ্যমেও বাজারে কনফিডেন্স সৃষ্টি করা হয়। যেমন জনাব জয়ের এই বক্তব্যের পরে বাজারে চাঙ্গা ভাব দেখা যায়। সরকারকে ম্যনুপুলেট করার এই সুবিধা দেশীয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নেই।

বিদেশী ফান্ডগুলো নিজেদের ভিতর যোগাযোগের মাধ্যমে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে। যেকারনে তারা সহজেই বাজারকে প্রভাবিত করতে পারে। যেহেতু তারা বিদেশে অবস্থান করে, তাদের এই সিন্ডিকেটের খবর প্রচারিত হয়না। এবং এই ধরনের সিন্ডিকেট বাংলাদেশের আইনি সীমার বাইরে হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোন রকম ব্যবস্থাও নেয়া যায়না। যেমন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ১৯৯৬ সনের শেয়ার কেলেঙ্কারির মূল হোতা হওয়া সত্যেও তাদের বিরুদ্ধে কোন আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায়নি।

বিদেশী ফান্ডের বিনিয়োগগুলো আলটিমেটলি দেশী সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরই কিনতে হয়। বলাই বাহুল্য যে তা অধিক মূল্যে। বিদেশী ফান্ড শুধু কিছু সময়ের জন্য বাজারে ঢুকে বাজারকে চাঙ্গা করার মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট বা লোভাতুর করে তোলে। তাদের লোভ যখন তুঙ্গে তখন বিদেশী ফান্ডগুলো চতুরতার সাথে তাদের বিনিয়োগ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আলতো ভাবে গছিয়ে দিয়ে যায়। সাধারণ বিনিয়োগকারীগন কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের হাতে জড় হয় কিছু মূল্যহীন কাগজ। দর পতনের মাধ্যমে তাদের নিঃস্ব হবার প্রক্রিয়াটি শেষ হয়।

তাবেদার সরকার তখন খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে আবার তাদের বিদেশী প্রভুর স্বার্থে নতুন করে কনফিডেন্স গেম খেলতে শুরু করে। ১৯৯৬ থেকে শুরু করে বেশ কয়েকবার আমরা এই একই চিত্র প্রত্যক্ষ করেছি।

পুঁজিবাজারে পোর্টফলিও বিনিয়োগ সার্বিক অর্থনীতিতে কোন কল্যাণ বয়ে আনেনা। বরং তা প্রকৃত বিনিয়োগের স্পৃহা বিনষ্ট করে এবং অর্থনীতিকে বৈষম্যমূলক ও অস্থিতিশীল করে তোলে। জনাব জয়ের বক্তব্য তাই কোনভাবেই গ্রহন করা গেলনা।

ইসলাম শুধু এই বিদেশী ফান্ডের বিনিয়োগ নয় বরং সামগ্রিক ভারচ্যুয়াল অর্থনীতির অবসান ঘটাবে। মানুষের অর্থনৈতিক চাহিদাগুলো পূরণের জন্য একটি শক্তিশালী ও বণ্টনমূলক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করবে। সমস্ত উম্মাহ সেই দিনের অপেক্ষায় আছে।

-মাহমুদ সাদিক

Leave a Reply