মার্কিনীদের উদার গণতন্ত্র মেকি এবং বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র একটি একক কর্তৃত্বসম্পন্ন রাষ্ট্র

“এটা চিন্তার বাইরে এবং দুঃখের বিষয় যে, সরকার ও জনগণের মধ্যে পরস্পরবিরোধী সম্পর্ক বিদ্যমান; যেখানে অনাস্থা ও ভয় বিরাজমান এবং সরকারী নীতি ও কর্মপদ্ধতি জাতির সাংবিধানিক ভিত্তিকে ভেঙে দিচ্ছে। এবং এই একক কর্তৃত্বের ক্রমবর্ধমান কালো অধ্যায় যদি বর্জন করা না হয়, আমেরিকা বসবাসের জন্য জীবন্ত নরকে পরিণত হবে” – মাইকেল পেইন

ইদানিংকালে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ও বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচরবৃত্তির নতুন নতুন তথ্য বিশ্বব্যাপী শীর্ষ খবরে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) নিজ দেশের লাখ লাখ নাগরিকের ওপর মেটা তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে গুপ্তচরবৃত্তি করছে এবং গুগলের মতো প্রধান প্রধান মার্কিন কোম্পানীগুলোর ওপর নজরদারি করছে। এনএসএ’র এহেন কর্মকান্ডের বিরুদ্ধাচরণ করে গুগলের সিইও এরিক স্মিথ বলেন, “এটি সত্যি হতাশাব্যঞ্জক যে, এনএসএ গুগলের তথ্য কেন্দ্রগুলোতে গুপ্তচরবৃত্তি চালাচ্ছে… যথাযথ কোন বিচার বিবেচনা ছাড়াই সংস্থাটি যেভাবে কাজ করছে, তাতে নিশ্চিতভাবেই জনগণের গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছেনা; এটা ঠিক নয়।”

যাই হোক, স্মিথের এ মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানীগুলোকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেয় না। উল্টো প্রিজম নামক একটি জঘন্য প্রোগ্রামের অস্তিত্বই স্মিথের বক্তব্যকে হেয় প্রতিপন্ন করে। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে গুগল, ইয়াহু ও মাইক্রোসফ্টের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানির সহযোগিতায় ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেই সাথে ফরেন ইন্টেলিজেন্স সার্ভেলেন্স অ্যাক্ট (এফআইএসএ) এর ৭০২ ধারা অনুযায়ী, এনএসএ’র যাবতীয় বিশ্লেষণমূলক তথ্য বিবরণীর একানব্বই শতাংশের ক্ষেত্রে প্রিজমই প্রথম নির্ভরযোগ্য উৎস। সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানীগুলোই ডিজিটাল কায়দায় গুপ্তচরবৃত্তির ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

দেশে বিদেশে এনএসএ’র গুপ্তচরবৃত্তির মাত্রা ও ব্যাপকতা সত্যিই অবিশ্বাস্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ২০১২ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ২০১৩ সালের ৮ জানুয়ারী পর্যন্ত এনএসএ ফ্রান্সের ৭.০৩ কোটি ফোন কলে আড়ি পেতেছে। স্পেনে এনএসএ মাত্র ১ মাসে ৬ কোটি ফোন কল গোপনে অনুসরণ করেছে। সংস্থাটি অন্তত ৩৫ জন আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের পেছনে গুপ্তচরবৃত্তি করেছে। এর মধ্যে এঙ্গেলা মার্কেলও রয়েছেন যার ফোন অন্তত ১০ বছর যাবত আড়ি পাতা হচ্ছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রসেফ প্রতিবাদস্বরূপ তার যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল করেন। মার্কেলের পক্ষে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “কাছের বন্ধু ও অংশীদারদের মধ্যে… নেতৃপর্যায়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোন পর্যবেক্ষণ থাকা উচিত নয়।” মিসেস মার্কেল ওবামাকে বলেছেন, “এ ধরনের চর্চা অতি সত্বর বন্ধ হওয়া উচিত।”

যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুদের কথা বাদ দিলেও খোদ নিজ দেশের নাগরিক ও বহিঃর্বিশ্বের মিত্ররাও আশ্চর্যান্বিত এই ভেবে যে, কি অপরাধের কারণে তাদের গোপনীয়তা ক্ষুন্ন করা হচ্ছে। এহেন অপকর্মের ফলে সৃষ্ট ক্ষোভ প্রশমনে এনএসএ’র সমর্থনে ওবামা প্রশাসন সন্ত্রাসবাদ দমন থেকে শুরু করে সকল রাষ্ট্রই গুপ্তচরবৃত্তি করে, যুক্তরাষ্ট্র এর ব্যতিক্রম নয় ইত্যাদি খোঁড়া যুক্তি প্রদর্শন করে। এনএসএ’র পরিচালক জেনারেল কিথ আলেকজান্ডার দাবি করে যে, এনএসএ’র নিবিড় পর্যবেক্ষণে ৫৪টি সন্ত্রাসবাদী অপরাধ সংঘটনের পূর্বেই দমন সম্ভব হয়েছে কিন্তু প্রচার মাধ্যমগুলোর প্রবল প্রতিবাদের মুখে এনএসএ’র সহকারী পরিচালক স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, এনএসএ’র নিবিড় পর্যবেক্ষণে মাত্র ১টি সন্ত্রাসবাদী অপরাধ দমন সম্ভব হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচরবৃত্তির এই প্রকল্পের তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এনএসএ’কে সহায়তা ও সমর্থন দানের ঘটনায় মাইক্রোসফ্ট, গুগল, ভেরিজোন, এটিএন্ডটি’র মতো যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল প্রযুক্তি কোম্পানীগুলো হাতেনাতে ধরা পড়ার পর এগুলো এখন বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অন্যদিকে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনে (ব্রিক দেশসমূহ) নতুন ইন্টারনেট তৈরির পরিকল্পনা জোরদার করেছে।

তাই পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সংকট মিত্র ও অন্যান্য দেশগুলোর সাথে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি কাটিয়ে উঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারক ও বাহক যুক্তরাষ্ট্র গভীরতর হুমকির মুখে পড়েছে; কারণ তার আচরণ তার প্রচারিত ও সমর্থিত মূল্যবোধের পরিপন্থি। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কিছুসংখ্যক সম্মানিত ব্যক্তিত্ব এর বিরুদ্ধে কথা বলেছে। উদাহরণস্বরূপ ওয়াশিংটনের বিশ্বব্যাপী গোপন গুপ্তচরবৃত্তির ব্যবস্থা এডওয়ার্ড স্লোডেন কর্তৃক ফাঁস করা নিয়ে জিমি কার্টারকে যখন প্রশ্ন করা হয়, তখন তার উত্তর ছিল, “যুক্তরাষ্ট্রে এখন কার্যকর গণতন্ত্রের চর্চা নেই।”

ইসলাম তার রাষ্ট্রের নাগরিকের ওপর গুপ্তচরবৃত্তির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দিয়েছে:

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

এবং একে অপরের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করো না।”
[সূরা আল হুজুরাত: ১২]

এই আয়াত সম্পর্কিত একটি ঘটনা আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা.) বর্ণনা করেন, “তিনি উমর বিন আল খাত্তাবের (রা.) সাথে রাতে বিচরণ করতেন। একদিন তারা দূরে এক বাড়িতে আলো দেখতে পেলেন এবং সামনে অগ্রসর হলেন। তারা ভেতরে উচ্চ শব্দ শুনতে পেলেন। ওমর (রা.) আব্দুর রহমান (রা.) এর হাত ধরে বললেন, ‘এটা কার বাড়ি তুমি কী জান?’ তিনি বললেন, ‘না’। উমর বললেন, ‘এটা রাবিয়া ইবনে উমাইয়া ইবনে খালাফ এর বাড়ি এবং তারা ভেতরে এখন মদ পান করছে মনে হয়! তোমার কাছে কি মনে হয়?’ তিনি বললেন, ‘আসলে আল্লাহ্ যা নিষেধ করেছেন আমরা তা করছি। আল্লাহ্ মহাপরাক্রমশালী বলেন,

গুপ্তচরবৃত্তি করো না।” [সূরা হুজুরাত: ১২] এবং আমরা তা করছি।” অতঃপর উমর (রা.) ওখান থেকে চলে আসলেন।

আসন্ন খিলাফত রাষ্ট্র শাসনকার্য পরিচালনার নতুন মান নির্ধারণ করবে যাতে করে জনগণ শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে বসবাস করতে পারে। জনগণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গোয়েন্দাগিরির ভয়ে ভীত থাকবে না এবং পশ্চিমাদের মতো ব্যাপক নজরদারির সম্মুখীনও হবে না।

Leave a Reply