নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘নিযামুল ইজতেমাঈ ফিল ইসলাম ’ বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে গৃহীত
যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা জাহিলিয়্যাতের গোত্রীয়বাদ হারাম করেছেন তখন তিনি গোত্রীয়বাদকে উম্মাহর সন্তানদের একমাত্র বন্ধনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করাকে হারাম করেছেন, এবং হারাম করেছেন যাতে এটি মুসলিমদের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রন না করে। তবে, তিনি মানুষকে তার আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে ও সদয় হতে নির্দেশ দিয়েছেন। হাকিম ও ইবন হিব্বানে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা) বললেন, “দাতার হাত উপরে থাকে (অর্থাৎ, তা উত্তম), অতএব, নিকটাত্বীয়দের দিয়ে (দান) শুরু করো। তোমার মা, বাবা, বোন ও ভাই এবং তোমার নিকটাবর্তী ও তোমার নিকটাবর্তী (এর প্রতি)। আসমা বিনতে আবি বকর বলেন, আমার মা যিনি একজন মুশরিক ছিলেন, তিনি মুসলিমদের সাথে কুরাইশদের চুক্তিকালীন সময়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। আমি নবী (সা) হতে উপদেশ নিতে যাই এই বলে যে, “আমার মা আমার সাথে দেখা করতে এসেছে (কিছু অনুগ্রহের জন্য)” নবী (সা) বলেন, “হ্যাঁ, তোমার মায়ের প্রতি ভালো আচরন করো।” (মুত্তাফাকুন আলাইহি)
ইসলাম সম্পর্কসমূহকে দুভাগে ভাগ করেছে। প্রথমত, সেসব সম্পর্ক যাদের মৃত্যুর পর তাদের হতে উত্তরাধিকার প্রাপ্তি সম্ভব। দ্বিতীয়ত, মায়ের দিকের আত্মীয়-স্বজন (উলুল আরহাম)। এদের মধ্যে যাদের উত্তরাধিকার রয়েছে তারা হলো যারা আইনত নির্দিষ্ট অংশের উত্তরাধিকারী (আসহাবুল ফুরূদ) ও যারা পিতার দিক থেকে আত্মীয় (আসাবাত)। মাতার দিকের সম্পর্কসমূহ পুর্ববর্তী সর্ম্পকসমূহ হতে ভিন্ন; তাদের উত্তরাধিকারের কোনো অংশ থাকে না, তারা পৈত্রিক সম্পর্ক থেকেও নয়। তাদের ১০টি ভাগে ভাগ করা যায়: মামা, খালা, নানা, নাতি (কণ্যা হতে), ভাগ্নে, ভাতিজী, চাচাতো বোন, ফুফাতো বোন, সৎ চাচা, ভাতিজা (সৎ ভাই হতে) এবং যারা তাদের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করে।
আল্লাহ সুবহানাহ ওয়া তা’আলা ব্যক্তির (মৃত) উত্তরাধিকার থেকে উপরোক্ত ব্যক্তিদের অংশ দেননি, তাদের ভরনপোষনও উক্ত ব্যক্তির জন্য আবশ্যক নয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আত্মীয়দের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে ও সদয় হবার ব্যাপারে হুকুম দিয়েছেন। জাবির (রা) হতে বর্ণিত: রাসূল (সা) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যদি কেউ দরিদ্র হয় তার নিজের জন্য খরচ শুরু করা উচিত এবং তোমাদের মধ্যে যার (সম্পদের) উদ্বৃত্ত রয়েছে, সে যেন তার পরিবারের জন্য খরচ করে এবং তোমাদের মধ্যে যার আরো অধিক উদ্বৃত্ত থাকে সে যেন তার আত্মীয়দের জন্য খরচ করে।” আবু আইয়্যুব থেকে বর্ণিত: এক ব্যক্তি নবী (সা) কে বললেন, “আমাকে এমন একটি কাজের কথা বলুন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।” লোকেরা বলল, “তার কী হয়েছে? তার কী হয়েছে?” নবী (সা) বললেন, “তার কিছু (জিজ্ঞেস করবার) আকাঙ্ক্ষা আছে” নবী (সা) বললেন, “(জান্নাতে প্রবেশের জন্য) তোমাকে অবশ্যই আল্লাহর ইবাদত করতে হবে, এবং তাঁর সাথে কোনো শরীক করবে না, যথাযথভাবে সালাত আদায় করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আত্মীয়-স্বজন (রাহিম)-এর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে।” [বুখারী] সুতরাং, তিনি (সা) সুসম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে যে, এই হাদীসসমূহে কাদের সম্পর্কের ব্যাপারে বুঝানো হয়েছে? তারা কি শুধুমাত্র মাতৃসম্পর্কীয় (উলুল আরহাম) নাকি প্রত্যেকেই যারা ব্যক্তির রাহম (মাতৃগর্ভ) এর সাথে সম্পর্কযুক্ত! এই হাদীসসমূহ নির্দেশনা দেয় প্রত্যেক আত্মীয়ের সাথে উত্তম সম্পর্কের প্রতি, তা হতে পারে মাহরাম অথবা পিতৃসম্পর্ক কিংবা মাতৃসম্পর্কের দিক হতে কোনো গায়ের মাহরাম।
আত্মীয় (রাহম)-এর সাথে সুসর্ম্পকের ব্যাপারে অনেকগুলো হাদীস বিদ্যমান। তিনি (সা) বলেন, “সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে।” আনাস বিন মালিক থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, “যে তার রিযকের প্রশস্ততা এবং প্রাপ্ত জীবনকাল দীর্ঘায়িত হোক, তবে সে যেন তার আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখে। [মুত্তাফাকুন আলাইহি] আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত নবী (সা) বলেন, “আল্লাহ যখন তাঁর সৃষ্টি কার্যক্রম শেষ করলেন, তখন গর্ভাশয় বলে উঠলো: সম্পর্ক ছিন্নকারী থেকে আমি আপনার কাছে আশ্রয় গ্রহণ করছি। আল্লাহ বলেন: তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে তোমার সাথে যে সম্পর্ক অটুট রাখবে, আমি তার উপর আমার অনুগ্রহ করবো, আর তার থেকে অনুগ্রহ তুলে নেই যে তোমার সম্পর্ক কর্তন করে?” এতে সে বলল, “হ্যাঁ, হে আমার রব!” এরপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন, “এটাই তোমার জন্য”। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন: যদি তোমরা চাও তবে পড়তে পারো: “আর হতে পারে যদি তোমাদের পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দেই, তবে তোমরা পৃথিবীতে ফাসাদ ছড়িয়ে বেড়াবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে।” [সূরা মুহাম্মাদ: ২২] তিনি (সা) বললেন: আল-ওয়াসিল (যে আত্মীয়ের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে) সে নয় যে তার আত্মীয়ের কাছ থেকে পাওয়া ভালো কাজের প্রতিদান দেয়, বরং আল-ওয়াসিল হচ্ছে সেই যে তার সেইসব আত্মীয়ের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে, যারা তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে।” এই সবই আত্মীয় স্বজনের সুসম্পর্কের ব্যাপারে উৎসাহ দেয়।
সিলাত আর-রাহিম ইসলামী সম্প্রদায়ের মাঝে ভালো এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা, আত্মীয়-স্বজনের মাঝে ভালো ও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা, নারী-পুরুষের মেলামেশার ব্যাপারে শর’ঈ সীমা কতটুকু এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই মেলামেশার কতটুকু ফল বয়ে আনে এবং এখান থেকে বিস্তৃত শাখা-প্রশাখার ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা যা নাযিল করেছেন, তার গুরুত্ব নির্দেশ করে। অতএব, ইসলামী শরীআহ সমাজের সামাজিক দিক নিয়ে যে আইনগুলো প্রণয়ন করেছে, তা মানবজাতির জন্য সবচেয়ে উত্তম সমাজব্যবস্থা সরবরাহ করে।
Posted by Torch Bearer