আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ইসলামকে প্রেরণ করেছেন চুড়ান্ত বাণী রূপে যা বিচার দিবস অবধি অব্যাহত থাকবে। এমনকি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এই বাণীকে পরিপূর্ণ রূপে ও সকল বিষয়ের ব্যখ্যাসরূপ বর্ণনা করেছেন,
ما كانَ حَديثًا يُفتَرىٰ وَلٰكِن تَصديقَ الَّذى بَينَ يَدَيهِ وَتَفصيلَ كُلِّ شَيءٍ وَهُدًى وَرَحمَةً لِقَومٍ يُؤمِنونَ
এটি (তথা কুরআন) কোনো মনগড়া কথা নয়, বরং পূর্ববর্তী (ওহীর) সত্যায়ন, প্রত্যেক বিষয়ের বিশদ বিবরণ এবং ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্য রহমত ও হেদায়েত [সূরা ইউসূফ: ১১১]
وَنَزَّلنا عَلَيكَ الكِتٰبَ تِبيٰنًا لِكُلِّ شَيءٍ
আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাযিল করেছি যেটি এমন যে তা প্রত্যেক বিষয়ের সুস্পষ্ট বর্ণনা.. [সূরা আন-নাহল: ৮৯]
তথাপি দেখা যায় যে, কুরআন ও সুন্নাহ আকারের দিক থেকে সীমিত অথচ মানুষ যে সকল সমস্যা ও বিষয়ের সম্মুখীন হয় তার পরিসর অসীম অনুভূত হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন চলে আসে যে, কিভাবে এই সীমিত পরিসরের টেক্সট নাযিলের সময় থেকে শুরু করে বিচার দিবস পর্যন্ত মানুষের সকল সমস্যার সমাধান ধারণ করতে পারে?
এর উত্তর পেতে হলে আমাদের অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহর বর্ণনাভঙ্গি বুঝতে হবে।
১) প্রথমতঃ চার্চের দৃষ্টিতে বাইবেল (যা পবিত্র টেক্সট, আইনী টেক্সট) যা গন্ডিবদ্ধ ও যার পরিসর সীমিত, ইসলামী টেক্সট তদরূপ নয়। ইসলামী টেক্সট হচ্ছে একটি সামগ্রিক আইনি বিধান, যা সাহায্য করে টেক্সট থেকে হুকুম বের করে আনতে যদিও তা বাহ্যিকভাবে উল্লেখিত থাকে না। আর এই পদ্ধতি উসূল আল-ফিকহ নামে পরিচিত।
২) দ্বিতীয়তঃ ইসলামী টেক্সট প্রবৃত্তি ও বহুবিধ প্রয়োজনীয়তা সম্বলিত মানুষকে সম্মোধন করেছে, আর দিয়েছে সমাধান কেননা মানুষের প্রকৃতি কখনো পরিবর্তিত হয় না। তাই এটি টেক্সটে উল্লেখিত মূল হুকুমকে সম্প্রসারিত করে উদ্ভূত নতুন বিষয়ের জন্য হুকুম বের করে আনতে একজন মুজতাহিদকে সহায়তা করে।
৩) সবশেষে, টেক্সটের ভাবার্থ এমনভাবে ব্যক্ত, একটি হুকুমকে অন্য হুকুমে সম্প্রসারনের ভিত্তি হিসেবে সহায়ক এবং এই প্রক্রিয়াটিতে অসংখ্য বিষয় জড়িত। এই আর্টিকেলটিতে এই ধরনের দুটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে, মানতূক ও মাফহূম।
মানতূক:
মানতূক শব্দটি ‘নাতাকা’ শব্দ থেকে উদ্ভূত (যা ‘উচ্চারন করা’ এর অতীতবাচক রূপ) এবং মানতূক অর্থ হচ্ছে ‘উচ্চারিত শব্দ’ যা অতীতবাচক শব্দ।
শরীআহতে মানতূক বলতে বুঝানো হয় যা টেক্সটের উচ্চারিত বা উল্লেখিত শব্দ হতে সরাসরি উপলব্ধ হয়। যেমন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন,
কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে [সূরা বাকারা: ১৮৫]
এই টেক্সটটি রমজানে সিয়ামের ফরজিয়্যাতকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এছাড়াও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন,
সালাত কায়েম করো
এই আয়াতটি সালাতের ফরজিয়্যাতকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, সালাত আদায় করো, যেভাবে তোমরা আমাকে সালাতে দেখ।
এই হাদীসে বলা হয়েছে যে, মুসলিমদের রাসূল (সা) এর পদ্ধতিতেই সালাত আদায় করতে হবে। এছাড়াও, রাসূল (সা) বলেছেন, সালাতে ইমাম নিয়োজিত হয়েছে অনুসরনের জন্য, তাই তার রুকূ অনুযায়ী রুকূ করো।
হাদীসটি এই দিকনির্দেশনা দেয় যে, সালাতে ইমামকেই অনুসরন করতে হবে ও মুসলিমদের অবশ্যই ইমামের রুকুর পরপরই রুকু করতে হবে। এ উদাহরণের অর্থটি নেয়া হয়েছে তার টেক্সট থেকে। অর্থাৎ, এইসকল অর্থ মানতূক তথা ব্যক্ত শব্দ (শাব্দিক অর্থ) হতে নেয়া হয়েছে যা কুরআনের কোনো আয়াত বা রাসূল (সা)-এর কোনো হাদীস হতে নেয়া হয়েছে ।
মাফহূম:
মাফহূম শব্দটি এসেছে “ফাহিমা”থেকে যার শাব্দিক অর্থ “অনুধাবন করা”বা “বুঝতে পারা”। এখানে মাফহূম মানে সরাসরি টেক্সট থেকে আক্ষরিকভাবে কোন কিছুকে নেয়া বলা হয় না বরং টেক্সটের অর্থ হতে যা পাওয়া যায় অর্থাৎ বক্তব্যের অন্তর্নিহিত বা পরোক্ষ ভাব। বক্তব্যের আক্ষরিক অর্থ হতে যা বোঝা যায় তা নয় বরং ব্যক্ত বক্তব্য থেকে যা উপলব্ধি করা যায় তা-ই হলো মাফহূমের শরীয়াহগত অর্থ। যেমন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ
তাদের প্রতি ‘উফ’ বলোনা [সূরা বনী ইসরাঈল: ২৩]
এর সরাসরি অর্থ হলো পিতামাতার প্রতি ‘উফ’ না বলা। তথাপি, এর ভাবার্থ হলো কোনো রকমের বাচনিক বা শারীরিক বিরক্তি প্রকাশ না করা (যদিওবা টেক্সটে তা সরাসরি উল্লেখিত নেই)। অতএব, শব্দটি ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা নেয়া হয়েছে মানতূক থেকে আর প্রত্যক্ষভাবে পিতামাতাকে গালাগাল বা মারধর করার নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নেয়া হয়েছে এর মাফহূম থেকে। আক্ষরিকভাবে ঐ আয়াতে পিতামাতার প্রতি ঐ নির্দিষ্ট ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে আর ঐ আয়াতের অর্থ এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, পিতামাতার প্রতি কোনো রকম খারাপ ব্যবহার, তা বাচনিক কিংবা শারীরিক দুর্ব্যবহার হোক তা না করা বুঝাচ্ছে। মাফহূমকে দুইভাগে ভাগ করা যায়:
১। মাফহুম আল মুয়াফাকাহ
২। মাফহুম আল মুখালাফাহ
মাফহুম আল মুয়াফাকাহ:
মুয়াফাকাহ এর শাব্দিক অর্থ “কোন কিছুর সাথে সংগতিপূর্ণ”। তাই, মাফহূম আল মুয়াফাকাহ-র অর্থ দাড়ায় “অনুধাবিত অর্থ যা কোন কিছুর সাথে সংগতিপূর্ণ”।
যদি টেক্সট থেকে উৎসারিত কোন হুকুম বা বিধি যদি ঐ টেক্সটের মানতূকের সাথে সংগতিপূর্ণ হয় তবে তাকে মাফহূম আল মুয়াফাকাহ বলা হবে। পিতামাতাকে শারীরিকভাবে অত্যাচারের উপরোল্লিখিত নিষেধাজ্ঞাটি এর একটি উদাহরণ। পিতামাতাকে মারধরের নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত মাফহূমটি উফ বলার নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত মানতূকের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। মাফহূম ও মানতূক উভয়ই কোন কিছু নিষেধ করছে। তাই এই ক্ষেত্রে মাফহূমকে মাফহূম আল মুয়াফাকাহ বলা হবে।
আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا
যারা এতিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষন করে.. [সূরা নিসা: ১০]
মানতূক অন্যায়ভাবে এতিমের সম্পদকে গ্রাস করার ব্যাপারে নিষেধ করছে। মাফহূম এই আয়াতে শুধু সম্পদ অন্যায়ভাবে নেয়াকে নয় বরং তাদের সম্পদ নষ্ট করে ফেলার নিষেধাজ্ঞার প্রতিও নির্দেশনা দিচ্ছে। এখানে মানতূক ও মাফহূম উভয়ই নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। যেহেতু মাফহূম মানতূকের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ তাই এটি মাফহূম আল মুয়াফাকাহ।
মাফহুম আল মুখালাফাহ:
মুখালাফাহ-র শাব্দিক অর্থ “কোনো কিছু অন্য কিছুর সাথে অসংগতিপূর্ণ হওয়া”। তাই মাফহূম আল মুখালাফাহ এর শাব্দিক অর্থ দাড়ায় “অনুধাবিত অর্থ অন্য কোনো কিছুর সাথে অসংগতিপূর্ণ হওয়া”।
যদি হুকুমটি এমন টেক্সট থেকে নেওয়া হয় যা এর মানতূক এর অর্থের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়, তাহলে তাকে মাফহুম আল-মুখালাফা বলা হবে। উদাহরনসরূপ, যখন মানতুক কোনো বাধ্যবাধকতা প্রতিষ্ঠা করে অথচ মাফহুম নিষেধ প্রতিষ্ঠা করছে, যেহেতু, বাধ্যবাধকতা ও নিষেধ দুটোই একে অপরের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। এটি তখনো হতে পারে যখন মানতূক বা মাফহুম এর যেকোনো একটি বাধ্যবাধকতা বা নিষেধ প্রতিষ্ঠা করছে এবং অপরটি করছে না। উদাহরনসরূপ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সূরা আহযাবে বলেন,
وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا
যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে [সূরা আহযাব: ৫৮]
এ আয়াতের মানতূক কোনো মুসলিমের উপর বৈধ কারণ ছাড়া কষ্টারোপ বা ক্ষতিসাধন করা নিষেধ করছে। কিন্তু যদি কষ্টারোপের কোনো বৈধ কারণ থেকে থাকে তবে তা করাটি বৈধ বলে বিবেচিত হবে। উদাহরনসরূপ, যদি কোনো মুসলিম চুরি করে তবে তার হাত কেটে দেয়া হবে এবং এটি তার জন্য ক্ষতিসাধন। এক্ষেত্রে, মাফহূম বৈধতা প্রতিষ্ঠা করছে যদিও মানতূক নিষেধাজ্ঞা প্রতিষ্ঠা করছে। যেহেতু, হালাল ও হারাম একে অপরের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। তাই এই মাফহূমকে বলা হবে মাফহূম আল-মুখালাফা।
আরেকটি উদাহরন রয়েছে সূরা আহযাবে:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا نَكَحْتُمُ الْمُؤْمِنَاتِ ثُمَّ طَلَّقْتُمُوهُنَّ مِنْ قَبْلِ أَنْ تَمَسُّوهُنَّ فَمَا لَكُمْ عَلَيْهِنَّ مِنْ عِدَّةٍ تَعْتَدُّونَهَا
মুমিনগণ! তোমরা যখন মুমিন নারীদেরকে বিবাহ কর, অতঃপর তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিয়ে দাও, তখন তাদেরকে ইদ্দত পালনে বাধ্য করার অধিকার তোমাদের নাই [সূরা আহযাব: ৪৯]
এখানে মানতূক একটি হুকুম প্রতিষ্ঠা করছে যে, যদি কোনো মহিলাকে তালাক দেয়া হয়, তাহলে সে ইদ্দত ছাড়াই আবার বিবাহ করতে পারবে। মাফহূম বলছে, যদি বিবাহ-সম্ভোগের পরে তালাক হয়, তবে ইদ্দত অপরিহার্য। মানতূক ইদ্দত প্রতিষ্ঠা করে না, তবে মাফহূম ইদ্দত প্রতিষ্ঠা করে, তাই এটি মাফহূম আল-মুখালাফা। এটি এমন এক হুকুমের উদাহরণ যা নির্দিষ্ট শর্তের উপর নির্ভরশীল।
এই মাফহূম চার অবস্থায় প্রয়োগ হতে পারে:
১) যদি হুকুমটি কোনো নির্দিষ্ট বর্ণনার সাথে জড়িত থাকে।
২) যদি হুকুমটি কোনো নির্দিষ্ট বর্ণনার অবস্থার সাথে জড়িত থাকে।
৩) যদি হুকুমটি কোনো স্থান ও সময়ের উপর সীমারোপ করে।
৪) যদি হুকুমটি কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যার সাথে জড়িত থাকে।
১। যদি হুকুমটি কোনো নির্দিষ্ট বর্ণনার সাথে জড়িত থাকে:
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন: ধনী ব্যক্তির (দেনা পরিশোধ) দীর্ঘায়িত করা যুলুম। হাদীসের মানতূক প্রতিষ্ঠা করছে যে, যদি ধনী ব্যক্তি তার দেনা পরিশোধে টাল-বাহানা করে কিংবা দীর্ঘায়িত করে, তবে তা নিষেধ। আর মাফহূম হচ্ছে দরিদ্র ব্যক্তির দেনা পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত সময় চাওয়া বৈধ। এখানে মানতূক নিষেধাজ্ঞা অন্যদিকে মাফহূম বৈধতা প্রতিষ্ঠা করছে।
এই উদাহরণে, মূল টেক্সটের হুকুমটি একটি বর্ণনার সাথে সম্পর্কিত, কোনো নামবাচক কিছুর সাথে নয়। ‘গণী’ শব্দটির অর্থ ধনী যা কোনো ব্যক্তির বর্ণনা যা তার মধ্যে বিরাজ করতে পারে আবার নাও পারে।
২। যদি হুকুমটি কোনো নির্দিষ্ট বর্ণনার অবস্থার সাথে জড়িত থাকে:
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
وَإِن كُنَّ أُولٰتِ حَملٍ فَأَنفِقوا عَلَيهِنَّ حَتّىٰ يَضَعنَ حَملَهُنَّ
যদি তারা গর্ভবতী হয়, তবে সন্তানপ্রসব পর্যন্ত তাদের ব্যয়ভার বহন করবে [সূরা তালাক: ৬]
আয়াতের মানতূক হচ্ছে তালাকপ্রাপ্ত নারীর সন্তান জন্ম না নেয়ার আগমূহুর্ত পর্যন্ত ভরণপোষণের ফরযিয়্যাত আয়াতের মানতূক থেকে স্পষ্ট। যদিওবা, সে সন্তানসম্ভবা না হলে তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়ার ফরযিয়্যাতটি প্রয়োগ না হয়ার বিষয়টি মাফহূম থেকে স্পষ্ট। এক্ষেত্রে মানতূক মাফহূমের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়, তাই এটি মাফহূম আল-মুখালাফা।
৩। যদি হুকুমটি কোনো স্থান ও সময়ের উপর সীমারোপ করে:
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ
অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত [সূরা বাকারা: ১৮৭]
আয়াতে মানতূক হচ্ছে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত মুসলিমরা রোজা রাখতে বাধ্য। যদিওবা মাফহূমে সূর্যাস্তের পর রোজা রাখাকে হারাম করা হয়েছে। মানতূক মাফহূমের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়, তাই এটি মুখালাফা।
৪। যদি হুকুমটি কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যার সাথে জড়িত থাকে:
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِئَةَ جَلْدَةٍ
ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর [সূরা নূর: ২]
আয়াতের মানতূক হচ্ছে ১০০টি বেত্রাঘাত (দোররা) মারা। মাফহূম হচ্ছে ১০০ এর উর্ধ্বে না যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা। মানতূক মাফহূমের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়, তাই এটি মুখালাফা।
রাসূল (সা) বলেন “যদি সফরকালের সঙ্গী তিনজন হয় তবে একজনকে নেতা নির্বাচন করে নাও”। এবং “পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে অবস্থিত তিনজন মানুষের জন্য তাদের একজনকে আমীর নির্বাচন করা ব্যতিত থাকা বৈধ নয়”।
এইখানে এক বলতে শুধুমাত্র একজনকেই বুঝানো হয়েছে অর্থাৎ একটি সংখ্যার দিকে জোর দিয়েছে অন্যকিছু নয়। এটি মাফহুম আল মুখালাফা থেকে উৎসারিত। এই ক্ষেত্রে অন্য কোন দলীল পাওয়া যায় না যা একে বাতিল করে। তাই, মাফহুম আল মুখালাফাহ উপরোক্ত হাদীসদ্বয় হতে এই নির্দেশনা দেয় যে মুসলিমদের জন্য একের অধিক ব্যক্তির নিকট শাসনকর্তৃত্ব থাকা বৈধ নয়।
যেসব ক্ষেত্রে মাফহূম আল মুখালাফাহ প্রয়োগ হয়না:
যদি উপরোল্লিখিত কোনো বাস্তবতার সাথে হুকুমের মিল না থাকলে তা প্রয়োগ হবে না। যেমন: যদি হুকুমটি কোন গুণের (সিফাত) পরিবর্তে কোন বস্তু (নামবাচক – ইসম) এর সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়। এর দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, আমরা জানি মজুতদারী ইসলামে হারাম, কেননা রাসূল (সা) বলেন- “একমাত্র অসৎ ব্যক্তিই মজুতদারী করে” [মুসলিম]। তাই কোন পণ্য দাম বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মজুত রেখে বিক্রী করা হারাম। কিন্তু যোগান যদি বেশি হয় এবং পন্যের মজুতকরন যদি জনগণের জন্য বোঝাস্বরূপ না হয়, সেক্ষেত্রে এটি জায়েজ।
আবার, আরেকটি হাদীসে রাসূল (সা) খাদ্য দ্রব্যের মজুতদারীকে কড়া নিন্দা জানিয়েছেন। এই হাদীসের মানতুক হচ্ছে খাদ্যদ্রব্যের মজুতদারি হারাম, এবং মাফহূম আল-মুখালাফাহ হচ্ছে খাদ্যপণ্য ছাড়া বাকী পণ্যের মজুতদারি হালাল হওয়ার নির্দেশনা। যদিওবা, যেহেতু হারাম হওয়াটা একটি শব্দ “তো’য়াম”-আরবী ব্যাকরন অনুসারে যা একটি বিশেষ্য (ইসম) ও কোন বিশেষণ (সিফাত) নয়, তাই মাফহূম আল-মুখালাফাহ এইক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় এবং শুধু খাদ্যদ্রব্য নয় বরং সব কিছুর মজুতদারি হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এই হাদীসের মাফহূমে অন্যান্য পণ্যের মধ্যে একটি পণ্যের মজুতদারি হারামের কথা বলা হয়েছে।
অন্য আরেকটি হাদীসে, রাসূল (সা) বলেন- “তোমরা একের পর এক ইমামের (খলীফার) বা’য়াত পূর্ণ কর” এবং আরেক বর্ণনায় “সকলেই (ইমামই) কুরাইশ থেকে হবে”। [মুসলিম]
প্রথম হাদীসটি একজন ইমাম বা খলীফাহ নিয়োগ সংক্রান্ত। দ্বিতীয় হাদীসটিতে কুরাইশ শব্দটি প্রথমে হাদীসে উল্লেখিত বা’য়াতের ফরযিয়্যাতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু যেহেতু কুরাইশ শব্দটি একটি নামবাচক শব্দ (ইসম), তাই মাফহূম আল-মুখালাফাহ প্রয়োগ হবে না অর্থাৎ এক্ষেত্রে ইমামকে কুরাইশ থেকে হতেই হবে তার বাধ্যবাধকতা আর থাকে না।
যদি প্রাপ্ত মাফহূমের বিপরীতে অন্য কোনো দলীল পাওয়া যায় যা মাফহূমের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ নয়, সেক্ষেত্রে এ নীতি প্রয়োগ হবে না। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا
যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে [আহযাব: ৫৮]
এই আয়াতে মুসলিমদেরকে কষ্ট দেয়া হারাম করেছে, মাফহুম আল-মুখালাফাহ থেকে তার মানে দাড়ায় অমুসলিমদের কষ্ট দেয়া বৈধ, যা ভুল। কেননা অন্য আরেকটি আয়াতে যেকোনো কাউকে অন্যায়ভাবে কোনরূপ কষ্ট দেয়াকে হারাম ঘোষণা করেছে যদিও সে অমুসলিম।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا نَكَحْتُمُ الْمُؤْمِنَاتِ ثُمَّ طَلَّقْتُمُوهُنَّ مِنْ قَبْلِ أَنْ تَمَسُّوهُنَّ فَمَا لَكُمْ عَلَيْهِنَّ مِنْ عِدَّةٍ تَعْتَدُّونَهَا
মুমিনগণ! তোমরা যখন মুমিন নারীদেরকে বিবাহ কর, অতঃপর (যদি) তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিয়ে দাও, তখন তাদেরকে ইদ্দত পালনে বাধ্য করার অধিকার তোমাদের নাই [সূরা আহযাব: ৪৯]
এই আয়াতটি তালাকপ্রাপ্ত মুমিন নারীকে তার ইদ্দতকালের সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে। আয়াতটি হতে এই মাফহূম পাওয়া যায় যে এটি অমুসলিমদের ব্যপারে প্রযোজ্য নয়, যে তাদের ইদ্দত নেই।
এটি দুইটি কারনে ভুল:
وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ
আর তালাকপ্রাপ্তা নারী নিজেকে অপেক্ষায় রাখবে তিন কুরূ পর্যন্ত [সূরা বাকারা: ২২৮]
এই আয়াতে তালাকপ্রাপ্ত নারীদের তারা তালাকপ্রাপ্ত হওয়া ছাড়া অন্য কোন বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়নি, তাই এই আয়াতের মানতূক সুরা আহযাবে উল্লেখিত মাফহূম আল-মুখালাফাকে খারিজ করে দেয়।
সুরা আহযাবের আয়াতের বর্ণনা (মুসলিম বনাম অমুসলিম)-এ হুকুমটি বাস্তবায়ন করার জন্য কোনো পরোয়ানা জারি করে না। একজন মহিলা সে মুসলিম বা অমুসলিম হওয়া না হওয়ার সাথে তার ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই এটি আম বা সাধারন হুকুম হিসেবে থাকবে এবং এর বর্ণনা এই হুকুমকে সীমাবদ্ধ করে না। যদি কোনো শিক্ষক কোনো মেধাবী ছাত্রকে পুরষ্কৃত করে থাকে তাহলে সে এর দাবিদার বলা যায়। কিন্তু যদি পুরষ্কারটি কোন মোটা ছাত্রকে দেয়া হয় তবে সেটির সাথে তার কৃতিত্বের কোন সম্পর্ক নেই এবং তাকে এর দাবিদারও বলা যায় না। ঠিক একইভাবে, উল্লেখিত আয়াতটিতে ইদ্দতকাল পূরন করার বিষয়টি কোনো মহিলার বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত করার কোনো ভিত্তি নেই।
সারমর্ম:
পরিশেষে, দুটি বিষয় আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে:
প্রথমত, এই বিষয়টি নিয়ে উম্মাহ-র মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য আলোচনা না হওয়ার দরূণ তাদের চিন্তায় বিস্তর ফারাক দেখা দেয়, ফলে সে নিজের সুবিধা মত আয়াতের ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করে। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বর্তমান তথাকথিত মুসলিম শাসকগোষ্ঠী তাদের পছন্দের আলেম দিয়ে এই নীতির মাধ্যমে খাদ্যের মজুতকরণ, উম্মাহ-র সম্পদ লুটকে যায়েজ করে নেয়। তাই মুসলিমদেরকে পূনর্জাগরণের জন্য এই নীতি সম্পর্কে ভালো ধারনা থাকা প্রয়োজন কেননা এটি ইসলামী টেক্সটকে ভালোমত উপলব্ধি করার সাথে সম্পর্কযুক্ত যা মুসলিমদের জীবনকে পরিচালিত করে ।
দ্বিতীয়ত, টেক্সটকে বুঝার প্রক্রিয়া অন্যান্য প্রক্রিয়ার মতই সূক্ষ্ম; তাই এটি পর্যবেক্ষনের ক্ষেত্রে অবশ্যই কড়া বিধি-বিধান মেনে চলতে হবে। আর তা না করলে, এর সাদৃশ্যতা সেইরূপ যেন কোনো যন্ত্রপাতি, পদ্ধতি, সূত্র ও সমীকরণের জ্ঞান ছাড়াই কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করতে যাওয়া। যা কোনভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়।