এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে সারা বিশ্বের নেতা রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ (সা) এর হাতে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তা ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ বিশ্বাসঘাতক কামাল আতাতুর্কের হাতে তা ধ্বংস হয়। খুলাফায়ে রাশেদিনের পর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা বা খিলাফত ব্যবস্থা যে ধারাবাহিকভাবে টিকেছিল তা ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও শরীয়াহর দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করলে তা আমাদের কাছে বোধগম্য হবে।
আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে এ ব্যবস্থার ধারাবাহিক অস্তিত্ব বুঝতে চাই, তাহলে দেখতে হবে প্রথমতঃ এ ব্যবস্থার কাঠামো কি ইতিহাস জুড়ে টিকেছিল কিনা। দ্বিতীয়তঃ এ কাঠামোতে সময়ের আবর্তে কি কোন পরিবর্তন এসেছে কিনা। রাসুল (সা) ও খুলাফায়ে রাশেদিনের সময়ের ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভগুলো হল:
১। খলীফা বা রাষ্ট্রপ্রধান।
২। খলীফার প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী (মু’ওয়ায়ীন আত তাফউঈদ)।
৩। খলীফার নির্বাহী সহকারী (মু’ওয়ায়ীন আত তানফীয)।
৪। গভর্ণরবৃন্দ (উলাহ্)।
৫। আমীর-উল-জিহাদ।
৬। বিচার বিভাগ।
৭। প্রশাসনিক বিভাগ।
৮। উম্মাহ্ কাউন্সিল (মাজলিস আল-উম্মাহ্)।
তাই আমরা যদি ১৯২৪ সাল পর্যন্ত ১৩০০ বছরের ইতিহাসের চুলচেরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাই পরামর্শ সভা মাজলিস আল উম্মাহই শুধু বিভিন্ন সময়ে উপেক্ষিত বা অবহেলিত ছিল। খুলাফায়ে রাশেদিনের পর মাজলিস আল উম্মাহর প্রতি কিছু সংখ্যক খলীফার উদাসীনতার অর্থ এই নয় যে, পরামর্শ সভা না থাকলেই ব্যবস্থা হিসেবে খিলাফতের অবসান হয়ে গেল। অন্য সব স্তম্ভ টিকে থাকলে মাজলিসুল উম্মাহ বা শুরা ছাড়াও ইসলামী শাসন ব্যবস্থা চলতে পারে, যদিও শুরা উম্মাহর অধিকার। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সংকট, গৃহযুদ্ধ ও বিদেশী সেনাবাহিনীর আগ্রাসন ঘটলেও এমন কখনো হয় নি যে, মুসলিমরা খলীফা বিহীন ছিল।
নিজের পুত্রকে খলীফা হিসেবে মনোনয়ন দেয়া বা বংশীয় শাসনের অভিযোগ খানিকটা সত্য এবং এটাও সত্য যে, খলীফা নিয়োগের বায়াতের পদ্ধতিতেও কখনো কখনো অনিয়ম দেখা যায়। কিন্তু এটা খিলাফতের ধারাবাহিকতাকে কখনো প্রভাবিত করতে পারেনি। অনেক সময় এমনও ঘটেছে যে, খলীফা তার ছেলেকে যোগ্য মনে করলে তার মৃত্যুর আগেই জনগণের কাছ থেকে ছেলের জন্য বায়াতের শপথ আদায় করেছিলেন। পরবর্তীতে তা আবার নবায়ন করেছেন। এ বাই’য়াত মূলত প্রভাবশালী লোকজন এবং জনপ্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করত।
খুলাফায়ে রাশেদিনের পর খিলাফত টিকে থাকার কথা ইসলামী আলেমরাও স্বীকার করেছেন। যদিও এদের মধ্যে দু একজন তিরমিযী শরীফের একটি হাদীসের কারণে প্রথম চার খলীফার পর পরবর্তী খলীফাদের ক্ষেত্রে ‘খলীফা’ শব্দটি ব্যবহার করতে অপছন্দ করতেন। সে হাদীসটি হল: রাসুল (সা) বলেছেন, “আমার পর আমার উম্মাহর মধ্যে ৩০ বছর পর্যন্ত খিলাফত থাকবে তারপর শুরু হবে বংশীয় আকড়ে ধরা শাসন”(মুলকান আদ্দান) [একই বর্ণনা-সুনানে আবু দাউদ (২/২৬৪) এবং মুসনাদে আহমদ (১/১৬৯) থেকেও পাওয়া যায়।] ইসলামী বিশারদগণ ব্যাখ্যা করেন যে, যেহেতু এ হাদীসটি এ বিষয়ক অন্যান্য হাদীসের সঙ্গে আপাত দৃষ্টিতে সাংঘর্ষিক মত প্রদান করে তাই এই হাদীসের গূঢ় অর্থ ৩০ বছর পর খিলাফত ব্যবস্থা শেষ হয়ে যাবে তা নিশ্চিতভাবে বোঝাচ্ছে না।
জাবির বিন সামুরাহ (রা) বর্ণনা করেন, “রাসূল (সা) বলেন, দ্বীন ইসলাম ততদিন পর্যন্ত টিকে থাকবে যতদিন না আল্লাহর নির্ধারিত ক্ষণ উপস্থিত হয় অথবা কুরাইশ বংশীয় বারজন খলীফা তোমাদেরকে শাসন না করে” [সহীহ মুসলিম]।
এ হাদীস থেকে বোঝা যায় মুসলমানদের চার পাঁচ জন নয় বরং একাধিক সংখ্যক খলীফা শাসন করবেন। এ হাদীস অনুসারে খিলাফত ব্যবস্থা শুধু ত্রিশ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা বাস্তব সম্মত নয়। এ হাদীসের ব্যাখ্যায় কাজী আইয়াদ বলেন, “এই হাদীসটিতে যেখানে বলা হয়েছে ‘আমার পর খিলাফত ৩০ বছর টিকে থাকবে, এর পর শুরু হবে বংশীয় শাসন’ যা পুর্ববর্তী এই হাদীসটির সাথে সাংঘর্ষিক- ‘যত দিন না কুরাইশ বার জন খলীফা উম্মাহকে শাসন করে, ইসলামী দ্বীন ততদিন টিকে থাকবে’। [সহীহ মুসলিম] এ সাংঘর্ষিক মনে হওয়া বিবৃতির সমাধান হল – ৩০ বছর খিলাফত টিকে থাকবে নবুয়্যতের আদলে অর্থাৎ সঠিকভাবে পরিচালিত খিলাফত ব্যবস্থার আদলে। বাস্তবে এই ত্রিশ বছর হযরত আবু বকর (রা) থেকে হাসান বিন আলী (রা) এর শাসনকালকেই বোঝায়। [এভাবেই আন-নববী তার সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যার মধ্যে উল্লেখ করেছেন পৃষ্ঠা-৮২১। পাঠক লক্ষ্য করুন এ ত্রিশ বছরে চার জন নয় বরং পাঁচ জন খলীফা উম্মাহকে শাসন করেছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে রাসূল (সা) বলেন, “বনী ইসরাইলকে শাসন করতেন নবীগণ, যখন এক মৃত্যুবরণ করতেন তখন তার স্থলে অন্য নবী আসতেন, কিন্তু আমার পর আর কোন নবী নেই। শীঘ্রই খলীফারা আসছেন এবং তারা সংখ্যায় হবেন অনেক। তারা (রা) (সাহাবীরা) জিজ্ঞেস করলেন, তখন আপনি আমাদের কী করতে আদেশ দেন? তিনি (সা) বললেন, তোমরা তাদের একজনের পর একজনের বায়’আত পূর্ণ করবে, তাদের হক আদায় করবে”। (বুখারী, মুসলিম)
উল্লিখিত হাদীস থেকে বোঝা যায় রাসুল (সা) এর পর কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী না আসায় কার তত্ত্বাবধানে মুসলমানদের যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালিত হবে সেটা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন এবং সেটা হচ্ছে খিলাফত ব্যবস্থা ও খলীফার তত্ত্বাবধানে।
১২ জন খলীফার বিষয়টিও কাযী আইয়াদ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন ‘সম্ভবত হাদীসটিতে যে ১২ জন খলীফার কথা বলা হয়েছে – তারা হল এমন ১২ জন খলীফা যাদের শাসনকালে ইসলামের শৌর্য-বীর্য বৃদ্ধি পেয়েছিল-উম্মাহ ঐ সকল নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ছিল এবং সর্বোপরি খলীফা হিসেবে উম্মাহর দেখাশুনাও তারা ঠিকভাবে করেছিলেন। [আস সুয়ূতি তারীখ আল খুলাফা, পৃষ্ঠা: ১৪]
ইবনে হাজার বলেন, “এই হাদীসটি সম্পর্কে যে কয়েকজন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার মধ্যে কাযী আইয়াদের যুক্তি সবচেয়ে শক্তিশালী কারণ রাসূল (সা) এর কিছু সংশ্লিষ্ট সহীহ হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েই তিনি যুক্তি তুলে ধরেছেন। যেমন: এ সম্পর্কে রাসূল (সা) বলেন, লোকেরা তাদেরকে কেন্দ্র করে একত্রিত হবে……”। (ফাতহুল বারী) এর পাশাপাশি ইবনে হাজার কয়েকজন খলীফার উদাহরণসহ ঐতিহাসিক সত্যতা তুলে ধরেন।
ইমাম শাফে’ঈ (র) এর অনুসারী ফিকহ বিশেষজ্ঞ সাইফ-উদ-দ্বীন আল আমিদি তার বইয়ের মধ্যে (আল ইমামা মিন আবকার আল আফকার ফি উসুল আদ দিন, পৃ-৩০৬) সংশ্লিষ্ট হাদীসটির ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, এ হাদীসটিতে বলা হয়েছে ‘আমার খিলাফত থাকবে ৩০ বছর তারপর এতে বংশীয় শাসনের রীতি আসবে’। এ হাদিসটিতে চার খলীফা [আবু বকর, উমর, উসমান, আলী (রা)] পর্যন্ত খিলাফত ব্যবস্থা টিকে থাকবে তা বোঝায়নি। এবং এই হাদীসটি দিয়ে শুধু এ কথাও বোঝায়নি যে, চার খলীফার সময় পর্যন্ত খিলাফত ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ থাকবে। বরং রাসূল (সা) বুঝিয়েছেন-তাঁর পর কোন প্রকার বিচ্যুতি ছাড়া তাঁর নেতৃত্বের ধরণ (সুন্নাহ অনুসারে) ইমাম বা খলীফারা উল্লেখিত সময় পর্যন্ত নেতৃত্ব দেবেন। এর পর বেশীর ভাগ শাসকরাই উত্তরাধিকার সূত্রে রাষ্ট্রপ্রধানের পদ অলংকৃত করে শাসন করবেন। তা সত্ত্বেও যে খিলাফত ব্যবস্থা টিকে ছিল তা নিচের দুটি বিষয় থেকে বোঝা যায়।
প্রথমতঃ পরবর্তী সকল সময়ে উম্মাহর মধ্যে এ ব্যাপারে ঐক্যমত ছিল যে তাদের একজন ইমাম বা খলীফা থাকতে হবে এবং তাকে মানা আবশ্যক।
দ্বিতীয়তঃ তিনি (সা) বলেছেন, ‘তারপর আসবে (তাসির) মুলকান’। এখানে যে বাক্যাংশটি ব্যবহার করা হয়েছে সে ‘তাসিরু মুলকান’ (تصير ملكا) দিয়ে খিলাফতকেই নির্দেশ করা হচ্ছে। উল্লিখিত ক্রিয়াটি (তাসিরু) খিলাফতকে ছাড়া অন্য কোন কিছুকেই বোঝায় না। এ দিয়ে আরও প্রতিপন্ন হয় না যে খিলাফতই ‘মুলকে’ পরিণত হবে। কেননা একটি বিষয় অন্য বিষয়ে পরিণত হতে গেলে প্রথম বিষয়টির অস্তিত্বে থাকা অবশ্যই জরুরী। এখানে প্রথম উল্লিখিত বিষয়ে ইমাম আমিদি ব্যাখ্যা করেন, দলিল অনুসারে উম্মাহকে অবশ্যই সে যুগের ইমামকে (খলীফাকে) মানতে হবে। এটা দিয়ে অবশ্যই এক খলীফার পর আরেক খলীফা আসার বিষয়টিকে সীমাবদ্ধ করা হয় নি। আমিদির দ্বিতীয় যুক্তি হল ভাষাতাত্ত্বিক। উক্ত হাদিসটির বক্তব্য হল- খিলাফতের চরিত্র বা প্রেক্ষিত পরিবর্তিত হয়েছে; খিলাফত ব্যবস্থা নিজে নয়। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে যেমন: ‘তারপর তারেক রেগে গেল’ (ثم يصير طارق غاضبا) এখানে তারেকের অবস্থান বা গুণগত অবস্থার পরিবর্তন বুঝিয়েছে। অর্থাৎ তারেক রেগে গিয়ে আলী বা উমরে পরিণত হতে পারে না। একইভাবে হাদিসটিতে যখন বলা হয়েছে “ছুম্মা তাসিরু মুলকান” এর অর্থ হল এবং ‘এরপর আসবে বংশীয় শাসন’ এ বাক্যাংশ দিয়ে কখনো বোঝা যায় না যে খিলাফত ব্যবস্থা শেষ হয়ে গেল। বরং ঐ ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন আসাকে বোঝায়।
৯০৩ হিজরিতে খলীফা মুতাওয়াক্কিল আবুল-’ইজ মৃত্যুবরণ করেন। তার স্থানে তার ছেলে আল মুসতামসিক বিল্লাহ খলীফা নিযুক্ত হন। এ সময়ে বিখ্যাত ইসলামী পণ্ডিত ইমাম জালাল আল-দিন সুয়ুতি তারীখ আল খুলাফা (খলীফাদের ইতিহাস) বইয়ে তখন পর্যন্ত খলীফা হসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তিনি এ বইয়ের সূচনায় বলেন, “আবু বকর (রা) এর মৃত্যুর পর থেকে এ পর্যন্ত যত খলীফা শাসন করেছেন এখানে সংক্ষেপে সে সব খলীফাদের জীবনী তুলে ধরলাম। যারা ছিলেন বিশ্বাসীদের নেতা (আমীর উল মু’মিনিন) যারা উম্মাহর সকল বিষয় নিয়ে দেখাশুনা করতেন”। তার এই বই লেখার সময়টা ছিল হিজরতের ৯০০ বছর পর। সমস্ত খিলাফতের সময়কাল জুড়েই তৎকালীন খলীফাদের সাথে ইসলামী পণ্ডিতদের যোগাযোগ ছিল। কেউ কেউ খলীফাদের বিভিন্ন কাজের কৈফিয়ত বা ইসলামী ব্যাখ্যা চাইতেন। আবার কেউ কেউ তাদের শাসন কাজে সরাসরি সহযোগিতা করতেন। উদাহরণ দিয়ে বলা যায় – ইমাম আবু হানিফা খলীফা আল মানসুরের এক সিদ্ধান্তের কৈফিয়ত চেয়েছিলেন। কাজি আবু ইউসুফ খলীফা হারুন অর রশিদের শাসন আমলে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুসতানসির বিল্লাহ তাতারদের পরাজিত করার পর আল-’ইজ বিন আব্দুস সালাম তার নিকট বায়’আত গ্রহণ করেছিলেন।
উসমানীয় খিলাফতের শেষের দিকে পশ্চিমা পুঁজিবাদী শক্তিগুলো যখন মুসলিমদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিল দেয়ার ষড়যন্ত্রে মগ্ন ছিল তখন মাওলানা কাশিম নানুতবি (র) এর সরাসরি ছাত্র ও দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান মাওলানা মুহাম্মদ হাসান (র) ১৯২০ সালে ইসলামের শত্রুদের সাম্রাজ্যবাদী ছোবল থেকে উসমানীয় খিলাফতকে রক্ষা করার জন্য মুসলিমদের উদ্দেশ্যে এক ফতোয়া জারি করেন। সম্মানিত মাওলানা হাসান বলেন ‘ইসলামের শত্রুরা ইসলামের সম্মান ও প্রতিপত্তি ধ্বংস করতে চেষ্টার ত্রুটি করছে। ইরাক, ফিলিস্তিন, সিরিয়ার উপর তাদের লোভাতুর দৃষ্টি পড়ছে। মুসলমানদের খলীফা – যিনি সারা বিশ্বের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করেন, পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি, ইসলামের সার্বজনীন আইন বাস্তবায়নকারী; যিনি মুসলিমদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করেন এবং সৃষ্টিকর্তার সম্মানিত বাণী পৃথিবীর বুকে রক্ষা ও বাস্তবায়নকারী, সেই খলীফারা আজ শত্রু বেষ্টিত ……… [মাওলানা সাইদ মুহাম্মদ মিয়ার “দ্যা প্রিজনার অফ মাল্টা” বইয়ে ২৯ অক্টোবর ১৯২০ সালে জারিকৃত ফতোয়াটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন, পৃষ্ঠা ৭৮]
খিলাফত আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা মাওলানা মুহাম্মদ আলি যোহার খিলাফত সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “তুরস্কের খলীফারা হল রাসূল (সা) এর উত্তরাধিকারী। মুমিনদের নেতা বা বিশ্বাসীদের প্রধান। যার অস্তিত্বের কথা কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। (মোহাম্মদ আলী যোহার, মাই লাইফ এ ফ্র্যাগমেন্ট)। এ প্রসঙ্গে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মাওলান আবুল কালাম আজাদের ১৯২০ সালে খিলাফত নিয়ে লেখা “দ্যা ইস্যু অব খিলাফত” বইয়ের শুরুতেই লিখেন, খিলাফত ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। ইন্ডিয়ার মুসলমানদের উচিত তাদের সর্বোশক্তি ও সামর্থ্য দিয়ে খিলাফত রক্ষা করার জন্য কাজ করা”। বইটির মধ্যে আবু বকর (রা) থেকে শুরু করে ১৯২০ সাল পর্যন্ত সকল খলীফার একটি তালিকাও তিনি সংযোজন করেন। খিলাফতের শেষ পর্যায়ে এসেও তাই আমরা দেখতে পাই খিলাফত টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে উলামারা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন। খুলাফায়ে রাশেদিনের পর খিলাফতের ধারাবাহিকতা থাকাটা আহলুস সুন্নাতের বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ প্রসঙ্গে শাফি মাযহাবের ইমাম আত-তাফতাজানী হানাফী মাযহাবের ইমাম আন নাসাফির চিন্তার সঙ্গে সম্পুর্ণ একমত পোষণ করেন। এ বিষয়ে আত-তাফতাজানী বলেন, উম্মাহর জন্য একজন ইমাম নিয়োগ করা যে বাধ্যতামূলক সে বিষয়ে সকল ইমামের মধ্যে মতৈক্য আছে। কারণ রাসূল (সা) বলেছেন, “যে ব্যাক্তি এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে তার কাঁধে কোন খলীফার বায়’আত (আনুগত্যের শপথ) নেই তবে তার মৃত্যু হচ্ছে জাহেলিয়াতের মৃত্যু” (মুসলিম)। আত-তাফতাজানী আরও বলেন, “মুসলিমদের একজন ইমাম থাকা বাধ্যতামূলক যিনি মুসলমানদের প্রশাসন পরিচালনা করবেন। যিনি মুসলিমদের জন্য নির্দেশিত ডিক্রিগুলো রক্ষা করবেন, মুসলিমদের ভৌগলিক সীমানা সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করবেন, মুসলিম সেনাবাহিনীকে যথাযথ সামরিক সরঞ্জামে সুসজ্জিত রাখবেন, জনগণের দানের অর্থ গচ্ছিত রাখবেন, জুম্মাহর নামাজ ও প্রধান প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দিবেন, সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করবেন, বৈধ অধিকার রক্ষার পক্ষে তিনি প্রমাণাদি গ্রহণ করবেন। অভিভাবকহীন যুবক যুবতীদের নিজ অভিভাবকত্বে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। [আকিদাত অ্যান নাসাফিয়া পৃঃ ১৪৭]
ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও দলীলের নিরীখে ইমাম তাফতাজানী বক্তব্য যে ঠিক তা বোঝা যায়। একজন খলীফা নিয়োগ করা মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক যা রাসূল (সা) এর সুন্নাহেরই প্রতিফলন। তাই উল্লেখিত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায় আমাদের সমাজে খিলাফতের কাল “ত্রিশ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ” ছিল তা নিতান্তই অবাস্তবিক, অযৌক্তিক ও অলীক অনুমান ছাড়া আর কিছুই নয়। খিলাফত ব্যবস্থা উম্মাহকে দেখাশুনার ব্যবস্থা হিসেবে রাসূল (সা) এর ওফাতের পর উসমানীয় খিলাফতের আমল পর্যন্ত টিকেছিল।