ইসলামী রাষ্ট্র – পর্ব ৩৬ (ইসলামের বিজয়যাত্রা সুসংহতকরণ)

[নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘আদ-দাওলাতুল ইসলামীয়্যাহ’ (ইসলামী রাষ্ট্র) বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে নেয়া হয়েছে]

অতীতে মুসলিমরা বহু দেশ জয় করে সেখানে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছে। বস্তুতঃ ইসলামই তাদের শাসন-ক্ষমতা ও নেতৃত্ব-কর্তৃত্বে উপবিষ্ট হবার নির্দেশ দিয়েছে। কারণ, অমুসলিমদের দ্বারা শাসিত হওয়া মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা সূরা নিসাতে বলেছেন,

“আল্লাহ কখনোই মু’মিনদের উপর কাফিরদেরকে জন্য কোন পথ রাখবেন না।” [সুরা নিসাঃ ১৪১]

এছাড়া, আল্লাহতায়ালা সম্মান ও মর্যাদা মু’মিনদের জন্য নির্ধারিত করেছেন। তিনি সুরা মুনাফিকুনে বলেছেন,

“এবং সম্মান ও মর্যাদা তো শুধু আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মু’মিনদের জন্যই নির্দিষ্ট, কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না।” [সুরা মুনাফিকুনঃ ৮]

আল্লাহতায়ালা মুসলিমদের ততক্ষন পর্যন্ত প্রতিপত্তি, শাসন-ক্ষমতা এবং নেতৃত্ব দেননি, যতক্ষন পর্যন্ত না তারা তাদের মনমানসিকতাকে সত্যিকার ভাবে ইসলামের আলোকে গঠন করতে পেরেছে। আর প্রকৃত অর্থে, এ মানসিকতা বলতে বোঝায়, শাসন-কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব অর্জনের মাধ্যমে ইসলামকে পরিপূর্ণ ভাবে বাস্তবায়ন করা এবং ইসলামের বাণীকে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করা, ক্ষমতা অর্জনের মোহে মত্ত হয়ে যাওয়া নয়। মুসলিমরা যতক্ষন পর্যন্ত না এই যোগ্যতা ও মানসিকতা অর্জন করেছে [অর্থাৎ, তারা বুঝতে পেরেছে জনগণকে শাসন করা বলতে আসলে কি বোঝায় এবং আল্লাহর কাছে এর জবাবদিহিতা কতোটুকু] ততক্ষন পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা তাদেরকে শাসন-কর্তৃত্ব এবং জনগণের দেখাশোনা করার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রেখেছেন। বস্তুতঃ ইসলামের অভূতপূর্ব সৌন্দর্য নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত এই সমস্ত ন্যায়পরায়ণ শাসকদের বিভিন্ন কর্মকান্ড ও উক্তির মধ্য দিয়ে অত্যন্ত জোরালো ভাবে প্রকাশিত হয়েছে এবং জনগণও এ আলোকিত সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়েছে, যখন শাসকরা তাদের শরীয়াহ্ আইন-কানুনের মাধ্যমে শাসন করেছে। এর অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসাবে, এই সমস্ত জনগোষ্ঠির মানুষ ইসলামের সৌন্দর্যে এতো বেশী মুগ্ধ হয়েছে যে, তারা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করেছে। ফলে, ইসলামের প্রতিপত্তি, নেতৃত্ব ও ক্ষমতার তারাও অংশীদার হয়েছে এবং সেইসাথে তাদের দেশগুলোও মুসলিম উম্মাহর অংশ হিসাবে ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছে।

বিজিত এ সমস্ত দেশগুলোকে ইসলামী আইন-কানুন অনুসারে শাসন করে ইসলামের এই বিজয়যাত্রাকে সুসংহিত করা হয়েছে, যা পরবর্তীতে আরও শক্তিশালী হয়েছে এ সমস্ত অঞ্চলের মানুষের ইসলাম গ্রহনের মধ্য দিয়ে [Until the conquer of countries by the Islamic state was given until the Day of Judgement]. মূলতঃ এ অভিযানগুলো বিজিত জনগোষ্ঠির মানুষদেরকে তাদের পূর্ববর্তী অবস্থা ও শাসন-ব্যবস্থা থেকে সম্পুর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করেছিল এবং তাদেরকে অবিশ্বাসী জনগোষ্ঠি থেকে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠিতে রূপান্তরিত করেছিল। সেইসাথে তাদের ভূ-খন্ড দারুল কুফর থেকে দারুল ইসলামে রূপান্তরিত হয়েছিল। ইসলামী শাসন-ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেবার পূর্ব পর্যন্ত এই অবস্থা বিরাজ করে। তবে, ইসলামী শাসন-ব্যবস্থা ও মুসলিমদের কর্তৃত্ব ধ্বংস হয়ে যাবার পরও এই অঞ্চলের মানুষেরা মুসলিমই থেকে গিয়েছিল এবং তাদের ভূ-খন্ডগুলোও মুসলিম ভূ-খন্ড হিসাবেই বিবেচিত। যদিও বর্তমানে ইসলামী রাষ্ট্র অনুপস্থিত, কিন্তু তারপরও যে সমস্ত দেশগুলো একসময় মুসলিমরা জয় করেছিল সে সমস্ত দেশের মানুষ এখনও ইসলামকেই আঁকড়ে ধরে আছে এবং তাদের ভূ-খন্ডগুলো এখনও মুসলিম ভূ-খন্ড হিসাবেই বিবেচিত হচ্ছে। এজন্য, এই সমস্ত অঞ্চলগুলোতে ইসলামের কর্তৃত্ব পূনঃপ্রতিষ্ঠিত করে আবারও এ অঞ্চলে ইসলামী শাসন-ব্যবস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

মূলতঃ কিছু কিছু বিষয় ইসলামের বিজয়যাত্রাকে স্থায়ী করতে এবং সেইসাথে ইসলামের বীজকে বিচারদিবস পর্যন্ত মানুষের অন্তরে প্রোথিত করতে সাহায্য করেছিল। এগুলোর মধ্যে কিছু বিষয় বিজিত ভূ-খন্ডগুলোকে শাসন করা সহজ করেছিল, যেমনঃ ইসলামী আইন-কানুনের প্রকৃতি।

আবার অন্যকিছু বিষয় ছিল যা বিজিত জনগোষ্ঠির মানুষকে ইসলাম গ্রহনে উদ্বুদ্ধ করেছিল, যেমনঃ জনগণের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসকদের ব্যবহার। আবার কিছু কিছু বিষয় ধর্মান্তরিত নও মুসলিমদের অন্তরে চিরস্থায়ী ভাবে ইসলামকে প্রোথিত করতে সাহায্য করেছিল, যেমন, ইসলামী আকীদাহর প্রকৃতি।

সংক্ষেপে এই বিষয়গুলো নিম্নরূপে সাজানো যায়ঃ

১. ইসলাম একটি যৌক্তিক আকীদাহ্ বা বিশ্বাস, যা মানুষকে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়ায় চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে ইসলাম গ্রহন করতে বাধ্য করে। এজন্য, যখনই কোন মানুষ ইসলাম গ্রহন করে, তখনই সে চিন্তাশীল ব্যক্তিতে পরিণত হয়। এর কারণ হল, ইসলাম গ্রহনের সাথে সাথেই তার চিন্তা-চেতনা বিশ্ব-ব্রক্ষ্মান্ড এবং সৃষ্ট জগতের দিকে ধাবিত হয় এবং আল্লাহর এ সৃষ্ট জগতের ব্যাপকতা ও রহস্যময়তা প্রতিনিয়ত তাকে স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত করে তোলে। এ চিন্তা-চেতনাই তাকে মহান স্রষ্টার হুকুম-আহকাম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে, [শরীয়া’র মূল উৎস থেকে] বিভিন্ন হুকুম অনুসন্ধান করতে এবং তা অনুযায়ী তার জীবনের সমস্ত সমস্যা সমাধান করতে উৎসাহিত করে। আর এভাবেই, ইসলাম ব্যক্তি মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয় এবং সে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে, জেনেবুঝে ইসলাম দিয়ে তার জীবন পরিচালনা করে।

২. ইসলাম মুসলিমদের জ্ঞানাজর্ন করা এবং ইসলামের রীতি-নীতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত থাকাকে বাধ্যতামূলক করেছে। তাই, ইসলামকে পরিপূর্ণ ভাবে জানা ও বোঝার জন্য শুধু মুখে দুই কালেমা উচ্চারণ করা যথেষ্ট নয়। বরং, একজন মুসলিমের উচিত ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞানার্জন করা। মানুষ, মহাবিশ্ব ও জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইসলামের আলোকে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী করা এবং ইসলাম এদের মধ্যকার পারস্পারিক সম্পর্ক কিভাবে নির্ধারণ করেছে সে ব্যাপারে অনুসন্ধান করা মুসলিমদের দায়িত্ব। কারণ, এসব বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান মানুষের চিন্তার জগতকে বিস্তৃত ও প্রসারিত করে, তার ধ্যান-ধারণাকে স্বচ্ছ করে এবং সর্বোপরি প্রতিনিয়ত তার মনমানষিকতাকে উন্নত করে – যা তাকে অন্যদের শিক্ষককে পরিণত করে।

৩. বস্তুতঃ ইসলামী জীবনাদর্শ এবং এর শরীয়াহ’র প্রকৃতি হল, এ সম্পর্কিত জ্ঞানকে ধাপে ধাপে ও ক্রমান্বয়ে অর্জন করার প্রয়োজন হয়। এটি একজন মুসলিমকে সে যে সমাজে বসবাস করে সেখান থেকে জ্ঞানার্জন করার পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার শিক্ষা দেয়। মুসলিমরা সবসময় বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যেই ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেছে। একারনেই মুসলিমরা প্রচন্ড উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেছে। ইসলামী আকীদাহ্ তাদের অন্তর ও হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে যাবার কারনে তাদের ছিল চতুর্দিক পরিবেষ্টনকারী ধ্যান-ধারণা এবং সেইসাথে ছিল সমৃদ্ধ ও দিগন্ত বিস্তৃত জ্ঞানভান্ডার। এছাড়া, মুসলিমরা সাধারনত কোন বিষয় সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা ও চিন্তাভাবনা করার পরই সে ব্যাপারে ইসলামের হুকুম-আহকাম কি হবে সে সিদ্ধান্ত গ্রহন করতো। কারণ, এ ক্ষেত্রেও ইসলামকে বাস্তব ভাবে প্রয়োগ করাই মূল বিষয় হিসাবে বিবেচিত হত।

প্রকৃতঅর্থে, মুসলিমরা শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জন করার খাতিরে কখনো ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা কিংবা চিন্তাভাবনা করেনি। কারণ, এক্ষেত্রে এই জ্ঞানসাধনা তাদেরকে শুধু ইসলামের হুকুম-আহকাম বা চিন্তাচেতনায় পরিপূর্ণ জীবন্ত এক লাইব্রেরী বা বইতে পরিণত করতো, যার কোন বাস্তব প্রয়োগ থাকতো না। এই ধরনের জ্ঞানসাধনা তাদেরকে জ্ঞানের এমন এক ধারকে পরিণত করতো, যা তাদের কার্যকলাপ ও জীবনাচরণকে প্রভাবিত করতো না এবং লব্ধ সে জ্ঞানের আলোকে সমাজ পরিবর্তন করার কাজেও উদ্ধুদ্ধ করতো না। অর্জিত এই জ্ঞান সঞ্চিত জলাধারের মতো সমাজে কোন প্রভাব না ফেলেই একসময় শুকিয়ে যেত। এছাড়া, মুসলিমরা ইসলামকে শুধুমাত্র কিছু উপদেশাবলীর সমষ্টি হিসাবেও গ্রহন করেনি। কারণ, তা হলে, ইসলামী আদর্শ তাদেরকে সংকীর্ণ চিন্তাচেতনার ব্যক্তিবর্গে পরিণত করতো, যার ফলে তারা বিশ্বাসের সাথে তাদের দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপের সম্পর্ক স্থাপন করতে ব্যর্থ হতো। মুসলিমরা খুব সতর্কভাবে বিপদজনক এই দুটি পথকে পরিহার করেছে; একটি হল, শুধুমাত্র জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা করা। আর, অন্যটি হল, ইসলামকে শুধু কিছু উপদেশাবলীর সমষ্টি হিসাবে গ্রহন করা। বস্তুতঃ ইসলামের নির্ধারিত পথেই মুসলিমরা ইসলাম ও এর হুকুম-আহকাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেছে। আর, তা হল আলোকিত চিন্তার মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই অর্জিত জ্ঞানকে বাস্তব ভাবে প্রয়োগ করা।

৪. ইসলাম প্রগতিশীল আদর্শ। এ আদর্শ সবসময়ই মুসলিমদেরকে নতুন নতুন উচ্চতার দিকে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে পরিপূর্ণতা অর্জনের আলোকিত এক পথের উপর প্রতিষ্ঠিত করে। বস্তুতঃ ইসলাম মুসলিমদেরকে বাস্তব জীবনে কিছু কাজ করতে বাধ্য করে। আর এ সমস্ত কার্যাবলী মুসলিমদেরকে ধীরে ধীরে এমন এক পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায় যেখানে তারা আধ্যাত্মিক উচ্চতা, মানসিক শান্তি এবং সত্যিকারের সুখকে অনুভব করতে পারে। মানুষ যখন এ উচ্চতায় পৌঁছে যায়, তখন সে সেখানেই অবস্থান করতে চায়। সে অবস্থান থেকে পতিত হতে চায় না। কিন্তু, বাস্তবতা হলো, পরিপূর্ণতার এ রকম এক উচ্চতায় পৌঁছানো যত না কঠিন, সে অবস্থানকে ধরে রাখা তার চাইতেও কঠিন কাজ। এজন্য, মুসলিমদেরকে তাদের কাজের ব্যাপারে হতে হবে দৃঢ় প্রত্যয়ী, সংকল্পবদ্ধ ও চিন্তাশীল। এ সমস্ত গুনাবলীর মাধ্যমেই মুসলিমরা তাদের অর্জিত উচ্চতা ও প্রগতিকে ধরে রাখতে পারবে।

মুসলিমদের করণীয় এই সমস্ত কার্যাবলী আসলে সামগ্রিক ইবাদতের সমষ্টি; যাদের মধ্যে কিছু অবশ্য পালনীয় [ফরজ], আর কিছু আনুসাঙ্গিক। সমগ্র মুসলিমের জন্য অবশ্যপালনীয় এ ফরজ কর্তব্যগুলো স্বাভাবিকভাবেই সমগ্র জাতিকে প্রগতির সাধারণ এক উচ্চতায় নিয়ে আসতে সহায়তা করে। আর, অবশ্যপালনীয় কর্তব্য ছাড়া অন্যসব কাজগুলো প্রতিনিয়ত মানুষকে পরিপূর্ণতা অর্জন করতে উৎসাহিত করে।

ইবাদত হিসাবে করণীয় এই সমস্ত কাজগুলো আসলে দুরূহ বা ভয়াবহ কোন দায়িত্ব নয়। কিংবা, নয় ক্লান্তিকর বা দমবন্ধকরা কোন অনাকাঙ্খিত অভিজ্ঞতা। এ সমস্ত কার্যাবলী মানুষকে তার জীবনের স্বাভাবিক আনন্দ, উচ্ছাস কিংবা প্রাণ চঞ্চলতা থেকেও বঞ্চিত করে না। না মানব প্রকৃতিকে অস্বীকার করে তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগত চাহিদাগুলোকে দমিয়ে রাখে। আসলে, ইবাদত হিসাবে করণীয় এই সমস্ত কর্তব্যগুলো, বিশেষ করে বাধ্যতামূলক কর্তব্যগুলো পালন করা যে কারও জন্য খুবই সহজ একটি ব্যাপার এবং প্রতিটি মানুষের পক্ষে তা পালন করা সম্ভব। এই ইবাদতগুলো মানুষকে তার জীবন উপভোগ করার পথেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। বস্তুতঃ অবশ্য পালনীয় ইবাদতগুলো ছাড়া, আনুসাঙ্গিক অন্যান্য মানদুব ইবাদতগুলো [যে সমস্ত কাজ করার জন্য মুসলিমদের উৎসাহিত করা হয়েছে] মুসলিমরা প্রচন্ড উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে পালন করে। কারণ, তারা জানে এই সমস্ত কাজের মাধ্যমেই তারা আল্লাহ’র সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে।

৫. অতীতের মুসলিমরা দ্বীন ইসলামের আলোকিত বাণীকে সমস্ত বিশ্বে ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যেই অন্যান্য দেশ জয় করেছে। এজন্য তারা বিশ্বাস করতো যে, তারা এমন এক বাহিনী যাদের অন্তর মহানুভবতা ও হেদায়েতে পরিপূর্ণ। মুসলিমরা যখন কোন দেশ জয় করতো, তখন সে দেশকে ইসলাম দিয়েই শাসন করতো। আর, কোন জনগোষ্ঠী ইসলাম গ্রহন করার সাথে সাথেই তারা মুসলিমদের মতোই সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করতো এবং সেইসাথে, মুসলিমদের জন্য যা যা অবশ্যপালনীয় তারা সে সমস্ত কার্যাবলীও পালন করতে বাধ্য থাকতো। বিজিত নতুন ভূখন্ড ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনস্থ অন্যান্য অঞ্চলের মতোই সমান অধিকার ও মর্যাদা উপভোগ করতো এবং ইসলামী রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বিবেচিত হত। কারণ, ইসলামী শাসনব্যবস্থা ঐক্য ও সমতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এ কারণেই, বিজিত ভূমির জনগোষ্ঠী কখনো অনুভব করেনি যে, তারা দখলদারিত্ব কিংবা আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। না তারা ঔপনিবেশিকতার কোন চিহ্ন কোনদিন প্রত্যক্ষ করেছে। সুতরাং, এটা বিস্ময়কর নয় যে, ইসলামের বাস্তব প্রয়োগকে স্বচক্ষে অবলোকন করার পর বিজিত জনগোষ্ঠীর মানুষেরা স্বেচ্ছায় দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে এসেছে।

৬. ইসলামের জীবনাদর্শ এবং হুকুম-আহকাম সম্পর্কিত জ্ঞান কোন বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য নির্দিষ্ট নয়। বরং, এটা সকলের জন্য উম্মুক্ত একটি বিষয়। প্রকৃত অর্থে, বিজিত ভূমির জনগোষ্ঠীকে ইসলামের আকীদাহ্ ও হুকুম-আহকাম সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক, যেন তারা ইসলামী আকীদাহ্ ও জীবনাদর্শের প্রকৃত সৌন্দর্য ও প্রকৃতিকে গভীর ভাবে অনুভব করতে পারে। আল্লাহর রাসূল (সা) ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনস্থ অঞ্চলগুলোর জনগোষ্ঠীকে ইসলাম দিয়ে শাসন করার লক্ষ্যে সে অঞ্চলে গভর্নর ও বিচারক নিয়োগ করতেন এবং মানুষকে ইসলামের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে শিক্ষা দেবার জন্য শিক্ষক নিয়োগ করতেন। The Muslims who came after him (saw) conquered many countries and set up rulers and teachers who would teach the people fiqh and Qur’an. The people welcomed Islamic education with open arms until their culture became Islamic. This included those who chose not to embrace Islam.

৭. ইসলামী শরীয়াহ্ শ্বাশত ও সার্বজনীন এবং সেইসাথে এর রয়েছে মানবজীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান দেবার ক্ষমতা। এ কারণেই, মুসলিমদেরকে কখনও বিজিত অঞ্চলগুলোর আইন-কানুন সম্পর্কে গবেষনা করতে হয়নি। কিংবা, যে আইন-কানুন দিয়ে তারা জীবনের সব সমস্যার সমাধান করেছে (শরীয়াহ্ আইন), সে আইন-কানুনের সাথে বিজিত অঞ্চলগুলোতে বিদ্যমান আইন-কানুনের কোন রকম সমঝোতাও করতে হয়নি; না তারা এ সকল অঞ্চলে বিদ্যমান আইন হতে কোনরকম আইন গ্রহণ করেছে। কোন অঞ্চল বা দেশ জয় করার সাথে সাথেই তারা সেখানে প্রথমদিন থেকেই ইসলামী শাসনব্যবস্থা এবং শরীয়াহ্ আইনকে পুরোপুরি বা বাস্তবায়ন করেছে। ইসলামী শাসনব্যবস্থা বা শরীয়াহ্ আইন বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারা কোনরকম পর্যায়ক্রমিক পদক্ষেপও গ্রহণ করেনি। যেমনঃ এমন কখনও হয়নি যে, তারা বিজিত কোন অঞ্চলে ক, খ ও গ আইন বাস্তবায়ন করেছে, কিন্তু ঘ আইন বাস্তবায়ন করেনি। এই ভেবে যে, ঘ আইনের বাস্তবায়ন হয়তো সে অঞ্চলে ইসলামী শাসনব্যবস্থাকে বিতর্কিত হতে পারে, কিংবা ঘ আইনের বাস্তবায়ন মানুষকে ইসলাম বিমুখ করতে পারে; অথবা, এ আইন মেনে নেয়া জনগণের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর হতে পারে। বস্তুতঃ অতীতে ইসলামকে কখনই এরকম পর্যায়ক্রমিক ভাবে ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হয়নি। কিংবা, বিচ্ছিন্ন বা খন্ডিত আকারে এখানে সেখানে শরীয়াহ্ আইন প্রয়োগ করা হয়নি।

আসলে, ইসলামকে পরিপূর্ণ ভাবে প্রয়োগের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এমন কোন পরিস্থিতি মুসলিমরা কখনও সহ্য করেনি। তারা ইসলামের আহবানকে সমগ্র বিশ্বের দরবারে পৌঁছিয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই বিভিন্ন দেশ জয় করেছে এবং সেইসাথে ইসলামী শাসনব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ ভাবে বাস্তবায়ন করে বিজিত অঞ্চলগুলোর দূর্নীতিগ্রস্থ, ঘুনেধরা ও টলায়মান শাসনব্যবস্থাকে সম্পূর্ন ভাবে বদলে দিয়েছে। এ কাজ করতে গিয়ে তাদের পুরনো ব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটিত করতে হয়েছে এবং সম্পূর্ন নতুন এক ব্যবস্থার দ্বারা সে ব্যবস্থাকে সামগ্রিক ভাবে প্রতিস্থাপন করতে হয়েছে। এ কারণেই বিজিত নতুন নতুন অঞ্চলের জনগণকে প্রথমদিন থেকেই শাসন করা মুসলিমদের জন্য ছিল খুব সহজ একটি ব্যাপার। আর, এ কারণে বিজিত এ অঞ্চলগুলোতে ইসলামী শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ন ও দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শাসন করতে গিয়ে মুসলিমরা কখনও কোন আইনপ্রণয়ন সংক্রান্ত জটিলতার সম্মুখীন হয়নি কিংবা, কুফর ও ইসলামী শাসনব্যবস্থার মাঝামাঝি কোন পর্যায়ও অতিক্রম করেনি। তাদের আহবান ছিল সুষ্পষ্ট; আর এর ভিত্তি ছিল ইসলামী আকীদাহ্। তাদের শাসনব্যবস্থা, আইন-কানুন ও সমস্ত বিধিবিধান এ আকীদাহ্ থেকেই উৎসারিত হয়েছিল। বস্তুতঃ মুসলিমদের প্রণীত আইন-কানুন ছিল শরীয়াহ্ আইন, যা যে কোন মানবগোষ্ঠীর জন্য, যে কোন স্থানে এবং যে কোন সময়ে প্রযোজ্য।

Leave a Reply