[নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘আদ-দাওলাতুল ইসলামীয়্যাহ’ (ইসলামী রাষ্ট্র) বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে নেয়া হয়েছে]
মুসলিম উম্মাহর পার্থিব জীবনের মূল উদ্দেশ্য হলো সমস্ত মানবজাতির কাছে ইসলামের সুমহান বাণী পৌঁছে দেয়া। এ লক্ষ্যে, মুসলিম উম্মাহকে সবসময়ই বিশ্বের কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হয়েছে। আর, ইসলামের বাণী প্রচার-প্রসারের গুরুদায়িত্ব সবসময় ইসলামী রাষ্ট্রের কাঁধেই অর্পিত হয়েছে। তাই, অন্যান্য দেশ জয় করা এবং অত্যন্ত সফলতার সাথে লক্ষ্য অর্জন করা ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। প্রকৃতপক্ষে, ইসলাম নির্ধারিত দায়িত্ব-কর্তব্যকে সঠিক ভাবে পালন করার কারণেই অতীতে মুসলিমদের বিজয়ের ধারা অব্যাহত ছিল। আর, এ দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করার অর্থ হলো, ইসলামী আইন-কানুনকে অমুসলিমদের উপর প্রয়োগ করে এবং ইসলামী ধ্যান-ধারনাগুলোকে ব্যাখ্যা করে তাদের কাছে এমন ভাবে ইসলামকে পৌঁছে দেয়া যেন ইসলাম তাদের চিন্তার জগতে বিচরণ করতে পারে।
এজন্য, ইসলামের বিজয় অভিযান না পরিচালিত হয়েছে কোন হীন স্বার্থ সিদ্ধি লক্ষ্যে বা কোন জনগোষ্ঠিকে কলোনীতে পরিণত করার উদ্দেশ্যে, আর না তা পরিচালিত হয়েছে কোন বিশেষ এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ করতলগত করার উদ্দেশ্যে। এ সমস্ত বিজয়যাত্রার এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের মহান বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং সেইসাথে তারা যে দুর্নীতিগ্রস্থ শাসনের অধীনে দুঃসহ জীবনযাপন করছিল তা থেকে তাদের মুক্ত করা।
বস্তুতঃ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খুবই শক্তিশালী ভিত্তির উপর। যে কারণে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ রাষ্ট্র অবলোকন করেছে এর সমৃদ্ধি এবং বিস্তৃতি, বিভিন্ন দেশ জয় করেছে এবং প্রতিনিয়ত এর সীমানাকে বৃদ্ধি করেছে। যেহেতু এ রাষ্ট্রের আকীদাহ্ বা বিশ্বাস সার্বজনীন, তাই এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূলেই নিহিত রয়েছে এর সার্বজনীন রাষ্ট্রে পরিণত হবার মূলমন্ত্র এ আকীদাহ্ সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত আকীদাহ্ যা থেকে উৎসরিত হয়েছে বিশ্বকেন্দ্রিক এক ব্যবস্থা এবং এ ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা হয়েছে বিশ্বের সকল মানুষের জন্য।
যে জন্য প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর ক্রমশঃ বিস্তৃতি ঘটা এবং একের পর এক দেশকে জয় করা ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রকৃতপক্ষে, এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল কারণই এ বিষয়গুলোকে অবধারিত করে তুলেছিল। রাসূল (সা) আকাবার দ্বিতীয় শপথের সময় যে সকল মুসলিমের কাছ থেকে বাই’য়াত গ্রহন করেছিলেন তারা সকলেই আল্লাহর রাসুলের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন, যদিও এ যুদ্ধে তাদের ধন-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয় কিংবা তাদের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের মৃত্যু ঘটে। তারা সুখ এবং দুঃখ উভয় অবস্থাতেই আল্লাহর রাসূল (সা)-এর পরিপূর্ণ আনুগত্য করার শপথ নিয়েছিলেন এবং সর্বাবস্থায় সত্য কথা বলার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তারা এটাও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তারা কারও অসন্তুষ্টির ভয়ে ভীত হবে না এবং ইসলামী দাওয়াতকে রক্ষার জন্য নিজেদের জীবন বাজি রেখে আমৃত্যু লড়াই করবে। আর, এ একনিষ্ঠ আনুগত্যের পুরস্কার হিসাবে তারা পাবে চিরসবুজ জান্নাত। প্রকৃতঅর্থে, ইসলামী রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী প্রস্তুতির মূলে এ বিষয়গুলোই সবসময় মূলমন্ত্র হিসাবে কাজ করেছে। মুসলিমদের সবসময়ই মনে রাখতে হবে, কোন কারণে ইসলামী রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী প্রস্তুত করা হয়েছে? তাদের মূল কাজ কি? সেনাবাহিনী প্রস্তুতির মূল উদ্দেশ্য কি শুধুই ইসলামের দাওয়াত বহন করা নয়? এ উদ্দেশ্যেই কি মুসলিমরা সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়নি, আনুগত্যের শপথ করেনি এবং প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়নি?
আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত একের পর এক অভিযানের পরিকল্পনা করেন। সমগ্র আরব উপদ্বীপকে ইসলামের পতাকাতলে নিয়ে আসার পর তিনি (সা) কায়সার এবং খসরুর কাছে তাঁর দূত প্রেরণ করেন। আরব উপদ্বীপের বাইরে ইসলামের আহবানকে ছড়িয়ে দেয়াও তাঁর দাওয়াতী পরিকল্পনার একটা অংশ ছিল এবং হিজরী ৭ম সালে তিনি (সা) এ কাজ শুরু করেন। এছাড়া, তিনি (সা) ইসলামী রাষ্ট্রের আশেপাশের বিভিন্ন রাজা ও রাজপুত্রদের কাছে দূত পাঠান, তাদের সকলকে ইসলামের দিকে আহবান করেন। মু’তা এবং তাবুকের যুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রেরণ এবং উসামার সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করা তাঁর এ সমস্ত পরিকল্পনারই বাস্তব প্রতিফলন। তাঁর উত্তরসূরী খলিফাগণ রাষ্ট্রের শাসক হিসাবে তাঁর গৃহীত পরিকল্পনার অনুসরণ করেছেন এবং যে সমস্ত দেশে দূত পাঠিয়ে তিনি (সা) মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করেছিলেন, খলিফাগণ সে সমস্ত দেশ জয় করে প্রকৃতঅর্থে তাঁর পরিকল্পনাকেই বাস্তবায়ন করেছে।
পরবর্তীতে, খুব শীঘ্রই একই পদ্ধতি ও মূলনীতি অনুসরণ করে নতুন নতুন বিজয় অভিযানের প্রস্তুতি নেয়া হয়। রাসূল (সা) এর মূলনীতি অনুসরণ করার কারণে ইসলামী রাষ্ট্র দেশ জয়ের ব্যাপারে কখনো বিশেষ কোন পছন্দকে প্রাধান্য দেয়নি। কিংবা, এ কাজ কতোটা সহজ বা কতোটা কঠিন এ বিষয়েও মুসলিমরা কখনো চিন্তা-ভাবনা করেনি। যদিও মিশর জয় করা মুসলিমদের জন্য তুলনামূলক ভাবে সহজ ছিল এবং দারিদ্রপীড়িত উত্তর আফ্রিকার রুক্ষ মরুময় প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে সে অঞ্চলে যথেষ্ট পরিমাণ ধনসম্পদও ছিল, কিন্তু, তারপরেও এ সমস্ত কোন বিষয়ই কখনো মুসলিমরা বিবেচনা করেনি। কারণ, তাদের বিভিন্ন দেশজয়ের পেছনের একমাত্র কারণ ছিল ইসলামের বাণীকে সে সমস্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়া। মূলতঃ এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই মুসলিমরা প্রাচূর্যমন্ডিত কিংবা প্রাচূর্যহীন সকল রাষ্ট্রকেই মুক্ত করেছে। অথবা, কোন দেশের জনগণ যখন বিজয়ের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে বাঁধাকেও তারা অবলীলায় অপসারণ করেছে। এ কারণেই বিভিন্ন দেশে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়ার পেছনে সে দেশে ধনসম্পদের উপস্থিতি কিংবা তাদের দারিদ্রপীড়িত অবস্থা কখনো মূল বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়নি। কিংবা, কোন জনগোষ্ঠির ইসলাম গ্রহন করা বা প্রত্যাখান করাও ইসলামের বাণী বহন করার পথকে রুদ্ধ করতে পারেনি। প্রকৃতঅর্থে, মুসলিমদের বিভিন্ন দেশজয় করার মূলকারণই ছিল ইসলামের আহবানকে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করা এবং সেইসাথে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা। কারণ, ইসলামের এই বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব থেকেই উৎসরিত হয়েছে এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা এই পৃথিবীর প্রতিটি দেশে, প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া জরুরী।
পবিত্র কোরআনে পরিস্কার ভাবে জিহাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং এর বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। একই সাথে, কোরআনে এ বিষয়েও জোর দেয়া হয়েছে যে, জিহাদ একমাত্র ইসলাম অনুমোদিত পদ্ধতি অনুসারেই হতে হবে এবং একমাত্র ইসলামের আহবান বিস্তৃতির লক্ষ্যেই হতে হবে। এ ব্যাপারে শক্তিশালী আয়াত নাযিল করে আল্লাহতায়ালা মুসলিমদের তাঁর পথে জিহাদের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহতায়ালা সুরা আনফালে বলেছেন,
“এবং তোমরা তাদের সাথে ততক্ষন পর্যন্ত যুদ্ধ কর যতক্ষন পর্যন্ত না (পৃথিবী থেকে) ফিতনা দূরীভূত হয় এবং দ্বীন কেবল আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট হয়।” [সুরা আল-আনফালঃ ৩৯]
তিনি সুরা বাকারায় বলেছেন,
“এবং তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ কর যতক্ষন পর্যন্ত না ফিতনা দূরীভূত হয় এবং দ্বীন কেবল আল্লাহ’র জন্যই নির্দিষ্ট হয়। অতঃপর যদি তারা নিবৃত হয়, তবে অত্যাচারী ব্যতীত আর কারো সাথে শত্রুতা নেই।” [সুরা বাকারাহ্ঃ ১৯৩]
আল্লাহতায়ালা সুরা তওবাতে বলেছেন,
“যুদ্ধ কর তাদের সাথে যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনে না, আর না ঈমান আনে কিয়ামত দিবসের উপর, না তারা নিষেধ করে তা হতে যা থেকে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল নিষেধ করেছেন এবং তাদের সাথে যারা আহলে কিতাবদের মধ্য হতে সত্যদ্বীনকে স্বীকৃতি দেয় না, যে পর্যন্ত না তারা স্বতঃস্ফুর্ত আনুগত্যের সাথে জিযিয়া প্রদানে সম্মত হয়।” [সুরা তওবাঃ ২৯]
অন্যান্য অনেক আয়াতের সাথে এই আয়াতগুলোও মুসলিমদের জিহাদ করার নির্দেশ দিয়েছে এবং জিহাদের মূল উদ্দেশ্য কি হবে তার ইঙ্গিতও এখানে দেয়া হয়েছে। মূলতঃ এ ধরনের আয়াতগুলোই সবসময় মুসলিমদের অন্যান্য দেশ জয় করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, দ্বীন ইসলাম প্রচারের ভিত্তিতেই মূলতঃ ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছিল এবং এ উদ্দেশ্যেই শক্তিশালী মুসলিম সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছিল। তাই একথা অস্বীকার্য যে, জিহাদ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত একটি বিষয় এবং এর মাধ্যমেই মুসলিমরা বিভিন্ন দেশে বিজয় পতাকা উত্তোলন করেছিল। ইসলামের দাওয়াত বহনের এই গুরুদায়িত্ব আবারও মুসলিমদেরকে ইসলামী রাষ্ট্র ফিরিয়ে দেবে।