ইসলামী রাষ্ট্র – পর্ব ৩৪ (ইসলামী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি)

[নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘আদ-দাওলাতুল ইসলামীয়্যাহ’ (ইসলামী রাষ্ট্র) বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে নেয়া হয়েছে]

ইসলামী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বলতে মূলতঃ বুঝায় এ রাষ্ট্রের সাথে অন্যান্য রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক। এ সম্পর্ক মুসলিম উম্মাহর পররাষ্ট্র বিষয়ক কার্যাবলী দেখাশুনা করার ভিত্তিতেই গড়ে উঠে। বস্তুতঃ ইসলামী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি একটি স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয় ভিত্তির উপর গঠিত। আর তা হলো, সমগ্র পৃথিবীতে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেয়া এবং সকল জাতি ও সমাজের কাছে ইসলামের সুমহান বাণী পৌঁছে দেয়া। এটাই হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি। মুসলিম উম্মাহ্‌কে যেই শাসন করুক না কেন, এই ভিত্তি অপরিবর্তনীয় এবং এ ব্যাপারে কোনরকম মতপার্থক্য করার কোন অবকাশ ইসলামে নেই। ইসলামের ইতিহাসের সকল সময়ে এই নীতিকেই মূলভিত্তি হিসাবে ধরা হয়েছে এবং আল্লাহর রাসূল (সা) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করার সময় থেকে উসমানী খিলাফতের শেষদিন পর্যন্ত পররাষ্ট্রনীতির এই মূল ভিত্তিকেই অনুসরণ করা হয়েছে।

আল্লাহর রাসূল (সা) মদীনায় হিজরত করার প্রথম দিন থেকেই ইসলামকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে তাঁর নবগঠিত রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিমালা প্রস্তুত করেন। সমগ্র হিজাযে ইসলামকে ছড়িয়ে দেয়ার মানসে তিনি (সা) ইহুদীদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এছাড়া, সমস্ত আরব উপদ্বীপে ইসলামের আহবান পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে তিনি (সা) কুরাইশদের সাথে হুদাইবিয়া চুক্তি করেন। পরিশেষে, তিনি (সা) আরব উপদ্বীপের বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে দূত পাঠিয়ে তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করেন এবং ইসলামের বাণী প্রচারের ভিত্তিতেই তাদের সাথে সম্পর্ক তৈরীর উদ্যোগ নেন।

এরপরে আশে খলীফাদের যুগ। রাসূল (সা)-কে অনুসরণ করে তারাও ইসলাম প্রচারের ভিত্তিতেই অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক গঠন করেন এবং সমস্ত পৃথিবীব্যাপী ইসলাম প্রচারের ধারাকে অব্যাহত রাখেন। পরবর্তীতে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন-ক্ষমতায় আসা প্রতিটি শাসকই ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে একে অন্যের সাথে প্রতিযোগীতায় অবতীর্ন হয়েছেন। আব্বাসীয় খলিফাগণের চাইতে উমাইয়া খলিফাগণ নতুন দেশ জয় করা এবং ইসলামের আহবান বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশী সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। আবার, মামলুকদের চাইতে উসমানী খলিফাগণ অনেক বেশী সংখ্যক দেশ জয় করেছেন এবং ইসলামের বাণীর প্রচার-প্রসার ঘটিয়েছেন। এ পার্থক্য মূলতঃ কোন শাসনামলে রাষ্ট্র তার অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় পররাষ্ট্র নীতিকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছে, তার উপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হয়েছে। যাইহোক, সব শাসনামলেই দ্বীন ইসলাম প্রচারকে মূলভিত্তি হিসাবে ধরেই ইসলামী রাষ্ট্র অন্যান্য সকল রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক তৈরী করেছে। খলিফাগণের শাসনামলের সুদীর্ঘ সময়ে কখনই এ অবস্থা পরিবর্তিত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ইসলামকে পরিপূর্ণ ভাবে বাস্তবায়ন করা এবং বহির্বিশ্ব ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়াই হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের মূলদায়িত্ব। তাই, ইসলামকে বিশ্বব্যাপী প্রচার-প্রসারের দায়িত্ব সবসময় ইসলামী রাষ্ট্রের উপরই অর্পিত হয়েছে।

আল্লাহতায়ালা ইসলামের সুমহান বাণী সমগ্র মানবজাতির উদ্দেশ্যে নাযিল করেছেন, আর এ কারণেই ইসলামকে সুনির্দিষ্ট পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে প্রচার করা এবং এর আহবান সকলের কাছে পৌঁছে দেয়া সবসময় ইসলামী রাষ্ট্রের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন,

“এবং (হে মুহাম্মদ) আমি তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছি। কিন্তু, বেশীর ভাগ মানুষই তা জানে না।” [সুরা সাবাঃ২৮]

আল্লাহতায়ালা আরও বলেছেন,

“হে মানবজাতি! তোমাদের নিকট এসেছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে নসীহত (সদুপদেশ)” [সুরা ইউনুসঃ ৫৭]

তিনি আরও বলেছেন,

“বল, হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর রাসূল হিসাবে প্রেরিত হয়েছি।” [সুরা আ’রাফঃ ১৫৮]

এবং তিনি আরও বলেছেন,

“আর এই কোরআন আমার নিকট অহীর মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে যেন আমি তোমাদেরকে এবং যাদের নিকট এটা পৌঁছাবে তাদের সকলকে এর দ্বারা সতর্ক করতে পারি।” [সুরা আন’আমঃ ১৯]

এছাড়া তিনি বলেছেন,

“হে রাসূল (সা)! যা কিছু তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমার উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে, তুমি (মানুষকে) সবকিছু পৌঁছিয়ে দাও। আর যদি তুমি তা না করো তবে [ধরে নেয়া হবে] তুমি আল্লাহর বাণী মানুষকে পৌঁছিয়ে দাওনি।” [সুরা মায়িদাহ্ঃ ৬৭]

মুহাম্মদ (সা) তার জীবদ্দশায় এই বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তার মৃত্যুর পর মুসলিমরা অব্যাহত ভাবে এ দায়িত্ব পালন করেছে। আসলে, মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর রাসূল (সা) যে কাজ শুরু করে গিয়েছিলেন সে কাজেরই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। আর তাই, মুসলিমরা সবসময় রাসূল (সা)-এর প্রদত্ত শিক্ষাকে অনুসরণ করে ইসলাম প্রচার-প্রসারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর বিদায়ী ভাষণে (খুতবাহ্ আল-ওয়াদা) বলেছেন, “তোমরা যারা উপস্থিত তারা অনপুস্থিত লোকদের কাছে তা পৌঁছে দেবে। হয়তোবা অনুপস্থিত ব্যক্তি উপস্থিত ব্যক্তির চাইতে বেশী সতর্ক হবে।” তিনি (সা) আরও বলেছেন, “আল্লাহতায়ালা তার মুখ উজ্জ্বল করুক, যে আমার কথা শুনবে, তা বুঝবে এবং যেভাবে সে শুনেছে সেভাবেই মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে।”

এজন্যই রাসূল (সা)-এর জীবদ্দশায় এবং তাঁর উত্তরাধিকারী খলিফাদের সময়ে ইসলামের বাণীর প্রচার-প্রসার করাই সবসময় অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের সম্পর্কের মূলভিত্তি হিসাবে বিবেচিত হত। আর, কোরআন-সুন্নাহ্‌ এবং সাহাবাদের ঐক্যমত (ইজমা আস-সাহাবাহ) অনুযায়ী এটাই হচ্ছে আল্লাহতায়ালা’র সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট নির্দেশ।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইসলামী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বলতে আসলে বোঝায় ইসলামের আহবানকে বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেয়া। এই পররাষ্ট্রনীতি সবসময় একটি নির্দিষ্ট অপরিবর্তনীয় পদ্ধতিতে কার্যকর করা হয় – সেটা হচ্ছে জিহাদ। এখানে আলোচ্য বিষয় নয় কে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতায় আছে। বস্তুতঃ রাসূল (সা) মদীনায় রাষ্ট্র গঠন করার সময় থেকে একেবারে ইসলামী রাষ্ট্রের শেষদিন পর্যন্ত এ পদ্ধতি কখনও পরিবর্তিত হয়নি। আল্লাহর রাসূল (সা) ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করার পরপরই তাঁর সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেছিলেন এবং তিনি (সা) ইসলামী দাওয়াতের পথে বস্তুগত বাঁধা দূর করার লক্ষ্যে জিহাদের সূচনা করেছিলেন। যেহেতু কুরাইশরা দাওয়াতের পথে বস্তুগত বাঁধা তৈরী করেছিল, তাই তিনি (সা) সে বাঁধা দূর করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি (সা) (জিহাদের মাধ্যমে) কুরাইশদের অস্তিত্বকে সম্পূর্নভাবে নিশ্চিহ্ন করে দাওয়াতী কার্যক্রম বিস্তারের পথকে প্রশস্ত করেন। এরপর তিনি (সা) একের পর এক বাঁধা অপসারণ ও নিশ্চিহ্ন করতে থাকেন, যে পর্যন্ত ইসলামের আহবান সমস্ত আরব উপদ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর, ইসলামী রাষ্ট্র অন্যান্য জাতির মাঝে ইসলাম বিস্তৃত করার লক্ষ্যে তাদের দরজায় কড়া নাড়তে থাকে। কিন্তু, বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা সেখানকার মানুষের মাঝে ইসলাম বিস্তারের পথে বস্তুগত বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই, সেখানকার জনগণের কাছে ইসলামী দাওয়াত পৌঁছে দেবার জন্য বস্তুগত এই বাঁধা অপসারণ করা জরুরী হয়ে যায়। যেন তারা প্রত্যক্ষ ভাবে ইসলামের সুবিচার অবলোকন ও অনুভব করতে পারে এবং ইসলামের পতাকাতলে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনের সাক্ষী হতে পারে। এছাড়া, এর মাধ্যমে কোনরকম জোরজবরদস্তি কিংবা বলপ্রয়োগ ছাড়াই ইসলামী রাষ্ট্র মানুষকে একটি সত্যিকারের উন্নত জীবনের দিকে আহবান করতে পারে। ইসলামের আহবান প্রচার-প্রসার করার পদ্ধতি হিসাবে অতীতে সবসময়ই জিহাদের ধারা অব্যাহত ছিল। প্রকৃতপক্ষে, জিহাদের মাধ্যমেই ইসলামী রাষ্ট্র বিভিন্ন বাদশাহী ও রাষ্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সেখানকার জনগণকে ইসলামী শাসনের নীচে নিয়ে আসে। এভাবেই চারিদিকে ইসলামের আহবান ছড়িয়ে পড়ে এবং ইসলাম দিয়ে শাসিত হবার পর লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে। অতীতে ইসলামের পররাষ্ট্রনীতিকে জিহাদের মাধ্যমেই কার্যকরী করা হয়েছে, কোনসময়ই এ নীতি পরিবর্তিত হয়নি এবং ভবিষ্যতেও তা পরিবর্তিত হবে না।

মুসলিমদের জিহাদের মাধ্যমে মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করতে হলে হয় সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহন করতে হবে, অথবা অর্থ, মতামত কিংবা লেখালেখির মাধ্যমে যুদ্ধকে সমর্থন করতে হবে। মুসলিমদের জন্য এটি বাধ্যতামূলক- যা কোরআন ও হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত। নিয়মানুযায়ী ১. মুসলিমরা শত্রুপক্ষকে ইসলাম গ্রহনে কিংবা ২. জিযিয়া প্রদানের দিকে আহবান করা না পর্যন্ত কখনোই শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ সূচনা করতে পারবে না। এ বিষয়ে শরীয়াহ্ আইন হলো, যখন মুসলিমরা শত্রুপক্ষকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলবে তখন প্রথমে তাদেরকে ইসলাম গ্রহন করতে আহবান জানাতে হবে। যদি শত্রুপক্ষ ইসলাম গ্রহন করে, তবে তারা মুসলিম উম্মাহর অংশ হিসাবে বিবেচিত হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। আর, যদি তারা ইসলাম গ্রহনে অস্বীকৃতি জানায়, তবে তাদেরকে জিযিয়া প্রদান করতে বলা হবে। যদি তারা তা প্রদান করতে সম্মত হয়, তবে মুসলিমদের তাদের জান-মাল এবং ধন-সম্পদের নিরাপত্তা দিতে হবে এবং তাদের দেশ ইসলামী রাষ্ট্রের অংশ হিসাবে বিবেচিত হবে। ইসলামী রাষ্ট্রের অংশ হিসাবে মুসলিম নাগরিকদের মতোই তারা ন্যায়বিচার, সমতা, নিরাপত্তা এবং অভিভাবকত্ব বিষয়ক ও কল্যাণমূলক সকল সুবিধা ভোগ করবে। সেইসাথে তাদের মৌলিক সকল চাহিদা নিশ্চিত করা হবে। তবে, জিযিয়া প্রদানের সাথে সাথে তাদের ইসলামী রাষ্ট্র ও শাসনকর্তৃত্বেরও আনুগত্য স্বীকার করে নিতে হবে। আর, যদি তারা ইসলাম গ্রহন না করে কিংবা জিযিয়া প্রদানেও অস্বীকৃতি জানায়, তবে সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আইনসঙ্গত হবে।

সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে, কোন জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে ততক্ষন পর্যন্ত যুদ্ধ করা আইনসঙ্গত নয়, যতক্ষন পর্যন্ত না তাদের ইসলামের দিকে আহবান করা হয়। ইসলামের পন্ডিতবর্গ (Scholars) এ বিষয়ে জোর দিয়েছেন যে, যতক্ষন পর্যন্ত না কোন জাতিগোষ্ঠির কাছে ইসলামের আহবান না পৌঁছে, ততক্ষন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা আইনসঙ্গত নয়। সুতরাং, শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনার পূর্বে তাদের মাঝে ইসলামের ব্যাপারে জনমত গঠন করা এবং ইসলামের একটি সত্যিকার চিত্র তাদের কাছে উপস্থাপন করা উচিত। সেইসাথে, সেখানকার জনগণকে ইসলামী আইন-কানুনের সংস্পর্শে আসারও উদ্যোগ নেয়া উচিত যেন অমুসলিমরা অনুভব করতে পারে যে, ইসলাম তাদেরকে প্রকৃত মুক্তির দিকে আহবান করছে। ইসলামী রাষ্ট্র এ লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারে, যেমনঃ ইসলামের ধ্যান-ধারণাগুলোকে পরিস্কার ভাবে ব্যাখ্যা করা, অমুসলিমদের সামনে ইসলামের একটি জীবন্ত চিত্র ফুটিয়ে তোলা এবং ইসলামের পক্ষে বিভিন্ন রকম প্রচারণা চালানো ইত্যাদি। এ ধরণের কর্মকান্ডের মধ্যে ইসলামী রাষ্ট্রের শক্তি-সামর্থ্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রদর্শন করাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। বিভিন্ন সময়ে আল্লাহর রাসূল (সা) এ ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি (সা) কুফর রাষ্ট্রগুলোর কেন্দ্রস্থলে দূত পাঠিয়েছেন। একবার তিনি (সা) নাজদ্ এলাকায় ইসলামের বাণী পৌঁছে দেবার জন্য চল্লিশ জন সাহাবীকে প্রেরণ করেছিলেন। এছাড়া, তিনি (সা) তাবুক যুদ্ধে যাবার পূর্বে মদীনায় তাঁর সেনাবাহিনীর শক্তিমত্তা প্রদর্শন করেছিলেন। এর কারণ রাসূল (সা) বলেছেন, “একমাসের দূরত্ব থাকা অবস্থায় শত্রুর মনে ভীতি সৃষ্টির মাধ্যমে আমাকে বিজয়ের সংবাদ দেয়া হয়েছে।”

অতীতে মুসলিমদের সেনাবাহিনী সবসময়ই শত্রুপক্ষের ভীতি ও শ্রদ্ধা অর্জনে সমর্থ হয়েছে। শত শত বছর যাবত ইউরোপে একথা প্রচলিত ছিল যে, মুসলিম সেনাবাহিনীকে কখনোই পরাজিত করা যায় না। যাই হোক, রাজনৈতিক ভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করা আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, প্রত্যক্ষ সমর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগে ইসলামের ধ্যান-ধারণাগুলোকে প্রচার-প্রসার করা এবং ইসলামী রাষ্ট্রের শক্তিমত্তা প্রদর্শন বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলো গ্রহন করা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য জরুরী। যদিও ইসলামের বাণী প্রচারে জিহাদ একটি অপরিবর্তনীয় ও সুনির্দিষ্ট পন্থা, কিন্তু সামরিকবাহিনীর সাথে মূল সংঘর্ষের পূর্বে অন্যান্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কর্মকান্ডগুলো মূলতঃ প্রস্তুতিমূলক কর্মকান্ড এবং এগুলো নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরণের পদক্ষেপ সাধারনত অন্যান্য জাতি, রাষ্ট্র কিংবা জনগোষ্ঠির সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, হোক তা অর্থনৈতিক সম্পর্ক কিংবা সৎ প্রতিবেশীমূলক সম্পর্ক অথবা অন্য কোন ভিত্তির উপর গঠিত সম্পর্ক, যা হয়তো বা পরবর্তীতে ইসলাম প্রচার-প্রসারে সহায়ক হতে পারে।

সুতরাং, যে রাজনৈতিক চিন্তার উপর ভিত্তি করে অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারিত হয় তা মূলতঃ তাদের মাঝে ইসলামের বিস্তৃতি ঘটানো এবং ইসলামের বাণী তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার ভিত্তিতেই গঠিত। এক্ষেত্রে, অনুসরণীয় একমাত্র পদ্ধতি হল জিহাদ। তবে, এ ব্যাপারে ইসলামী রাষ্ট্র বিভিন্ন রকমের পরিকল্পনা ও উপায় অবলম্বন করতে পারে। যেমনঃ ইসলামী রাষ্ট্র তার কিছু সংখ্যক শত্রুরাষ্ট্রের সাথে সৎ প্রতিবেশীসুলভ চুক্তি স্বাক্ষর  করতে পারে এবং অন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে পারে। আল্লাহর রাসূল (সা) এ ধরনের পদ্ধতির অনুমোদন দিয়েছেন। তিনি (সা) মদীনায় আসার পরপরই এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করেছিলেন। আবার, রাষ্ট্র তার সমস্ত শত্রুর বিরুদ্ধে একই সাথে যুদ্ধ ঘোষনা করতে পারে। আবু বকর যখন ইরাক এবং আল-শামে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন তখন এ পদ্ধতি গ্রহন করেছিলেন। আবার, রাষ্ট্র তার আকাঙ্খিত ফলাফলের পক্ষে জনমত তৈরীর জন্য কোন শত্রুরাষ্ট্রের সাথে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তিও করতে পারে।

আল্লাহর রাসূল (সা) কুরাইশদের সাথে আল-হুদাইবিয়াহ চুক্তি স্বাক্ষর করার সময় এ পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। আবার, শত্রুপক্ষের মনে ভীতি সৃষ্টি করার লক্ষ্যে, রাষ্ট্র এলাকা ভিত্তিক খন্ড যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে পারে। আল্লাহর রাসূল (সা) বদর যুদ্ধের পূর্বে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করেছিলেন। আবার, উমাইয়া খলিফাদের শাসনামলে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা একই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করেছিলো, তাদের শীত ও গ্রীষ্মকালীন প্রচারনাও এ পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত ছিল।

দাওয়াতী কার্যক্রমের স্বার্থে, ইসলামী রাষ্ট্র একই সময়ে কোন কোন রাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে আবার কোন কোন রাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত নাও করতে পারে। প্রয়োজনে রাষ্ট্র কারো সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করতে পারে আবার নাও করতে পারে। দাওয়াতী কার্যক্রমকে অভিষ্ট গন্তব্যে নেবার লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে খুব সতর্কতার সাথে এ সমস্ত পরিকল্পনা করতে হবে। ইসলামের আহবানের বিস্তৃতির উদ্দেশ্যে ইসলামী  রাষ্ট্র [শত্রুর বিরুদ্ধে] প্রপাগান্ডা এবং [ইসলামের পক্ষে] প্রচার আশ্রয়ও নিতে পারে অথবা, শত্রুপক্ষের গোপন পরিকল্পনা উম্মোচন করা কিংবা স্নায়ু যুদ্ধের (Cold War) কৌশলও গ্রহন করতে পারে।

দাওয়াতী কার্যক্রমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং দাওয়াতকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই রাষ্ট্রকে তার সকল পরিকল্পনা করতে হবে। কারণ, এ ধরনের পরিকল্পনা সবসময়ই ইসলাম বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে এবং জিহাদের গুরুদায়িত্বকে সহজতর করেছে। এজন্যই এ সমস্ত পদক্ষেপ পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত জরুরী। এছাড়া, আল্লাহর রাস্তায় কৃত জিহাদের (জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্) মাধ্যমে ইসলামের বিস্তৃতি ঘটানোর লক্ষ্যে সর্বদা ইসলাম এবং ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে জনমত গঠন করাও জরুরী।

Leave a Reply