[নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘আদ-দাওলাতুল ইসলামীয়্যাহ’ (ইসলামী রাষ্ট্র) বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে নেয়া হয়েছে]
ইসলামী রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীন নীতিমালা বলতে মূলতঃ বুঝায় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ইসলামের হুকুম-আহ্কামকে বাস্তবায়িত করা। আল্লাহ্ প্রদত্ত এ সমস্ত হুকুম-আহ্কামকে ইসলামী রাষ্ট্র এর নিজস্ব ব্যবস্থার অধীনেই বাস্তবায়িত করতো। এ রাষ্ট্র জনগণের মাঝে বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক ও লেনদেন নির্ধারন ও দেখাশুনা করা, হুদুদ ও আল্লাহ্ প্রদত্ত শাস্তি সমূহ বাস্তবায়ন করা, সমাজের সর্বস্তরে উচ্চ মানের মূল্যবোধ বজায় রাখা, সমাজে ইসলামের বিভিন্ন রীতি-নীতি ও ইবাদতকে নিশ্চিত করা এবং সেইসাথে ইসলামী আইন-কানুনের ভিত্তিতে জনগণের সমস্ত বিষয়াদির তদারকি করতো। বস্তুতঃ ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে বসবাসরত মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের উপর আল্লাহ্ প্রদত্ত হুকুম-আহ্কামকে কিভাবে প্রয়োগ করা হবে ইসলামে তার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারিত রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র এ নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করেই এ সমস্ত হুকুম-আহ্কামকে জনগণের উপর প্রয়োগ করতো। এ পদ্ধতি হুকুম শরীয়াহ্ এবং নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য নির্ধারিত আহ্কামের সাথে সম্পর্কিত। কারণ, ইসলাম এসেছে সমগ্র মানবজাতির জন্য। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে সমগ্র মানবজাতিকে ইসলামের দিকে আহবান করেছেন। যেমন, তিনি বলেছেন,
“হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের সেই রবের দাসত্ব করো যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, আশা করা যায় যে, তোমরা মুত্তাকী (আল্লাহভীরু) হতে পারবে।” [সুরাঃ বাকারাহ্ঃ ২১]
তিনি আরও বলেছেন,
“হে মানুষ! কি তোমাকে তোমার মহান প্রতিপালক হতে প্রতারিত করলো?” [আল-ইনফিতরঃ ৬]
উসুল উল-ফিকহ্ (শরীয়াহর মূল উৎস) বিষয়ে পন্ডিত ব্যক্তিবর্গ বলেছেন যে, ইসলামী শরীয়াহ্ আসলে এ পৃথিবীর প্রতিটি সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন মানুষকে উদ্দেশ্য করেই নাযিল করা হয়েছে। হোক সে মুসলিম অথবা অমুসলিম। ইমাম গাজ্জালী তার “আল মুস্তাফা ফি আল-উসুল”বইতে বলেন, “শরীয়াহ্ আইন দিয়ে শাসিত ব্যক্তিকে আইন অনুযায়ী অবশ্যই একজন দায়িত্বশীল, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন ও আইনপ্রণেতার (আল্লাহতায়ালা) আহবান বোঝার যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হবে। বস্তুতঃ যে সকল গুনাবলীর জন্য একজন মানুষের উপর আল্লাহর হুকুম ফরজ হয়ে যায় তা হলো, তার এমন স্বভাবসুলভ মানবপ্রকৃতি যা দিয়ে সে আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধকে (পুরোপুরি) গ্রহন করতে ও মেনে চলতে পারে।”
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইসলাম আসলে সমস্ত মানবজাতিকেই আহবান করেছে। এ আহবান ইসলামের দিকে সমস্ত মানবজাতির উপর সাধারণ আহবান ও দায়িত্ব হিসাবে আরোপিত হয়েছে। সাধারণ আহবানের মাধ্যমে প্রথমে সমস্ত মানুষকে ইসলামে প্রবেশ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। পরবর্তীতে সমস্ত মানুষকে আল্লাহ্ প্রদত্ত সমস্ত হুকুম-আহ্কামের কাছে আত্মসমর্পণ করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। আর, যারা নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রের অধীনে বসবাস করে, ইসলামী রাষ্ট্র তাদের দল, মত, বিশ্বাস কিংবা সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলকে একটি দলবদ্ধ মানুষ হিসাবে বিবেচনা করে এবং সকলকে ইসলামী আইন-কানুন দিয়েই শাসন করে। প্রয়োজন হয় শুধু জনগণের ইসলামী রাষ্ট্র ও শাসন-ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলে এ রাষ্ট্রে কোনকিছু নেই। কারণ, এখানে সমস্ত মানুষকেই সাধারণ মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখা হয় এবং এদের প্রত্যেককেই ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যতোক্ষন পর্যন্ত তারা অর্পিত নাগরিক দায়িত্ব কর্তব্য মেনে চলে। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রে বসবাসরত প্রত্যেক ব্যক্তিই শরীয়াহ্ প্রদত্ত পূর্ণ নাগরিক অধিকার ভোগ করে, সে মুসলিমই হোক বা অমুসলিম হোক। আবার, মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও যদি কেউ ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক না হয়, তবে শরীয়াহ্ প্রদত্ত নাগরিক অধিকার তাকে প্রদান করা হবে না। ধরা যাক, (ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত) কোন মুসলিম ব্যক্তির মা খ্রিষ্টান এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক। আর, তার বাবা মুসলিম কিন্তু তার ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেই। সেক্ষেত্রে, সে ব্যক্তির মা সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পাবার অধিকারী হবে, কিন্তু বাবা নয়। মা যদি বিচারকের কাছে ভরণপোষণের ব্যাপারে অভিযোগ করে, তবে বিচারক তার পক্ষে রায় দেবে এবং সন্তানকে মায়ের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য করবে, কারণ এক্ষেত্রে উক্ত মহিলা ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে বিবেচিত হবে। কিন্তু, যদি সে ব্যক্তির বাবা অভিযোগ উত্থাপন করে, তবে বিচারক তার বিপক্ষে রায় প্রদান করবে। কারণ, সে ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক বলে বিবেচিত হবে না। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, শরীয়াহ্ শুধু ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকদের উপরই ইসলামী হুকুম-আহ্কাম বাস্তবায়িত করে এবং এক্ষেত্রে রাষ্ট্রে বসবাসরত সকল মানুষকে সাধারণ ভাবে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যার কারণে, তারা সকলেই নাগরিক হিসাবে শরীয়াহ্ প্রদত্ত অভিভাবকত্ব বিষয়ক কিংবা কল্যাণমূলক সকল অধিকার ভোগ করে থাকে।
এটা হচ্ছে শাসন ও অভিভাবকত্বের দৃষ্টিকোন থেকে নাগরিকের অবস্থান সম্পর্কিত বিষয়। আর, ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলামী হুকুম-আহ্কাম বাস্তবায়নের বিষয়টি কখনও ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচিত হয় না, বরং তা সর্ম্পূণ ভাবে আইনগত দৃষ্টিকোন থেকে দেখা হয়। তাই কোরআন-সুন্নাহর দলিলগুলোকে অবশ্যই আইনগত দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে হবে এর কারণ হচ্ছে, শরীয়াহ্ সম্পর্কিত দলিলগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের সমস্যার সমাধান করা। এক্ষেত্রে, আইনপ্রণেতা (আল্লাহতয়ালা)’র উদ্দেশ্য হলো মানুষ যেন শুধু আয়াতগুলোর বাহ্যিক অর্থের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে আয়াতগুলোর অর্থ ও বিষয়বস্তুকে পরিপূর্ণ ও যথাযথ ভাবে অনুধাবন করে। এজন্য, হুকুম শরীয়ার উপর ভিত্তি করে যে কোন আইন তৈরী করার ক্ষেত্রে সবসময়ই শরীয়াহ্ প্রদত্ত হুকুমের পেছনের কারণ(ইল্লাহ) কেও বিবেচনা করা হয়। অন্য কথায় বলা যায় যে, হুকুম শরীয়াহ ভিত্তিক কোন সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে সবসময়ই কোরআন-সুন্নাহর দলিলের আইনগত বিষয়টিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। যখন খলিফা (রাষ্ট্রপ্রধান) এই সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে গ্রহন করে, তখন রাষ্ট্রে সেটা আইনেই পরিণত হয় এবং সকলের জন্য সেই আইন মেনে চলা ও তা প্রয়োগ করা কর্তব্য হয়ে যায়।
সুতরাং, ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে বসবাসরত সকল নাগরিকের জন্য শরীয়াহ্ আইনের কাছে আত্মসর্মপণ করার বিষয়টি প্রমাণিত ও অপরিবর্তনীয়। আসলে, শরীয়াহ আইনের কাছে আত্মসমর্পণের বিষয়টি মুসলিমদের বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত বিষয়। কারণ, এ ব্যাপারে তারা আল্লাহতায়ালার কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ। ঈমান আনার অর্থই হলো আকীদাহ্ বা বিশ্বাস থেকে উৎসরিত সমস্ত হুকুম আহকামের কাছে নিঃশর্ত ভাবে আত্মসমর্পণ করা। এক্ষেত্রে মুসলিমদের আকীদাহ্ বা বিশ্বাস তাকে বাধ্য করে এ সমস্ত হুকুম-আহকাম পরিপূর্ণভাবে মেনে চলতে। প্রতিটি মুসলিম শরীয়াহ্ আইন দিয়ে জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহর কাছে ওয়াদাবদ্ধ, হোক তা তার সাথে আল্লাহর সম্পর্কের বিষয়ে, যেমনঃ বিভিন্ন ধরনের ইবাদত (নামাজ, রোজা ইত্যাদি)। কিংবা, হোক তা নিজের সাথে নিজের সম্পর্কের বিষয়ে, যেমনঃ মূল্যবোধ বা খাবার সম্পর্কিত বিষয়ে অথবা, হোক তা তার সাথে অন্য সকল মানুষের সম্পর্কের বিষয়ে, যেমনঃ লেনদেন কিংবা ক্ষতিপূরণ সম্পর্কিত বিষয়ে।
ইসলামী রাষ্ট্র সমস্ত মুসলিমকে ইসলামী আকীদাহ্ বা বিশ্বাস দিয়েই ঐক্যবদ্ধ রাখে এবং এক্ষেত্রে অবশ্যই কোরআন ও সুন্নাহর দলিলকেই হুকুম-শরীয়ার মূল ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়। হুকুম শরীয়ার মূলনীতি এবং আইনগত সকল সিদ্ধান্ত কোরআন-সুন্নাহর দলিলের উপর ভিত্তি করেই প্রণয়ন করা হয় এবং এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত প্রকাশের কোন অবকাশ থাকে না। কিন্তু, ইজতিহাদের কারণে অতীতের মুসলিমরা বিভিন্ন সময় কোরআন-সুন্নাহর দলিলকে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছে। মূলতঃ এ সমস্ত দলিলের(কোরআনের আয়াত ও রাসুলের হাদিস) ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার কারণেই বিভিন্ন ধরণের মতবাদ (School of Thought) ও সম্প্রদায়ের জন্ম হয়েছে। এর মূল কারণ হলো, ইসলাম সবসময়ই মুসলিমদের গবেষণা (ইজতিহাদ) করতে উৎসাহিত করে এবং সেইসাথে মানুষের মধ্যকার চিন্তাধারার স্বাভাবিক পার্থক্যকেও স্বীকার করে নেয়।
এজন্য সবসময়ই মুসলিমদের মাঝে আকীদাহ্, আইন-কানুন ও উসুল উল-ফিকহ্ এর পদ্ধতি বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। রাসূল (সা) সবসময়ই মুসলিমদের ইজতিহাদ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং বলেছেন যে, মুজতাহিদের (ইজতিহাদের যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি) ইজতিহাদ যদি ভূল হয় তবে তার জন্য রয়েছে একটি নেকী। আর, সঠিক হলে রয়েছে দু’টি নেকী। এ কারণে, সুন্নী, শিয়া’হ, মুতা’যিলাহ এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হওয়া কোন আশ্চর্য বিষয় ছিলো না। না আশ্চর্যের বিষয় ছিলো বিভিন্ন মতবাদের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন মাযহাব যেমনঃ শাফি’ঈ, হানাফি, মালিকি, হাম্বলী, জা’ফরী, যায়িদী ইত্যাদি মাযহাবের সৃষ্টি হওয়া। এ সমস্ত সম্প্রদায় এবং মাযহাবগুলো একটি মাত্র আকীদাহ্ বা বিশ্বাসকেই আকঁড়ে ধরেছিল, যা ছিলো ইসলামের আকীদাহ্। তাদের সকলের উপরই আল্লাহ্ নির্ধারিত সমস্ত ফরজ দায়িত্ব মেনে চলা এবং নিষিদ্ধ সকল বিষয়কে পরিহার করার কর্তব্য ছিলো। কোন নির্দিষ্ট মাযহাব নয়, তারা সকলেই সর্বাবস্থায় হুকুম-শরীয়াহ দিয়ে জীবন পরিচালনা করতেই বাধ্য ছিলো।
আসলে, মাযহাবগুলো হচ্ছে হুকুম-শরীয়ার একটি নির্দিষ্ট ধরনের ব্যাখ্যা, যে ব্যাখ্যা অনুযায়ী মুকাল্লিদগন (যারা মুজতাহিদ নয়), যারা নিজেরা ইজতিহাদ করতে পারে না, তারা হুকুম-শরীয়াহ্ অনুসরণ করে থাকে। এখানে মনে রাখা দরকার যে, মুসলিমরা শুধু আল্লাহ্ প্রদত্ত আইন-কানুন দিয়েই জীবন পরিচালনা করতে বাধ্য, কোন মাযহাব অনুসরণ করতে বাধ্য নয়। তাই, হয় তাকে হুকুম-শরীয়ার মূল উৎস থেকে নিজে ইজতিহাদ করে শরীয়াহ্ আইন মানতে হবে, অথবা, সে যদি নিজে ইজতিহাদ করতে অপারগ হয় তবে তাকে কোন মাযহাব অনুসরণ করতে হবে। এ কারণেই, যে সমস্ত সম্প্রদায় ও মাযহাব কোরআন ও সুন্নাহকে হুকুম-শরীয়ার একমাত্র উৎস গ্রহন করেছে এবং ইসলামী আকীদাহকে আকঁড়ে ধরেছে তারা সবাই ইসলামের অর্ন্তভূক্ত। এ সমস্ত মতবাদের প্রচারকবৃন্দও মুসলিম এবং তারা ইসলামী আইন-কানুন দিয়েই পরিচালিত। যতক্ষন পর্যন্ত এ সমস্ত মাযহাবের অনুসারীরা ইসলামী আকীদাহর সীমারেখার মধ্যে থাকবে ততক্ষন পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্র এ সমস্ত সম্প্রদায় ও মাযহাবের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু, যদি কোন মুসলিম ব্যক্তিগত কিংবা দলবদ্ধ ভাবে ইসলামী আকীদাহ্ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায় তবে, এ বিষয়টিকে ইরতিদাদ(ধর্মত্যাগ) হিসাবে বিবেচনা করা হবে এবং সে ব্যক্তি বা দলের উপর রাষ্ট্র কর্তৃক মুরতাদ(ধর্মত্যাগী) এর শাস্তি আরোপিত হবে। হুকুম-শরীয়ার কিছু কিছু বিষয় আছে যাতে দ্বিমত প্রকাশের কোন অবকাশ নেই। অর্থাৎ, এ সমস্ত বিষয়ে একটি মাত্র সুনির্দিষ্ট হুকুমকে গ্রহনযোগ্য হিসাবে ধরা হয়। যেমনঃ চোরের হাত কাটা, সুদ নিষিদ্ধ হওয়া, যাকাতের প্রদানের অপরিহার্যতা, দৈনিক পাঁচ বার নামাজের বাধ্যবাধকতা ইত্যাদি। এ সমস্ত বিষয়ে হুকুম-শরীয়াহ সুনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয়। তাই, মুসলিমরা এ সকল ক্ষেত্রে এই সুনির্দিষ্ট হুকুমগুলোই মেনে চলতে বাধ্য। আবার, হুকুম-শরীয়া’র কিছু কিছু বিষয় ও ধ্যান-ধারণা আছে যে সমস্ত বিষয় মুজতাহিদগণ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করার কারণে মুসলিমদের মধ্যে এ সমস্ত বিষয়ে মতপার্থক্য ঘটেছে। যেমনঃ খলিফা হবার পূর্বশর্ত কিংবা খারায আরোপিত ভূমির নির্ধারিত করের অংশ অথবা জমির ভাড়া প্রদান সম্পর্কিত বিষয় ইত্যাদি। এ সমস্ত আইনের ক্ষেত্রে, খলিফা একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে গ্রহন করেন এবং রাষ্ট্রে বসবাসরত সকলের জন্য সেই আইন মেনে চলা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। যারা এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে খলিফার সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত পোষন করে তাদের সকলের জন্যই তাদের নিজস্ব মতামত ত্যাগ করে খলিফার মতামতকে গ্রহন করা কর্তব্য হয়ে যায়। আর, এভাবেই খলিফার সিদ্ধান্ত সকলের মধ্যে বিদ্যমান মতপার্থক্য দূর করে। বস্তুতঃ ইমাম বা খলিফা হুকুম-শরীয়া’র কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের পর প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে সেই আইন মেনে চলা মুসলিমদের জন্য অবশ্য কর্তব্য হয়ে যায়। এ সিদ্ধান্তের বিপরীতে কেউ যদি সেই নির্দিষ্ট বিষয়ে অন্য কোন হুকুম অনুসরণ করে তবে সে গুনাহগার হবে। কারণ, খলিফা যখন কোন নির্দিষ্ট শরীয়া’হ আইন কার্যকরী করেন, সঙ্গে সঙ্গে তা সকল মুসলিমের জন্য মেনে চলা ফরজ হয়ে যায়। আর, কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে শরীয়া’হ আইন কারো জন্য কখনো একের অধিক হতে পারে না।
তবে, খলিফার জন্য আকীদাহ্ সম্পর্কিত বিষয়ে কোন হুকুমকে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া ঠিক নয়, কারণ তাহলে এটা মেনে চলা মুসলিমদের জন্য কষ্টকর হয়ে যেতে পারে। কিন্তু, ভ্রান্ত বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে যদি নতুন ধরনের ধ্যান-ধারণা আবির্ভাব হবার সম্ভাবনা থাকে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র এসব দুস্কৃতিকারীদের কঠোর হস্তে দমন করবে যতক্ষন পর্যন্ত না নতুন এইসব ধ্যান-ধারণা মুসলিমদের কুফরীর (অবিশ্বাস) দিকে ধাবিত না করে। কিন্তু, যদি এইসব ধ্যান-ধারণা মুসলিমদের কুফরীর (অবিশ্বাস) দিকে ধাবিত করে, তবে যারা এ ধরণের অপকর্মের সাথে জড়িত থাকবে রাষ্ট্র তাদের ধর্মত্যাগী হিসাবে বিবেচনা করবে। এছাড়া, খলিফার ইবাদত সম্পর্কিত বিষয়েও কোন নির্দিষ্ট হুকুম গ্রহন করা ঠিক নয়, কারণ এটাও মুসলিমদেরকে কষ্টকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেবে।
সুতরাং, আকীদাহ সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদের মধ্য হতে কোন নির্দিষ্ট মতামতকে গ্রহন করা খলিফার জন্য সঠিক নয়, যতক্ষন পর্যন্ত না এই সকল মতামত ইসলামী মতবাদ হিসাবে বিবেচিত হয়। আবার, যাকাত ব্যতীত ইবাদত সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রেও কোন মতবাদকে নির্দিষ্ট করে দেয়া খলিফার জন্য সঠিক নয়, যতক্ষন পর্যন্ত না ইবাদতের এই সমস্ত বিষয় শরীয়া’হ প্রদত্ত আইন-কানুনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ সকল বিষয় ছাড়া খলিফা লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয়, ভাড়া প্রদান, বিবাহ, তালাক, বিবাহ-বিচ্ছেদ পরবর্তী ভরণ-পোষণ, অংশীদারিত্ব ভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য, সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদি বিষয়ে হুকুম-শরীয়া’হ ভিত্তিক যে কোন আইনকে সকলের জন্য নির্দিষ্ট ও কার্যকরী করতে পারেন। এছাড়া, খলিফা শাস্তি প্রদান বা খাদ্য, বস্ত্র অথবা মূল্যবোধ সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে শরীয়া’হ ভিত্তিক যে কোন সুনির্দিষ্ট আইনকে কার্যকরী করতে পারেন এবং এক্ষেত্রে সকল মুসলিমের খলিফার গৃহীত সিদ্ধান্ত মেনে চলা আবশ্যক হয়ে যায়।
এছাড়া, খলিফাকে অবশ্যই ইবাদতের বিষয় সম্পর্কিত সকল শরীয়াহ্ আইন প্রয়োগ করতে হবে। যারা নামাজ ত্যাগ করবে এবং রমযান মাসে রোযা রাখবে না শরীয়াহ্ আইন অনুযায়ী খলিফা তাদেরকে শাস্তি দিবেন। এ সকল ইবাদত সম্পর্কিত আইন-কানুন সহ সমস্ত শরীয়াহ্ আইন রাষ্ট্রে বাস্তবায়িত বা প্রয়োগ করা খলিফার দায়িত্ব। নামাজ আদায় করার বাধ্যবাধকতা কোন ইজতিহাদ করার বিষয় নয়, বরং এটা যে সমস্ত মুসলিমের উপর ফরয তা একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। তাই, এ সমস্ত প্রতিষ্ঠিত বিষয়ে খলিফাকে শরীয়াহ্ আইন সরাসরি প্রয়োগ করতে হবে। এ সমস্ত বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা না করার কোন অবকাশ থাকবে না। শাস্তিমূলক বিধানের (Panel Code) ক্ষেত্রে খলিফা একটি নির্দিষ্ট আইন গ্রহন করবে এবং সকল মুসলিমকে তা মেনে চলার জন্য আদেশ দেয়া হবে। অন্যান্য শাস্তিমূলক বিধানের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার প্রযোজ্য হবে। এ সমস্ত কিছুই শুধু মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য হবে। আর, অমুসলিমদের ক্ষেত্রে, যারা কিনা ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন বিশ্বাসে বিশ্বাসী তাদেরকে তিন ভাগে ভাগ করা হবে।
১. যারা নিজেদের মুসলিম বলে দাবী করে কিন্তু তাদের আকীদাহর মধ্যে এমন কিছু বিষয় আছে যা ইসলামী আকীদাহর সাথে সাংঘর্ষিক।
২. আহলে কিতাবের দলভূক্ত মানুষ।
৩. মুশরিক যাদের মধ্যে রয়েছে- মাজুস (অগ্নিপূজারী), হিন্দু, বৌদ্ধ এবং আহলে কিতাব বহির্ভূত জনগণ।
এ সকল দলভূক্ত মানুষদের তাদের বিশ্বাসের উপরই ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস বা উপাসনার ব্যাপারে কোনরকম হস্তক্ষেপ করা হবে না। বিবাহ কিংবা তালাক সংক্রান্ত বিষয়ে তাদেরকে নিজ নিজ ধর্মীয় আইন-কানুন মেনে চলতে দেয়া হবে। এ সকল বিষয়ে ঝগড়া-বিবাদ তাদের ধর্মীয় আইন-কানুন অনুযায়ীই ফয়সালা হবে এবং এজন্য রাষ্ট্র তাদের মধ্য হতে একজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্র অধিকৃত বিচারালয়ে বিচারক হিসাবে মনোনীত করবে। এছাড়া, তাদের খাদ্য ও সাজসজ্জা বিষয়েও তাদের ধর্মীয় রীতি-নীতিকেই প্রধান্য দেয়া হবে এবং এ সকল বিষয়ই সাধারণ নির্দেশের আওতাভূক্ত হবে। আহলে কিতাব বহির্ভূত সম্প্রদায়ের জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। মাজুসদের সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, “তোমরা আহলে কিতাবদের সাথে যেমন আচরণ করো তাদের(মাজুস) সাথেও একই রকম আচরণ করো।”
কিন্তু, লেনদেন সংক্রান্ত এবং শাস্তিমূলক বিধান সমূহ মুসলিম-অমুসলিম সহ সকলের উপরই সমান ভাবে প্রযোজ্য হবে। বস্তুতঃ বিভিন্ন অন্যায়ের শাস্তি সম্পর্কিত বিচারকার্যের ব্যাপারে মুসলিম-অমুসলিম সহ সকলের উপরই শরীয়াহ্ আইন প্রয়োগ করা হবে। যারা ইসলামী রাষ্ট্রে নাগরিক হিসাবে বসবাস করবে তারা সবাই লেনদেন ও শাস্তি প্রদান সম্পর্কিত শরীয়াহ্ আইন মেনে চলতে বাধ্য থাকবে। এক্ষেত্রে, ধর্মীয়, জাতিগত কিংবা গোত্রীয় ভেদাভেদ বিবেচিত হবে না। অমুসলিমরা মূলতঃ রাষ্ট্রের শাসন-কর্তৃত্ব এবং আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকেই এ সমস্ত আইন-কানুন মেনে চলবে, ধর্মীয় কিংবা আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। তাদের কোন অবস্থাতেই এ সমস্ত আইন-কানুনের উপর বিশ্বাস আনতে বাধ্য করা হবে না। কারণ, তা করা হলে তাদের প্রকৃতপক্ষে জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহনে বাধ্য করা হবে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন,
“দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই।” [সুরা বাকারাহঃ ২৫৬]
আল্লাহর রাসূল (সা) আহলে কিতাবের অন্তর্ভূক্ত মানুষদের ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ কিংবা বিশ্বাসের জন্য তাদের নিপীড়ন করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু, নাগরিক হিসাবে তাদের অবশ্যই রাষ্ট্রের শাসন-ক্ষমতা ও আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে শরীয়াহ্ আইন মেনে চলতে হবে।
পরিশেষে এটা বলা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীন নীতি হবে রাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের উপর শরীয়াহ্ আইন কার্যকর করা। নাগরিকদের উপর নিম্নোক্ত উপায়ে শরীয়াহ্ আইন কার্যকর করা হবেঃ
১. সকল মুসলিম নাগরিকের উপর শরীয়াহ্ আইন কার্যকর করা হবে।
২. বিশ্বাস এবং উপাসনা সংক্রান্ত বিষয়ে অমুসলিম নাগরিককের উপর কোনরকম হস্তক্ষেপ করা হবে না ।
৩. সাধারণ আইনের আওতায় খাদ্য ও সাজসজ্জা সম্পর্কিত বিষয়ে অমুসলিম নাগরিককে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুসরণ করতে দেয়া হবে।
৪. অমুসলিমদের বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্র তাদের পক্ষ হতে রাষ্ট্র অধিকৃত বিচারালয়ে বিচারক নিয়োগ করবে এবং এ সংক্রান্ত সকল ঝগড়া-বিবাদ উক্ত বিচারালয়েই ফয়সালা করা হবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে গঠিত কোন আদালত (Private Court) গ্রহনযোগ্য হবে না। কিন্তু, এ সংক্রান্ত বিবাদ যদি অমুসলিম এবং মুসলিমদের মধ্যে সংঘটিত হয়, তবে তা মুসলিম বিচারকের মাধ্যমে ইসলামী আইন অনুযায়ী ফয়সালা করা হবে।
৫. অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আইনগত লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়ে ইসলামী রাষ্ট্র মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের উপর কোনরকম পূর্বশর্ত ছাড়াই শরীয়াহ্ কার্যকর করবে।
৬. ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত সকলকেই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করা হবে। কোনরকম বৈষম্য ছাড়াই রাষ্ট্র তাদের অভিভাবক হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে এবং তাদের সকল কার্যাবলী দেখাশুনা করবে।