মদীনায় পা রাখার প্রথম দিন থেকেই আল্লাহর রাসূল (সা) মুসলিম ও অমুসলিম সহ সবাইকে শাসন করেছেন এবং তাদের সমস্ত বিষয় দেখাশুনা করেছেন। ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করার পর তিনি (সা) একটি আদর্শ ইসলামী সমাজ গঠনে মনোনিবেশ করেন যেন, এ সমাজ প্রকৃত অর্থেই একটি জনকল্যাণমূলক সমাজে পরিণত হয়। মদীনার রাষ্টপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন কালে তিনি (সা) ইহুদী গোত্র, বনু দামরাহ এবং বনু মুদলাজের সাথে চুক্তি করেন। পরবর্তীতে তিনি (সা) কুরাইশ এবং আইলাহ, আল-যারবা ও উযরাহ’র গোত্র প্রধানদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তিনি (সা) একথাও মেনে নেন যে, কোন গোত্রের মানুষকেই হজ্জ্ব করতে বাধাঁ দেয়া যাবে না আর, না কারো পবিত্র মাসে আক্রান্ত হবার কোন ভয় থাকবে। সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে তিনি (সা) অনেক যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন এবং এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। তিনি (সা) হামযাহ ইবন ’আব্দুল মুত্তালিব, মুহাম্মদ ইবন ’উবাইদা ইবন আল-হারিছাহ এবং সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাসকে কুরাইশদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। তিনি (সা) যায়িদ ইবন হারিছাহ, জাফর ইবন আবি তালিব এবং আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহাকে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেন। একই ভাবে, তিনি (সা) খালিদ ইবন আল-ওয়ালিদকে দুমাত আল-জান্দাল গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নেতৃত্বে নিযুক্ত করেন। এছাড়া, অসংখ্য যুদ্ধে তিনি (সা) নিজে নেতৃত্ব দেন যেখানে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
এছাড়াও তিনি (সা) প্রতিটি প্রদেশে একজন ওয়ালী (Governor) এবং প্রতিটি অঞ্চলে একজন আমিল (Sub-governor) নিযুক্ত করেন। উদাহরন স্বরূপ, তিনি (সা) মক্কা বিজয়ের পরপরই উতাব ইবন উসাইদকে মক্কার ওয়ালী হিসাবে নিযুক্ত করেন এবং বাদান ইবন সাসান ইসলাম গ্রহন করার পর তিনি (সা) তাকে ইয়েমেনের ওয়ালী নিযুক্ত করেন। মু’য়াজ ইবন আল জাবাল আল-খাযরাজী আল-জানান প্রদেশের এবং খালিদ ইবন সা’য়িদ ইবন আল আস সানা’র ওয়ালী হিসাবে নিযুক্ত হন। আল্লাহর রাসূল (সা) যায়িদ ইবন লুবাইদ ইবন ছালাবাহ আল-আনসারীকে হাযরামাউতের ওয়ালী নিযুক্ত করেন। আবু মুসা আল-আশ’য়ারীকে যাবিদ ও এডেন এর এবং আমর ইবন আল’আস ওমানের ওয়ালী হিসাবে নিযুক্ত করেন। আর, মদীনাতে তিনি (সা) আবু দুজানাহকে মদীনার আমিল হিসাবে দায়িত্ব দেন। আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর চারপাশের মানুষদের মধ্যে যোগ্যতা অনুসারে বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন দায়িত্বের জন্য নিযুক্ত করতেন। যাদের অন্তর ঈমানের আলোতে পরিপূর্ণ ছিলো শুধু তাদেরকেই তিনি (সা) শাসনকার্যের গুরুদায়িত্ব দেন। বর্ণিত আছে যে, মু’য়াজ ইবন জাবাল আল-খাযরাজিকে ইয়েমেনের শাসনকর্তা হিসাবে নিযুক্ত করার সময় তিনি (সা) তাকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি দিয়ে জনগণকে শাসন করবে হে মু’য়াজ?” উত্তরে মু’য়াজ বলেন, “আমি আল্লাহর কিতাব দিয়ে তাদের শাসন করবো।”তারপর তিনি (সা) বলেন, “যদি এ ব্যাপারে সেখানে কিছু না পাও?” তখন মু’য়াজ বলেন, “তাহলে আমি রাসুলের সুন্নাহর মধ্যে তা খুঁজবো।”এটা শুনে রাসূল (সা) তাকে বলেন, “যদি সেখানেও না পাও?” উত্তরে মু’য়াজ বলেন, “তাহলে আমার জ্ঞান অনুযায়ী ইজতিহাদ(গবেষণা) করবো।”একথা শুনে আল্লাহর রাসূল (সা) অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে যান এবং বলেন, “প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি তাঁর রাসুলের বার্তাবাহককে এমন জ্ঞান দিয়েছেন যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালবাসেন।”এছাড়া, আরও বর্ণিত আছে যে, আল্লাহর রাসূল (সা) আব্বান ইবন সা’য়িদকে বাহরাইনের ওয়ালী নিযুক্ত করার সময় তাকে বলেন, “’আবদ আল কায়েসের লোকেদের সাথে সুন্দর আচরন করবে। আর, তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন করবে।”
আল্লাহর রাসূল (সা) আচার-আচরন ও ঈমানের দিক থেকে সবচাইতে শ্রেষ্ঠ মুসলিমদেরকেই শাসক হিসাবে নিযুক্ত করতেন। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তিনি (সা) ওয়ালীকে অর্থসংগ্রহ, জনগণকে ইসলামের আগমনের সু-সংবাদ দেয়া, মানুষকে কুরআনের আলোকে গড়ে তোলা এবং তাদেরকে দ্বীন-ইসলাম বোঝানোর দায়িত্ব দিতেন। তিনি (সা) তাঁর নিযুক্ত ওয়ালীকে কঠিন হস্তে অন্যায় ও বিদ্রোহ দমনের নির্দেশ দিতেন। কিন্তু, সত্যবাদীতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিনয়ী ও অমায়িক আচরন করতে বলেন। এছাড়া, বিবাদমান গোত্রগুলোর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে কোন প্রকার গোত্রীয় রীতিনীতিকে মানদন্ড হিসাবে নিতে নিষেধ করেন। বরং, সকলক্ষেত্রে, আল্লাহ প্রদত্ত আইনকানুনকেই একমাত্র মানদন্ড হিসাবে গ্রহন করার নির্দেশ দেন।
আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর নিযুক্ত শাসকদের যুদ্ধলব্ধ সম্পদের এক পঞ্চমাংশ সংগ্রহ করার নিদের্শ দেন। এছাড়া, মুসলিমদেরকে আল্লাহতায়ালা যে সমস্ত ক্ষেত্রে সাদাকাহ্ দিতে বলেছেন, সে সমস্ত অর্থও সংগ্রহ করতে বলেন। তিনি (সা) ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের মধ্য হতে যারা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহন করেছে তাদেরকে এ সু-সংবাদ দেবার নির্দেশ দেন যে, এখন থেকে তারা বিশ্বাসীদের সমপরিমান অধিকার লাভ করবে এবং তাদেরকে অন্যসব মুসলিমদের মতোই একই দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি (সা) ইহুদী, খ্রিষ্টান বা অন্য যে কারো উপর যে কোন ধরনের অত্যাচার প্রতিহত করার নির্দেশও দেন। আল্লাহর রাসূল (সা) মু’য়াজ (রা)-কে ইয়েমেনে পাঠানোর পূর্বে তাকে বলেন, “আহলে কিতাবের লোকদের শাসন করার জন্য তোমাকে পাঠানো হচ্ছে। তোমার প্রথম কাজ হবে তাদের এক আল্লাহর দাসত্বের দিকে আহবান করা। যদি তারা তা মেনে নেয়, তবে তুমি তাদের জানিয়ে দেবে যে, আল্লাহ তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, সম্পদশালীদের কাছ থেকে যাকাত সংগ্রহ এবং দরিদ্রদের মধ্যে তা বিতরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যদি তারা তা মেনে নেয়, তবে তাদের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করবে এবং তাদের এ আমানত দেখাশুনা করবে এবং নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করবে। মনে রেখ, নির্যাতিত মানুষ ও আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা নেই।”আল্লাহর রাসূল (সা) খায়বারের ইহুদীদের উৎপাদিত শস্য ও ফলফলাদি পরিমাপ করে তা থেকে রার্ষ্টের নির্ধারিত অংশ সংগ্রহ করার জন্য সাধারনত আব্দুল্লাাহ ইবন রুওয়াহাকে নিযুক্ত করতেন। তারা আল্লাহর রাসূল (সা)-এর কাছে একবার তার মূল্যায়নের ব্যাপারে অভিযোগ করে এবং আব্দুল্লাহকে ঘুষ হিসাবে কিছু সোনা-দানা দেবার চেষ্টা করে। তারা বলে, “এগুলো (সোনা-দানা) নিয়ে যাও এবং শস্য ভাগাভাগির ব্যাপারে একটু ছাড় দাও।”উত্তরে আব্দুল্লাহ বলেন, “হে ইহুদীরা, তোমরা হচ্ছো আল্লাহর সৃষ্টি জগতের মধ্যে সবচাইতে নিকৃষ্ট। কিন্তু, আমি ন্যায়বিচারের ব্যাপারে এতটুকু ছাড় দেব না। যা তোমরা আমাকে ঘুষ হিসাবে গ্রহন করতে বলেছো তা আল্লাহর দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। সুতরাং, তা আমি গ্রহন করতে পারবো না।”এ কথা শুনে ইহুদীরা বলে, “এজন্যই আল্লাহ পৃথিবী ও জান্নাত তৈরী করেছেন।”
আল্লাহর রাসূল (সা) সবসময়ই বিভিন্ন প্রদেশে তাঁর নিযুক্ত শাসক ও ব্যবস্থাপকদের উপর নজর রাখতেন এবং তাদের কার্যকলাপের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতেন। তিনি (সা) তাদের বিরুদ্ধে উত্থিত অভিযোগও মনোযোগের সাথে শুনতেন। একবার বাহরাইনে তাঁর নিযুক্ত আমিল আল-আলা ইবন আল-হাদরামির বিরুদ্ধে আবদ কায়িসের একদল প্রতিনিধি তাঁর কাছে অভিযোগ উত্থাপন করায়, তিনি (সা) উক্ত আমিলকে ঐ অঞ্চল থেকে অপসারন করেন। এছাড়া, তিনি (সা) এটাও লক্ষ্য রাখতেন যে, তাঁর নিয়োগকৃত ব্যবস্থাপকরা কিভাবে রাষ্ট্রের নির্ধারিত অর্থ সংগ্রহ করছে এবং রাজস্ব খাতে অর্জিত অর্থ কিভাবে ব্যয় করছে। একবার তিনি (সা) একব্যক্তিকে যাকাত সংগ্রহের জন্য নিয়োজিত করেন। সেখান থেকে ফেরার পর উক্ত ব্যক্তি তাঁকে বলেন, “এই হচ্ছে আপনার নির্ধারিত অংশ আর এগুলো আমাকে উপহার হিসাবে দেয়া হয়েছে।”একথা শোনার পর আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন, “এই ব্যক্তির বিষয়টা কি? আল্লাহ আমাদের উপর যে দায়িত্ব অর্পন করেছেন আমরা তাকে সে অনুযায়ী কাজে নিযুক্ত করেছি, আর সে কি না বলছে, এটা আপনার অংশ আর এটা আমাকে উপহার হিসাবে দেয়া হয়েছে? সে কি বাড়ীতে তার মাতা-পিতার সাথে বসে উপহারের প্রত্যাশা করতে পারে না? আমরা যদি কাউকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোন কাজের জন্য নিযুক্ত করি এবং তারপরেও যদি সে এর বাইরে কোনকিছু গ্রহন করে, তবে সেটা হবে অসৎ উপার্জন।”
আল্লাহর রাসূল (সা) মানুষের মাঝে ঝগড়া-বিবাদের নিষ্পত্তি করার জন্য বিচারক নিযুক্ত করেছেন। তিনি (সা) আলী (রা)-কে ইয়েমেনের বিচারক এবং আব্দুল্লাহ ইবন নওফেলকে মদীনার বিচারক হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। সেইসাথে, তিনি (সা) মু’য়াজ ইবন জাবাল এবং আবু মুসা আল-আশয়ারীকেও ইয়েমেনের বিচারক নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি (সা) তাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কি দিয়ে তোমরা বিচার-ফয়সালা করবে?” উত্তরে তারা বলেন, “আমরা যদি আল্লাহর কিতাব ও রাসুলের সুন্নাহতে তা খুঁজে না পাই তবে, কিয়াসের মাধ্যমে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বের করবো।”তিনি (সা) তাদের এ পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দেন। আল্লাহর রাসূল (সা) বিভিন্ন স্থানে শুধু বিচারক নিযুক্ত করেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি (সা) বিচারক এবং শাসকদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগের সঠিক তদন্ত ও বিচার করার জন্য বিচারকদের সমন্বয়ে জুরী বোর্ড (মাযালিম) গঠন করেন। তিনি (সা) বিচার বিভাগ ও জুরী বোর্ডের আমির (নেতা) হিসাবে রাশিদ ইবন ’আব্দুল্লাহকে নিযুক্ত করেন এবং জুরী বোর্ডের সামনে উপস্থাপিত সকল অভিযোগ তদন্ত করার দায়িত্ব দেন।
আল্লাহর রাসূল (সা) জনগণের সমস্ত বিষয়াদির ব্যাপারেই দেখাশুনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি (সা) ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগের প্রধান হিসাবে একজন রেজিষ্টার বা লিপিবদ্ধকারক নিয়োগ করেছিলেন। আলী ইবন আবি তালিব এর দায়িত্ব ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে অন্যান্য গোত্র বা রাষ্ট্রের সকল প্রকার চুক্তি লিপিবদ্ধ করা। আল-হারিছ ইবন আউফ (রা) রাসূল (সা) এর সীলমোহরের দায়িত্বে ছিলেন, মু’য়াইকিব ইবন আবি ফাতিমাহ ছিলেন যুদ্ধলব্ধ মালামালের দায়িত্বে, হুযাইফা ইবন আল-ইয়ামান ছিলেন সমগ্র হেযাযে উৎপন্ন ফল-ফলাদি ও শস্য পরিমাপ ও মূল্যায়ন করার দায়িত্বে, যুবাইর ইবন আল-আওওয়াম ছিলেন সাদাকা বিভাগের সেক্রেটারী, আল-মুগীরা ইবন শু’বাহকে দেয়া হয়েছিল ঋণ বিষয়ক ও লেনদেন সংক্রান্ত দলিলপত্র লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব এবং শারকাবিল ইবন হাসানাহ’কে নিযুক্ত করা হয়েছিল বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ’র কাছে রাসূল (সা)-এর প্রেরিত পত্র লেখার দায়িত। তিনি (সা) প্রতিটি বিভাগের একজন সেক্রেটারী বা পরিচালক নিযুক্ত করেছিলেন, বিভাগের সংখ্যা যতো বেশীই হোক না কেন। এ সমস্ত বিষয়ে তিনি (সা) তাঁর সাহাবীদের মধ্যে যাদের গভীর চিন্তাশক্তি ও বিভিন্ন বিষয় উপলব্ধি করার ক্ষমতা রয়েছে, বিশেষ করে যারা দ্বীন-ইসলামের জন্য তাদের জীবনকে পুরোপুরি উৎসর্গিত করেছিল, তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করতেন। আনসারদের মধ্য হতে এ রকম ব্যক্তিদের সংখ্যা ছিল সাত জন আর মুহাজিরদের মধ্য হতে ছিল সাত জন। এদের মধ্যে ছিল, হামযাহ, আবু বকর, ওমর, জা’ফর, আলী, ইবন মাসউদ, সালমান, আম্মার, হুযাইফা, আবু দার, আল-মিকদাদ এবং বিলাল। এছাড়া, তিনি (সা) বিভিন্ন সময়ে অন্যদের সাথেও পরামর্শ করতেন, কিন্তু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই উল্লেখিত ব্যক্তিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান নিতেন। এদের সকলকে নিয়েই আসলে মাজলিশ্ আল-উম্মাহ গঠিত হয়েছিল।
আল্লাহর রাসূল (সা) মুসলিম-অমুসলিম সহ নির্বিশেষে সকলের উপর কয়েক প্রকার জমিজমা, উৎপন্ন ফসল এবং গবাদি পশুর উপর কর আরোপ করেন। এগুলো যাকাত, উশর (নির্দিষ্ট ফসলের এক দশমাংশ), ফা’ই (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ), খারাজ (জমির উপর আরোপিত খাজনা) এবং জিযিয়া (রাষ্ট্রের অমুসলিমদের নাগরিকদের উপর আরোপিত কর) নিয়ে গঠিত ছিল। আনফাল ও যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ছিল বায়তুল মালের সম্পদ (রাষ্ট্রের সম্পদ)। যাকাতের অর্থ পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনযায়ী আট প্রকারের মানুষের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হতো, এর বাইরে কেউ যাকাতের সম্পদ পেত না। যাকাতের অর্থ কখনোই রাষ্ট্রীয় ব্যয় মেটানোর কাজে ব্যবহার করা হতো না। রাষ্ট্রের সকল ব্যয় ফা’ই, খারাজ, জিযিয়া এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হতে প্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমেই করা হতো। বস্তুতঃ এ সমস্ত খাত হতে প্রাপ্ত সম্পদই রাষ্ট্রের সকল ব্যয়ভার বহন করা কিংবা যুদ্ধ পরিচালনায় প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য যথেষ্ট ছিল। যে জন্য, ইসলামী রার্ষ্টের অর্থজনিত কোন সমস্যা কখনো ছিল না।
এভাবেই আল্লাহর রাসূল (সা) ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাঠামোগত ভিত্তি তৈরী করেন। প্রতিটি জিনিস তিনি (সা) নিজের হাতে করেন এবং তাঁর জীবদ্দশায়ই এ কাজ সম্পন্ন করেন। তিনি (সা) ছিলেন তাঁর নিজের হাতে গড়া এ রাষ্ট্রের প্রধান। এছাড়া, তাঁকে রাষ্ট্রীয় কাজে সাহায্য করার জন্য ছিল তাঁর সহকারী, গর্ভনর, বিচারক, সৈন্যবাহিনী, সেক্রেটারী এবং তাঁকে পরামর্শ দেবার জন্য ছিল শুরা কাউন্সিল (পরিষদ)। তাই, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এই কাঠামোর ভিত্তিতেই তা তৈরী করতে হবে এবং এই কাঠামোই অনুমোদন করতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কিত এ সকল খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বহু সংখ্যক মানুষের বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনার (তাওয়াতুর) মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছেছে। আল্লাহর রাসূল (সা) মদীনায় আসার প্রথম দিন থেকেই রাষ্ট্র প্রধানের ভূমিকা পালন করেছেন। এ দীর্ঘ সময়ে আবু বকর এবং ওমর তাঁর সহকারী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর সাহাবীগণ সর্বসম্মতিক্রমে রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে আবু বকরকে নিযুক্ত করেন, নবী কিংবা ওহীর বার্তাবাহক হিসাবে নয়। কারণ, তিনি (সা) ছিলেন সর্বশেষ নবী এবং তাঁর পরে আর কারও কাছে ওহী নাযিল হবে না।
তাহলে, দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর জীবদ্দশায়ই একটি পরিপূর্ণ সরকার ব্যবস্থা তৈরী করেছিলেন। বস্তুতঃ মৃত্যুর পর তিনি (সা) এমন এক শাসন-ব্যবস্থা বা সরকার-ব্যবস্থা রেখে যান, যা ইতিমধ্যে সকলের কাছে পরিচিত সুস্পষ্ট ছিল।