ইসলামী রাষ্ট্র – পর্ব ২০ (বিদ্রোহ দমন)

বদরের যুদ্ধে মুসলিমদের সংখ্যা ছিলো অতি নগন্য এবং যুদ্ধ সরঞ্জামের দিক থেকেও তারা ছিলো খুবই দূর্বল। কিন্তু, তারপরও, কাফিরদের সাথে মুসলিমের এ প্রথম মুকাবিলায় মুসলিমরা বীরের মতো বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলো। মুসলিমদের এ বীরত্বপূর্ণ বিজয় কাফিরদের আত্মবিশ্বাসের ভীত এতো সাংঘাতিক ভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিলো যে, তারা শোকে-দুঃখে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলো। এছাড়া, কুফরশক্তির উপর মুসলিমদের এ বিজয় মদীনার অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধ সহ ইহুদীদের নানারকম চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকেও অনেকটা দমিয়ে দিয়েছিলো। এ ঘটনার প্রত্যক্ষ ফল স্বরূপ, কিছু ইহুদী গোত্র মুসলিমদের সাথে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়, আর কিছু গোত্র মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়। মদীনাতে মুসলিমদের শক্তিসামর্থ্য ক্রমশঃ বাড়ছিলো, আর কুরাইশরা এক মূহুর্ত সময় নষ্ট না করে অপমানের প্রতিশোধ নেবার পরিকল্পনা আঁটছিলো। পরের বছর ওহুদের যুদ্ধে যখন মুসলিম  তীরন্দাজরা  (যারা  মুজাহিদদের  পেছন  থেকে  পাহারা  দেবার  দায়িত্বে  নিয়োজিত  ছিলো)  রাসূল  (সা)  এর নির্দেশ  অমান্য  করে গণীমতের মালামাল সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে গেলো, ঠিক তখনই কুরাইশদের হাতে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার সুবর্ণ সুযোগ এসে গেলো। যুদ্ধে জয়ী হয়ে কুরাইশরা আনন্দে উৎফুল্ল হলো। আর, মুসলিম যোদ্ধারা ভগ্ন হৃদয়ে পরাজিত হয়ে মদীনায় ফিরে আসলো। যদিও যুদ্ধ শেষ হবার পর মুসলিমরা কুরাইশদের হামরা আল-আসাদ পর্যন্ত ধাওয়া করেছিলো (এটি ছিলো মদীনা থেকে প্রায় আট মাইল দূরে)।

ওহুদের প্রান্তরে মুসলিমদের এই পরাজয়ে আরব ভূ-খন্ডে নানারকম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। মদীনার অভ্যন্তরে বিভিন্ন দল মুসলিমদের শক্তিসামর্থ্য ও  শাসনকর্তৃত্বকে  তুচ্ছতাচ্ছিল্য  করে  প্রকাশ্যেই  বিদ্রোহ  ঘোষনা  করে।  মদীনার  বাইরের  কিছু  গোত্র, যারা ওহুদের যুেদ্ধর পূর্বে কোনদিন মুসলিমদের সাথে কৃত চুক্তির সীমা অতিক্রম করার কথা চিন্তাও করেনি, তাদের মাঝেও বিদ্রোহের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। ইহুদী ও মদীনার মুনাফিকদের মতো মদীনার বাইরের আরবরাও মুহাম্মদ (স)কে চ্যালেঞ্জ করার কথা ভাবতে থাকে। এ লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন ভাবে মুসলিমদের প্ররোচিত করতে থাকে।

মদীনার ভেতরে-বাইরে শত্রুপক্ষের এ সব পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে রাসূল (সা) শত্রুপক্ষকে মুকাবিলা করার বিষয়ে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মুসলিমদের প্রভাব-প্রতিপত্তি, মর্যাদা ও শক্তিসার্মথ্য পুণরুদ্ধারকল্পে তিনি (সা) মুসলিমদের প্রতি অমুসলিমদের যে কোন ধরনের তুচ্ছতাচ্চিল্য ও বিদ্রোহকে কঠোর হস্তে দমনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন।

ওহুদ  যুেদ্ধর  একমাস পর আল্লাহর রাসুেলর কাছে এ মর্মে সংবাদ পৌঁছে যে, বনু আসাদ গোত্র মদীনা আক্রমণ করে শহরের  চারিপার্শস্থ চারণভূমির পশুগুলো লুট করার পরিকল্পনা করেছে। এমতাবস্থায়, রাসূল (সা) বনু আসাদ গোত্রকে মদীনা আক্রমণ করার কোন সুযোগ না দিয়ে তার আগেই তাদের আস্তানায় আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। শত্রুপক্ষের আক্রমণের পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দেয়াই ছিলো এ আক্রমণের উদ্দেশ্য। তিনি (সা) আবু সালামাহ ইবন ’আবদ আল-আসাদের নেতৃত্বে ১৫০ জন মুসলিমদের একটি দলকে এ অভিযানে প্রেরণ করেন। এ দলে আবু ’উবাইদাহ ইবনুল যাররাহ, সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস এবং উসাইদ ইবন হুদাইর সহ অনেক খ্যাতনামা যোদ্ধা ছিলো। এ অভিযানকে গোপন রাখা এবং শত্রুপক্ষকে চমকে দেবার জন্য আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর সাহাবীদের দিনে লুকিয়ে থেকে রাতে যাত্রা করার নির্দেশ দেন। সেইসাথে, প্রচলিত পথে যাত্রা না করে ভিন্ন পথ ধরে চলার আদেশ দেন। আবু সালামাহ বনু আসাদ গোত্রের ঘাঁটিতে পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত যাত্রা করতে থাকেন। লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর তিনি ভোরবেলায় দলবল সহ বনু আসাদ গোত্রকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন এবং তার সঙ্গীদের জিহাদের নির্দেশ দিয়ে শত্রুপক্ষের উপর আক্রমণ চালান। মুসলিম সৈন্যদল খুব সহজেই বনু আসাদকে পরাজিত করে এবং যুদ্ধলব্ধ মালামাল সহ বীরের বেশে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে। এভাবে, মুসলিমদের শৌর্য-বীর্য আবারও প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ ঘটনার মাধ্যমে প্রকারান্তরে মুসলিমরা অমুসলিমদের ইসলামের শক্তিসামর্থ্যরে কথা মনে করিয়ে দেয়।

এরপর, রাসূল (সা) এর কাছে সংবাদ পৌঁছে যে, খালিদ ইবন সুফিয়ান আল-হনদালি নামে এক পৌত্তলিক ’উরনাহ বা নাখলাহর কাছে অবস্থান গ্রহন করেছে এবং মদীনা আক্রমণের জন্য লোকবল সংগ্রহ করছে। এ সংবাদ শোনার পর, আল্লাহর রাসূল (সা) ’আব্দুল্লাহ ইবন আনিছকে খালিদ ইবন সুফিয়ান সম্পর্কে খোঁজখবর নেবার জন্য প্রেরণ করেন। ’আব্দুল্লাহ যাত্রা শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই খালিদের দেখা পেয়ে যান। খালিদ তাকে জিজ্ঞেস করে যে, সে কে? উত্তরে তিনি বলেন,“আমি আব্দুল্লাহ। আমি একজন আরব। আমি শুনতে পেয়েছি যে তুমি মুহাম্মদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য লোক সংগ্রহ করছো। আর এ কারনেই আমি এখানে এসেছি।” খালিদ তার পরিকল্পনার কথা স্বীকার করে। তারপর, তারা দু’জন কথাবার্তা বলতে বলতে সামনের দিকে  হাটঁতে থাকে। যখন তারা দু’জন লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে আসে তখন ’আব্দুল্লাহ ইবন আনিছ  তলোয়ার দিয়ে খালিদকে তীব্র ভাবে আঘাত করে তাকে হত্যা করেন। তারপর, তিনি মদীনায় ফিরে এসে রাসূল (সা)কে তার অভিযানের কথা বর্ণনা করেন। খালিদের মৃত্যুর সাথে সাথে হাদায়েলের বনু লিহইয়ান গোত্র মদীনা আক্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করে। আর এভাবেই, রাসূল (সা) অত্যন্ত সফলতার সাথে খালিদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেন এবং সেইসাথে মদীনার বিভিন্ন প্রান্তরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা বিদ্রোহেরও অবসান হয়।

কিন্তু এ ঘটনার পরেও কিছু আরব গোত্র মুসলিমদের শাসন-কতৃত্বকে তচ্ছু-তাচ্ছিল্য করে তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহে লিপ্ত হয়। হাদায়েলের আশেপাশের এলাকার কোন গোত্র থেকে একবার একদল লোক মদীনায় আসে। তারা মুহাম্মদ (সা)কে বলে যে, তারা দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে জানার ব্যাপারে  খুবই  আগ্রহী। সুতরাং, তিনি (স) যেন তাদেরকে কুরআন শেখানোর জন্য কিছু সাহাবাকে তাদের গোত্রে পাঠান। একথা শুনে রাসূল (স) বয়োজেষ্ঠ্য ছয়জন সাহাবীকে তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেন। যাত্রা শুরু করার পর তারা হাদায়েলের কুপগুলোর কাছাকাছি আল-রাজি নামক এলাকায় পৌঁছালে উক্ত গোত্রের লোকেরা সাহাবীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। তারা হাদায়েলের অধিবাসীদেরকে সাহাবীদের আক্রমণ করার নির্দেশ দেয়। তারপর সেখানকার অধিবাসীরা সাহাবীদের ঘেরাও করে ফেলে এবং তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মুসলিমরাও জীবন বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করতে থাকে এবং তাদের মধ্যে তিনজন সাহাবী সেখানেই শাহাদাত বরণ করেন। বাকী তিনজনকে তারা বন্দী করে মক্কার কুরাইশদের কাছে বিক্রির জন্য নিয়ে যায়। মক্কা যাত্রাকালে বন্দী সাহাবীদের মধ্য হতে ’আব্দুল্লাহ ইবন তারিক তার তলোয়ারের নাগাল  পেয়ে যায় এবং নিজেকে মুক্ত করার জন্য কাফিরদের আক্রমণ করে। কিন্তু, শীঘ্রই কাফিররা তাকে হত্যা করে। অন্য দু’জন বন্দীকে তারা মক্কার পৌত্তলিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এদের মধ্যে যায়িদ ইবন আল-দাছনাহকে সাফওয়ান ইবন উমাইয়াহর কাছে বিক্রি করা হয় যেন সে তার পিতা উমাইয়া ইবন খালফের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারে। সাফওয়ান সাহাবী যায়িদকে বলে, “আল্লাহর কসম, তুমি কি চাও না যে আজ তোমার পরিবর্তে যদি মুহাম্মদ আমাদের হাতে বন্দী থাকতো, আমরা তার মাথা কেটে নিতাম আর তুমি তোমার পরিবারের সাথে থাকতে?” এর উত্তরে যায়িদ বলেন, “আল্লাহর কসম, আমি কক্ষনো ভাবতে পারি না যে মুহাম্মদ যদি আজ আমার জায়গায় থাকতো। আমি ঘরে নিরাপদে বসে থাকবো আর এ অবস্থায় তাঁর গায়ে একটা কাঁটার আঘাতও লাগবে এটা আমি সহ্য করবো না।” একথা শুনে সাফওয়ান আশ্চর্য হয়ে যায়। সে প্রায়ই বলতো, মুহাম্মদের ছাড়া আমি আর কোন মানুষ দেখিনি যে তার সঙ্গীসাথীদের এতো ভালোবাসা পেয়েছে। এরপর, যায়িদ ইবন আল-দাছনাহকে কুরাইশরা হত্যা করে।

দ্বিতীয় বন্দী খুবাইবকে মক্কায় আনার পর কারারুদ্ধ করে রাখা হয় যে পর্যন্ত না কুরাইশরা তাকে নির্মম ভাবে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। মৃত্যুর আগে খুবাইব কুরাইশদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দু’রাকাত নামাজ আদায় করে। অত্যন্ত চমৎকার ভাবে নামাজ আদায় করার পর তিনি কুরাইশদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “যদি না তোমরা ভাবতে আমি মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে নামাজ দীর্ঘ করছি তবে আমি আমার নামাজকে আরও দীর্ঘায়িত করতাম।” এরপর কুরাইশরা তাকে কাঠের সাথে শক্ত করে বাঁধে, এ সময় খুবাইব তাদের দিকে তাকিয়ে ক্রোধান্বিত ভাবে চিৎকার করে বলে, “হে আল্লাহ এদের প্রত্যেককে তুমি গুনে গুনে স্মরণে রেখো, তাদের প্রত্যেককে তুমি উপযুক্ত শাস্তি দিও, এদের মধ্যে কাউকে তুমি ছেড়ে দিও না।” উপস্থিত কুরাইশরা খুবাইবের এ কান্না জড়িত প্রার্থনায় ভীত হয়ে পড়ে, তারপর তাকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। আল্লাহর রাসূল (স) ও তাঁর সাহাবীগণ ছয়জন সাহাবীর এ নির্মম মৃত্যুতে শোকে কাতর হয়ে পড়েন। মূলতঃ হাদায়েলের অধিবাসীদের জঘন্য পদ্ধতিতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা ও সাহাবীদের প্রতি ভয়ঙ্কর অসম্মান প্রদর্শন করাই ছিলো মুসলিমদের তীব্র মনোকষ্টের আসল কারণ।

আল্লাহর রাসূল (স) এইসব বিদ্রোহের ঘটনা নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করতে থাকেন। ভাবতে থাকেন বিদ্রোহ দমনের উপায়। এ সময়ে আবু বারা’ ’আমির ইবন মালিক (বর্শার খেলোয়ার) নামে এক ব্যক্তি মদীনায় আগমন করে। রাসূল (স) সত্যদ্বীনকে তার কাছে ব্যাখ্যা করেন এবং তাকে দ্বীন ইসলামের দিকে আহবান করেন। আবু বারা’ ইসলাম গ্রহন না করলেও ইসলাম গ্রহনের খুব কাছাকাছি পর্যায়ে চলে যায়। এছাড়া, ইসলামের প্রতি কোনরূপ বিদ্বেষও তার মাঝে কখনো দেখা যায়নি। সে মুহাম্মদ (সা) অনুরোধ করে যে, “আপনি যদি আপনার সাহাবীদের মধ্য থেকে একদল মুসলিমকে নজদ্ এলাকায় ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য পাঠান, তাহলে আশা করা যায়, তারা এ আহবানে সাড়া দেবে।” কিন্তু, সম্প্রতি হাদায়েলের অধিবাসীদের  হাতে ছয় সাহাবীর নির্মম ভাবে নিহত হওয়ার ভয়ঙ্কর স্মৃতি স্মরণ করে রাসূল (সা) তার প্রস্তাব মানতে অস্বীকার করেন। আবু বারা’ শেষ পর্যন্ত নিজে সাহাবীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিলে রাসূল (সা) তার প্রস্তাব মেনে নেন। আবু বারা’ রাসূল (সা)কে বলে, “আপনার পক্ষ থেকে একদল মানুষকে আপনি আপনার দ্বীনের দিকে আহবান করার জন্য পাঠিয়ে দেন, তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার।” আরব ভূ-খন্ডে আবু বারা’র যথেষ্ট সুনাম ছিলো এবং তার কথার গুরুত্বও ছিলো যথেষ্ট। তাই, তার কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা করা কিংবা তার দেয়া নিরাপত্তায় কারো কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা ছিলো না।

এসব বিষয় বিবেচনা করে রাসূল (সা) চল্লিশ জন প্রথম শ্রেণীর মুসলিমকে আল-মুনদির ইবন ’আমর এর নেতৃেত্ব নজদ্ এলাকায় পাঠিয়ে দেন। দলটি পথ চলতে চলতে মা’য়ুনার কুপের কাছে পৌঁছালে মুসলিমদের পক্ষ হতে একজন রাসূল (সা) এর চিঠি সহ ’আমর ইবন তুফাইলের সঙ্গে দেখা করতে যায়। ’আমর ইবন তুফাইল দূতকে দেখার সাথে সাথে চিঠি না পড়েই তাকে হত্যা করে। তারপর সে বনু ’আমির গোত্রকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আহবান করে। কিন্তু, বনু ’আমির গোত্র মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অসম্মতি জানিয়ে বলে যে, আবু বারা’ মুসলিমদেরকে নিরাপত্তার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা তা ভঙ্গ করবে না। তখন, ’আমর সেখানকার অন্য গোত্রগুলোকে যুদ্ধের জন্য আহবান করলে তারা উটের পিঠে চড়ে চারদিক থেকে মুসলিমদের ঘিরে ফেলে। এ অবস্থায় মুসলিমরা যার যার অস্ত্র বের করে তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমৃত্যু কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এ ভয়ঙ্কর ঘটনার দু’জন ছাড়া বাকী সমস্ত মুসলিম শহীদ হয়ে যায়। এ সংবাদ মদীনায় পৌঁছানোর পর আল্লাহর রাসূল (স) মানসিক ভাবে সাংঘাতিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন এবং সেই সাথে শোকের সাগরে নিমজ্জিত হন তাঁর সাহাবীরাও।

মদীনার বাইরের আরব গোত্রগুলোর বিদ্রোহ কিভাবে দমন করা যায় তা নিয়ে রাসূল (স) গভীর ভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন। ভাবতে থাকেন কিভাবে বদরের যুদ্ধে অর্জিত মুসলিমদের প্রভাবপ্রতিপত্তি ও শৌর্য-বীর্য ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায়। একসময় তিনি (সা) অনভুব করেন যে, মদীনার অভ্যন্তরেই আসলে অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। তাই, তিনি (স) প্রথমে ইসলামী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন সমস্যা সমাধানের দিকে মনোযোগী হন। তিনি (স) সিদ্ধান্ত নেন যে, অভ্যন্তরীন সমস্যা সমাধান করার পরই তিনি মদীনার বাইরের গোত্রগুলোর বিদ্রোহ দমনে চিন্তা-ভাবনা করবেন।

ওহুদের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের পর হাদায়েলের অধিবাসী কর্তৃক ছয় সাহাবীর হত্যাকান্ড এবং বীরে মায়ুনার নৃশংস ঘটনার  পর মদীনার মুনাফিক ও ইহুদী গোত্রগুলোর ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তারা পূণরায় মুহাম্মদ (স) এর বিরুদ্ধে ঘৃন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং মুসলিমদের কর্তৃত্বকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে শুরু করে। তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে কিভাবে মুসলিমদের একহাত দেখে নেয়া যায়। আল্লাহর রাসূল (স) ধীরে ধীরে তাদের মনোভাব বুঝতে পারেন এবং ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও অবহিত হন। এরপর, রাসূল (স) সাহাবী মুহাম্মদ ইবন মাসলামাহকে ইহুদীদের কাছে পাঠান। ইবন মাসলামাহ ইহুদীদেরকে রাসূল (সা) এর নির্দেশ জানিয়ে দিয়ে বলেন,“আল্লাহর রাসূল আমাকে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন এবং তোমাদের মদীনা ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, তোমরা তাঁর সাথে কৃত চুক্তির ওয়াদা ভঙ্গ করেছো এবং বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করার চেষ্টা করেছো। তোমাদের মদীনা ত্যাগের জন্য দশদিন সময় দেয়া হলো, এরপর যদি তোমাদের মধ্য হতে কাউকে মদীনায় দেখা যায় তার গর্দান উড়িয়ে দেয়া হবে।”

’আব্দুল্লাহ ইবন উবাই জোর করে আটকে না রাখলে বনু নাদির গোত্র এ নির্দেশের পরই মদীনা ত্যাগ করতো। এছাড়া, ইহুদীদের নেতা হুবাই ইবন আখতাবও তাদের দূর্গে দৃঢ় ভাবে অবস্থান করার জন্য তাদের পরামর্শ দিতে থাকে। দশদিন অতিক্রম হয়ে যাবার পরও যখন বনু নাদির তাদের দূর্গ ত্যাগ করলো না, তখন আল্লাহর রাসূল (স) দলবল সহ তাদের ঘেরাও করেন এবং যে পর্যন্ত না বনু নাদির রাসূল (সা) এর কাছে তাদের প্রাণ ভিক্ষা চায় সে পর্যন্ত তাদের সাথে যুদ্ধ করেন। মদীনা ত্যাগের সময় আল্লাহর রাসূল (স) উটের পিঠে করে যতোটা মালামাল নিয়ে যাওয়া যায় ততোটা নেয়ার অনুমতিও তাদের দেন। শেষ পর্যন্ত তারা তাদের জমিজমা, খেজুর বাগান ও অস্ত্রসস্ত্র পেছনে ফেলে মদীনা ত্যাগ করে। রাসূল (স) তাদের ফেলে যাওয়া সম্পদ মুহাজিরদের ভেতরে ভাগ করে দেন। আনসারদের মধ্য হতে শুধু আবু দানাহ এবং সাহল ইবন হানিফ নামে দু’জন সাহাবীকে দরিদ্রতার কারণে বনু নাদিরের সম্পদের অংশ দেয়া হয়েছিলো। বনু নাদির গোত্রকে মদীনা থেকে বিতারনের মাধ্যমে রাসূল (স) মদীনার অভ্যন্তরীন বিদ্রোহকে সাফল্যের সাথে দমন করেন এবং মুসলিমদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করেন।

আল্লাহর রাসুুল (স) এবার ইসলামের পররাষ্ট্রনীতির দিকে নজর দিয়ে কুরাইশদের কাছে প্রতিশ্রুত বদর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু, বদরের প্রান্তরে তিনি (স) শত্রুপক্ষের দেখা পেলেন না। এটা ছিলো ওহুদের যুদ্ধের একবছর পরের ঘটনা। ওহুদের যুদ্ধে মুসলিমদের দুঃখজনক পরাজয়ের পর পৌত্তলিকদের সর্দার আবু সুফিয়ান সর্দপে ঘোষণা দিয়েছিলো যে, “এটা হলো বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ, আগামীবছর বদর প্রান্তরে তোমাদের সাথে আবার সাক্ষাৎ হবে।” রাসূল (স) আবু সুফিয়ানের এ উক্তিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাই, তিনি (স) যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে তিনি (স) ’আব ইবন ’আব্দুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সলুলকে (মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর পুত্র) মদীনার দায়িত্বে রেখে বদরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বদরের প্রান্তরে পৌঁছানোর পর তারা কুরাইশদের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। ওদিকে, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কুরাইশরা দুই হাজার যোদ্ধা সহ মক্কা ত্যাগ করলেও খুব শীঘ্রই আবার তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফিরে যায়।

আল্লাহর রাসূল (স) বদরের প্রান্তরে কুরাইশদের জন্য দীর্ঘ আট দিন অপেক্ষা করলেন। কিন্তু, কুরাইশরা আর ফিরে আসলো না। শেষ পর্যন্ত তাঁরা খবর পেলেন যে, কুরাইশরা দলবল সহ মক্কায় ফিরে গেছে। এ সংবাদ পাবার পর তিনি (স) তাঁর সাহাবীদের সহ মদীনায় ফিরে আসলেন, সাথে করে আনলেন বদরের প্রান্তরে ব্যবসা থেকে অজির্ত পর্যাপ্ত মুনাফা। এ যাত্রায় মুসলিমরা কুরাইশদের সাথে কোন যুদ্ধ না করেই বিজয়ী বেশে  উৎফুল্ল চিত্তে মদীনায় ফিরে এলো। এর পরপরই রাসূল (স) তাঁর দলবল নিয়ে নজদ এলাকার গাতাফান গোত্রকে আক্রমণ করেন। আক্রমণে হতবিহবল হয়ে গাতাফান গোত্রের লোকেরা তাদের সহায়-সম্পদ ও নারীদের রেখেই পালিয়ে যায়। এসব কিছু সহ মুসলিমরা মদীনায় ফিরে আসে। এরপর রাসূল (স) সিরিয়া ও হেজাজের সীমান্তবর্তী এলাকায় দুমাত আল-জান্দাল গোত্রকে আক্রমণ করেন। এটা আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিলো অন্যান্য গোত্রগুলোকে সর্তক সংকেত দেয়া যারা প্রায়ই মুসলিমদের কাফেলার উপর হামলা করতো। কিন্তু, জুন্দাল গোত্র মুসলিমদের সাথে কোনরকম সংঘর্ষে না গিয়ে ধন-সম্পদ পেছনে ফেলে পালিয়ে যায়। আর মুসলিমরা সেগুলো নিয়ে মদীনায় ফেরত আসে। আল্লাহর রাসূল (স) এর এ সমস্ত আক্রমণের সিদ্ধান্ত ও গৃহীত পদক্ষেপ মূলতঃ মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন-কর্তৃত্বকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছিলো এবং সমস্ত আরব ও ইহুদী গোত্রগুলোর নিকট মুসলিমদের প্রতাপ-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেছিলো। আর নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো ওহুদের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের সকল নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া।

Leave a Reply