কেন মিশরে আমেরিকা সফল হতে পারছে না ?

সহিংস অভ্যুত্থানের পরে মিশরে ‘old guard’ এর ফিরে আসার প্রতিক্রিয়া মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যের বাহিরেও ছড়িয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর লক্ষে লড়াই করতে গিয়ে ওবামা প্রশাসনও প্রচন্ড বিক্ষোভের মাত্রা অনুভব করতে পেরেছে। আরব বসন্ত-২০১১ এর শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর বারবার অবস্থার পরিবর্তনের ফলে আমেরিকার সুযোগগুলো দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এটা এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য আমেরিকার সংশ্লিষ্টতাকে আরো স্পষ্ট করে তোলে।

১৯৭৯ সালে মিশর-ইসরাইল শান্তি চুক্তির পরে মিশর মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রধান মিত্রশক্তিতে পরিনত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য আমেরিকা তার মিত্রশক্তির উপর নির্ভর করে। সাধারনত সেনাবাহিনীই সর্বোচ্চ মিত্রশক্তি হিসাবে কাজ করে কারণ তারাই নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও বিদ্যমান ক্ষমতাকে সংরক্ষণ করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমান শক্তি অর্জন করে রাখে। আর যেহেতু রাজনৈতিক সংস্থাগুলো নামে মাত্র রয়েছে এবং তাদের সীমাবদ্ধ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে, তাই অভ্যুত্থান, বিপ্লব কিংবা বাহ্যিক কোন শক্তি প্রদর্শিত হলে এগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। আরব বসন্ত আমেরিকার জন্য নতুন প্রতিদ্বন্দিতার দ্বার উন্মোচন করেছে, সেক্ষেত্রে আমেরিকা নতুন রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত কোন নামে মাত্র এবং অপরিপূর্ণ রাজনৈতিক দলের উপর নির্ভর করবে না তা প্রকাশিত হয়েছে। চাহিদানুরুপ পরিবেশ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে চাপ প্রয়োগ করার জন্যেই সামাজিক ও বেসামরিক শক্তির প্রদর্শনীগুলো বিপ্লবী কর্মকান্ডের দিকে নির্ভর করতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে আবির্ভুত বেসামরিক শক্তিগুলো পরিপূর্ণ আদর্শিক বিস্তৃতি ছাড়াই আমেরিকা বিরোধী মনোভাব পোষন করার ফলে এটা আমেরিকাকে একটা কঠিন অবস্থার সম্মূক্ষীন করেছে। এছাড়াও, অপসারিত রাজনৈতিক সরকার যারা তৎকালীন রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিচালনা করতো তারা আমেরিকার প্রভাব বিস্তারের জন্য সামরিক কর্তৃপক্ষ (যেমন: SCAF) ছাড়া আর অন্য কোন নিরাপদ মাধ্যমই খোলা রাখে নি।

তার উপর, তিয়ানমেন স্কয়ারের নৃশংস হত্যাকান্ডের রক্তাক্ত দৃশ্যপটের অবতারনার পাশাপাশি জাতির (দেশের) প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচিত সরকার অপসারণ (পতন) আমেরিকার জন্য খুবই নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ‘বৈদেশিক সাহায্য আইন ১৯৬১’-এর ৫০৮ ধারা মতে, “যদি কোথাও সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে তাহলে সেখানে আমেরিকাকে অবশ্যই সামরিক সাহায্য বন্ধ করতে হবে। ”

এজন্য এতে অবাক হওয়ার কিছুই থাকে না যে, মিশরীয় সেনাবাহিনীর গণতন্ত্র পূনঃস্থাপনের দাবী যতই সময় যাচ্ছে ততোই ওবামা প্রশাসন সামরিক অভ্যুত্থানের মত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো অনুধাবন করতে ব্যর্থ (ধরাশায়ী) হচ্ছে। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে মিশরীয় সেনাবাহিনীকে সাহায্য সহযোগীতা স্থগিত করার ক্ষেত্রে আমেরিকা অনীহা পোষন করছে এবং আজ অবধি দোষারোপমূলক কিছু অলংকারবহুল মন্তব্যের মাঝেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামার অভিপ্রায় বিশিষ্ট মন্তব্যগুলো তার অবকাশ সময়ব্যাপী বিপনীকেন্দ্রের আঙ্গুরক্ষেত্র মাত্র। আমেরিকা ও মিশরের মধ্যকার এইসব দুষ্কর্মের সহযোগীতা প্রতিফলিত হয়েছে এবং আমেরিকা তার নীতির মাঝে পরিবর্তনের কোন ইঙ্গিত দেয় নি। এই ‘জটিল পরিস্থিতি’ আমেরিকার জন্য উভয় সংকটাবস্থার সৃষ্টি করেছে যেক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তিত হলে তা তার জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে ।

এইসব উপায় (option) গুলো নিম্নরূপ:

১. মিশরীয় সেনাবাহিনী হতে সামরিক সহযোগীতা স্থগিতকরণ:
এটা মূলত এই অঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব বিস্তার করার বিদ্যমান মাধ্যমের সমাপ্তি ঘটাবে। পাশাপাশি, মধ্যপ্রাচ্যে কোন শক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন অবশিষ্ট না থাকায়, যা কিছু SCAF দ্বারা পরিপূর্ণ হত তা বেসামরিক বা সামাজিক স্বার্থন্বেষী গোষ্ঠীর মধ্য থেকে আমেরিকা একই ভাবে দালাল নিযুক্ত করবে এটা আর মোটেও সম্ভব নয়।

২.সশস্ত্র বাহিনীতে আর্থিক সহযোগীতা চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে মিশরীয় সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখা:

এটা ‘গণতন্ত্রের উন্নয়ন’-এর নীতি বজায় রাখার যে কোন আশাকে খর্ব করবে যা বুশ প্রশাসনের সেই ‘চরমপন্থা’ দমনের ব্যর্থতার দিকে অনুসরনের সূত্রপাত ঘটাবে। আপাত দৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও এটাই সত্য যে, স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষে এই ধরনের কার্যসিদ্ধিমূলক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, পৃষ্টপোষক শাসন ব্যবস্থা ও ইসলামকামী ক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর মধ্যকার তিক্ততা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির দ্বারা আরো অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করবে।

৩. মুসলিম ব্রাদারহুড এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে আপোষমুলক মধ্যস্থতা সৃষ্টিকরণ:
পারস্পরিক ছাড় দেওয়ার উপর ভিত্তি করে কার্যসিদ্ধির লক্ষে একটা আপোষমুলক মধ্যস্থতা স্থির করার জন্য রাজনৈতিক অভিনেতাদের সংশ্লিষ্ট হওয়া উভয় দিক থেকেই অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে। প্রথমত; বিখ্যাত সিনেটর ম্যাক কেইনের মতো আমেরিকা তার কূটনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা যথেষ্ট হারিয়েছে। পাশাপাশি, মিশরের সংঘর্ষে লিপ্ত প্রত্যেক পক্ষই “আমেরিকা তার প্রতিপক্ষের মদদদাতা”-এমন দাবীর মাধ্যমে সমর্থন সংগ্রহের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত; সমাজের ‘ইসলামিস্ট’ ও বেসামরিক শক্তিগুলো এবং দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হাজেম আল-বাবলাউয়ি উভয়েই এ ব্যাপারে জোড় দিয়েছেন যে, ‘সামঞ্জস্য বিধান’ আর বেশিদিন কোন উপায় হতে পারে না। অপূর্ণকালীন অভ্যুত্থানের দ্বারা ঘৃন্য বেসামরিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এবং প্রতিক্রিয়াশীল রক্ষণশীল মহল ‘old guard’ –এর মধ্যে যে আপোষ-মিমাংসা সম্ভব হয়েছিল তা ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। যথাযথ ভাবেই এই সব মতানৈক্য গুলো আপোষ মিমাংসার অন্তর্ভূক্ত ছিল, যার ফলাফল ছিল মেরুকরণ এবং ৩০ জুন এর প্রত্যাশিত নাটকীয় ঘটনাগুলো।

পরিশেষে বলা যায়, আমেরিকা ও মিশরীয় সেনাবাহিনীর মধ্যকার অংশীদারিত্ব সম্পর্ক জড়তা ও আত্মপ্রসাদ দ্বারা ভারী হয়ে ফুটে উঠেছে। সম্প্রতিকালে এটা এমন এক অবস্থায় দাড়িয়েছে যে, শক্তি ও সামর্থ্যের এই ধরনের অবস্থা সৃষ্টির পর আমেরিকার জন্য ‘মিশর বিজয়’ পুরোপুরি অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে, যা তার উত্তরাধিকারীকে রাজ্যদানের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। গ্রহণ করার মত শেষ ৩টি উপায়-ই ওবামার জন্য অনুপযোগী দেখা যাচ্ছে, যেখান থেকে তার প্রশাসন অবশ্যই সেটাকেই পছন্দ করবে যেটাতে নিজ দেশের লাভের (স্বার্থ) বাহিরে সবচেয়ে কম ক্ষতি হবে। যাইহোক, উপায়গুলোর কথা বাদ দিলেও এ বিষয়টা খুবই স্পষ্ট যে, ‘soft’ power এবং ‘democracy promotion’ করার ভিত্তিতে নির্মিত কৌশল প্রয়োগের অবশিষ্ট স্বপ্নটুকুও আরব মুসলিম বিশ্বে বিদ্যমান থাকা এখন আর কোন ভাবেই সম্ভব নয়।

প্রবন্ধটি রেভলুশন অবজারভারে প্রকাশিত একটি বিশ্লেষন হতে নেয়া এবং কিছুটা পরিমার্জিত
অনুবাদ করেছেন: আফজালুল ইসলাম

Leave a Reply