আল্লাহর রাসূল (সা) অবশেষে মদীনায় এসে পৌঁছালেন এবং বিপুল সংখ্যক মদীনাবাসী তাঁকে সানন্দে বরণ করে নিলো। এদের মধ্যে মুসলিম, ইহুদী ও মূর্তিপূজারী সবধরনের মানুষই ছিলো। মদীনাবাসী অধীর আগ্রহে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলো এবং সকলেই সাক্ষী হতে চেয়েছিলো সেই আনন্দঘন মূহুর্তের, যখন আল্লাহর রাসূল (সা) উপস্থিত হবেন তাঁর নতুন আবাসভূমিতে। সেখানে উপস্থিত হওয়া মাত্রই মুসলিমরা তাকে ঘিরে ধরলো এবং আন্তরিক আথিতেয়তার মাধ্যমে তাঁর সেবাশ্রষশার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। বস্তুতঃ ইসলামের আহবানকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তারা তাদের জীবন বাজি রাখতেও প্রস্তুত ছিলো।
আনসারদের মধ্যে সবাই চাচ্ছিলো যেন নবী (সা) তার গৃহেই অবস্থান করে। কিন্তু রাসূল (সা) তাঁর উটনীর রশি ছেড়ে দিলেন। উটনী নিজের ইচ্ছা মতো পথ চলতে চলতে একসময় আমর গোত্রের সন্তান সাহল ও সুহাইলের গুদামঘরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। পরবর্তীতে রাসূল (সা) এই দুই ইয়াতীম শিশুর কাছ থেকে এ জায়গাটি ক্রয় করে নেন এবং এখানেই তাঁর মসজিদ ও এর চারপাশ ঘিরে তাঁর বাসগৃহ নির্মাণ করেন। মসজিদ ও বাসগৃহ নির্মাণের ক্ষেত্রে রাসূল (সা) খুবই সহজলভ্য ও সাধারন উপকরণ ব্যবহার করায় নির্মাণ কাজ খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যায়। মূলতঃ মসজিদটি ছিলো একটি বড় হলঘর, যার চারপাশ ইটের তৈরী দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিলো। এর ছাদের কিছু অংশ ছিলো খেজুর শাখা দিয়ে আবৃত, আর বাকীটা ছিলো খোলা। মসজিদের কিছু অংশ ব্যবহার করা হতো দরিদ্র ও গৃহহীন মানুষের আশ্রয়স্থল হিসাবে। এশার নামাজের সময় ছাড়া আর কখনোই মসজিদে আলো জ্বালানো হতো না। সাধারনত খড়ের তৈরী মশাল দিয়েই করা হতো এ আলোর ব্যবস্থা।
রাসূল (সা) এর জন্য তৈরী ঘরগুলোও মসজিদের মতোই সাধারন ছিলো, শুধুমাত্র মসজিদ থেকে একটু বেশী আলোকিত ছিলো। আল্লাহর রাসূল(সা) মসজিদ ও তাঁর গৃহ নির্মাণ এর সময়টুকুতে আবি আইয়ুব খালিদ ইবন যায়িদ আল-আনসারির গৃহে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হবার সাথে সাথেই নিজগৃহে চলে আসলেন। এখানে আসার পর, রাসূল (সা) ভাবতে লাগলেন তাঁর নতুন জীবন সর্ম্পকে, কিভাবে ইসলামী দাওয়াত এক অধ্যায় থেকে অন্য অধ্যায়ে প্রবেশ করলো, একেবারে ইসলামী ব্যক্তিত্ব তৈরীর পর্যায় থেকে একটি কুফর সমাজের সাথে ইসলামী আদর্শের সাংঘর্ষিক পর্যায় এবং সবশেষে একটি ইসলামী সমাজ যেখানে মানুষের উপর কার্যকরী হবে ইসলামের বিধিবিধান। তিনি ভাবতে লাগলেন এ নতুন যুগের সূচনা সম্পর্কে, যা তাকে মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করার পর্যায় ও অসহনীয় অত্যাচার-নির্যাতন থেকে নিয়ে এসেছে শাসন-কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা অর্জনের পর্যায়ে এবং প্রাপ্য এ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বই এখন ইসলামকে রক্ষা করবে, নিরাপত্তা দেবে এবং ইসলামের আহবানকে ছড়িয়ে দেবে পৃথিবীব্যাপী। মদীনায় আসার পর পরই রাসূল (সা) মসজিদ নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন এবং এ মসজিদেই তিনি নামাজ পড়াতেন, সাহাবীদের সাথে আলোচনা ও পরামর্শ করতেন। এখানেই তিনি মদীনার জনসাধারনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করতেন ও তাদের মধ্যে বিচার-ফায়সালা করতেন। তিনি (সা) এ সকল কাজে আবু বকর (রা) ও ওমর (রা)-কে তাঁর দুই সহকারী হিসাবে নিযুক্ত করলেন, বললেন, “এ পৃথিবীতে আবু বকর ও ওমর হচ্ছে আমার দুই সহকারী”।
মুসলিমরা সাধারনত সকল বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ এবং জীবনসম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনা নেবার জন্য রাসূল (সা)-এর চারপাশে সমবেত হতো। এভাবে, তিনি সদ্যগঠিত এ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান, বিচারক এবং সেনাপতির ভূমিকা গ্রহন করলেন। তিনি (সা) মুসলিমদের সব বিষয় সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতেন, তাদের মধ্যকার বিভিন্ন ঝগড়া-বিবাদেরও ফয়সালা করতেন, নিযুক্ত করতেন মুসলিম সৈন্যবাহিনীর বিভিন্ন অংশের প্রধান এবং সেনাবাহিনীকে মদীনার বাইরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মিশনে পাঠাতেন।
আল্লাহর রাসূল (সা) মদীনার উপস্থিত হবার দিন থেকেই ইসলামী রাষ্ট্রের সূচনা করেছিলেন এবং পুরো সমাজকে পরিবর্তন করে এ রাষ্ট্রকে একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর উদ্যেগ নিয়েছিলেন। একই সাথে এ রাষ্ট্র রক্ষা করা ও দ্বীন ইসলামের আহবান সর্বত্র ছড়িয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন প্রয়োজনীয় সৈন্যবাহিনী। বস্তুতঃ এ সবকিছুর মাধ্যমেই তিনি আল্লাহর দ্বীনকে পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত করতে সকল বস্তুগত বাঁধা সফলতার সাথে দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন।