ইসলামী রাষ্ট্র – পর্ব ১১ (আকাবার দ্বিতীয় শপথ)

[নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘আদ-দাওলাতুল ইসলামীয়্যাহ’ (ইসলামী রাষ্ট্র) বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে নেয়া হয়েছে]

আকাবার প্রথম শপথ ছিলো মুসলিমদের জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমত ও সাহায্য। কারণ, যদিও এ শপথের সময় মাত্র অল্পকিছু মদীনাবাসী ইসলাম গ্রহন করেছিলো, তারপরও মুসা’ব (রা) এর একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার ফলে মাত্র একবছরের মধ্যে মদীনাবাসীর মধ্যে প্রচলিত ভ্রান্ত ও ঘুঁণেধরা ধ্যান-ধারনা ও আবেগ-অনভূতিগুলো পরিবতির্ত হয়ে গিয়েছিলো। যা কিনা মক্কায় এর থেকে অনেক বেশী সংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহন করার পরও সম্ভব হয়নি। মক্কার জনগোষ্ঠির একটা বিরাট অংশ নিজেদের ইসলামের আহবান থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলো এবং ইসলামকে সম্পূর্নভাবে প্রত্যাখান করেছিলো, ফলে, সে সমাজকে ইসলামের প্রচারিত আদর্শের সৌন্দর্য তেমন ভাবে নাড়া দিতে পারেনি। অপরদিকে, মদীনার বেশীর ভাগ মানুষই ইসলাম গ্রহণ করেছিলো এবং ইসলামী চিন্তা-চেতনা ও আদর্শ সামগ্রিক ভাবে মদীনাবাসীদের হৃদয়কে প্রচন্ড ভাবে নাড়া দিয়েছিলো, যা পরিবর্তন করেছিলো তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে লালিত ক্ষয়ে যাওয়া ধ্যান-ধারনা ও চিন্তাকে। এ ঘটনা সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণ করে যে, যখন ব্যক্তিগত ভাবে কিছু সংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে এবং তারা সমাজ ও গণমানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, তাদের বিশ্বাস বা ঈমান যত দৃঢ়ই হোক না কেন তা সামগ্রিকভাবে সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে না, আর না ইসলামী চিন্তা-চেতনা সমাজের মানুষের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। এ ঘটনা আরও প্রমাণ করে যে, দাওয়াতী কার্যক্রমে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহনকারীর সংখ্যা যত কমই হোক না কেন, মানুষে মানুষে বিদ্যমান সম্পর্কগুলোকে যদি সঠিক চিন্তা-চেতনা ও আবেগ-অনুভূতির মাধ্যমে প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত করা সম্ভব হয়, তবে এটাই সমাজকে প্রত্যাশিত পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করে। এ ঘটনাগুলো থেকে আরও প্রমাণিত হয় যে, যখন কোন সমাজ কুফর ধ্যান-ধারনা ও আদর্শকে শক্তভাবে আকঁড়ে থাকে (যেমন ছিলো মক্কার সমাজ), এ ধরনের সমাজে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত এ সব চিন্তা-চেতনাকে পরিবর্তন করে সামগ্রিকভাবে সমাজ পরিবর্তন করা খুবই কঠিন। আবার অপরদিকে, যে সমাজে এ কুফর চিন্তা-চেতনার শেকড়গুলো অপেক্ষাকৃত দূর্বল (যেমনটা ছিলো মদীনার সমাজ), সে সমাজে সামগ্রিকভাবে সমাজের মানুষের ধ্যান-ধারনার পরিবর্তন ঘটানো সহজ যদিও সে সমাজে কুফর বা ভ্রান্ত ধ্যান-ধারনাগুলো উপস্থিত থাকে।

মূলতঃ এ কারণেই ইসলামের আহবান মক্কাবাসীর তুলনায় মদীনাবাসীকে অনেক বেশী প্রভাবিত করেছিলো। মদীনার জনগণ এটা বুঝতে পেরেছিলো যে, তাদের মাঝে প্রচলিত ধ্যান-ধারনা ও চিন্তা-চেতনাগুলো অসাড় ও ভ্রান্ত এবং তারা জীবন সম্পর্কে এর বিকল্প কোন আদর্শ বা ধ্যান-ধারনার সন্ধান করছিলো। ঠিক বিপরীতভাবে, মক্কার সমাজের মানুষেরা তাদের মাঝে প্রচলিত ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠিত আদর্শ নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলো এবং এ ভ্রান্ত ধ্যান-ধারনাগুলো পরিবর্তিত হয়ে যাবার আশঙ্কায় খুবই ব্যতিব্যস্ত ছিলো। বিশেষ করে, মক্কার নেতৃস্থানীয় কিছু ব্যক্তি যেমন, আবু লাহাব, আবু জাহল এবং আবু সুফিয়ান এর মতো লোকেরা এ ব্যাপারে খুবই সোচ্চার ছিলো। মূলতঃ এ কারনেই মুসা’ব ইবন উমায়ের মদীনাতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সে সমাজের মানুষের কাছ থেকে ব্যাপকভাবে সাড়া পেয়েছিলেন, তিনি গণমানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করেছিলেন এবং তাদেরকে সত্য দ্বীনের শিক্ষা ও আইন-কানুনে শিক্ষিত করেছিলেন। তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন মদীনার জনগণের ইসলামের আলোকিত আহবানে দ্রুত সাড়া দেবার ও ইসলাম গ্রহন করার মতো মনমানষিকতা। শুধু তাই নয়, মদীনাবাসীর ছিলো ইসলামী আদর্শকে পরিপূর্ণ জানার ও আল্লাহ প্রদত্ত আইন-কানুনগুলো শেখার একান্ত প্রচেষ্টা, যা মুসা’ব (রা) এর অন্তরকে করেছিলো আনন্দে উদ্ভাসিত। এভাবে, তার চোখের সামনেই মদীনায় মুসলিমদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো এবং মুসা’ব ইবন উমায়ের দ্বিগুন উৎসাহের সাথে তার দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে লাগলেন।

এরপর যখন হজ্জের মৌসুম আসলো, মুসা’ব (রা) মক্কায় ফিরে আসলেন এবং মুহাম্মদ (সা) এর কাছে মদীনায় মুসলিমদের সংখ্যা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি এবং সেখানে ইসলামের দ্রুত প্রসারের কথা জানালেন। তিনি জানালেন কিভাবে শুধুমাত্র আল্লাহর রাসূল (সা) মদীনার ঘরে ঘরে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে এবং ইসলাম এ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। তিনি আরও জানালেন মদীনার সমাজে মুসলিমদের শক্তি-সামর্থ্য ও প্রতিরোধ ক্ষমতার কথা, যা ইসলামকে সে সমাজে প্রভাবশালী অস্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি বললেন, মদীনার কিছু কিছু মুসলিমদের ঈমান এতো দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ যে, তারা এ বছরই মক্কায় আসতে চায়।

আল্লাহর রাসূল (সা) মুসা’ব ইবন উমায়ের এর কাছ থেকে এ সব সংবাদ শুনে খুবই আনন্দিত হলেন এবং মক্কার সমাজের সাথে মদীনার সমাজের তুলনা করে গভীর ভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন, একনাগারে গত বারোটি বছর ধরে তিনি মক্কার মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করছেন, সম্ভাব্য সকল উপায়ে চেষ্টা করেছেন, তার প্রতিদিনের প্রতিটি মূহুর্ত তিনি দাওয়াতী কাজে ব্যয় করেছেন, প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন, এ সবকিছু করতে গিয়ে সবধরনের জুলুম, অত্যাচার ও নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু, এতো কিছুর পরও মক্কাবাসী এখনও নিমজ্জিত রয়েছে মিথ্যা অহমিকা আর অন্ধ গোয়ার্তুমির নিকষ কালো অন্ধকারে। মক্কাবাসীর প্রচন্ড নিষ্ঠুর, বরফ কঠিন  ও  অনুশোচনাবিহীন  হৃদয়ে  তার  প্রাণান্তকর  এ  প্রচেষ্টা বিন্দুমাত্র আচঁড় কাটতে পারেনি, বরং  তাদের  দূর্ভেদ্য  অন্তর  পূর্বের মতোই পূর্বপুরুষদের ভ্রান্ত ধ্যান-ধারনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মক্কার জনসাধারন ছিলো খুবই রূঢ় প্রকৃতির এবং তাদের অন্তরে মুর্তিপূজার মতো বিকৃত ধ্যান-ধারনার  শেকড়  ছিলো  গভীর  ভাবে  প্রোথিত।  মূলতঃ  এ  কারনেই  তারা  ইসলামের  আলোকিত  আদর্শে  সাড়া  দিতে  ব্যর্থ হয়েছিলো এবং নিমজ্জিত ছিলো শিরকের মতো ভয়ঙ্কর পাপে। অপরদিকে, মদীনার চিত্র ছিলো একেবারেই অন্যরকম। খাযরাজ গোত্রের একদল মানুষ ইসলাম গ্রহন করার পর একবছর পার হতে না হতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিলো আকাবার প্রথম শপথ। পরবর্তীতে মুসা’ব ইবন উমায়েরের মাত্র একবছরের প্রচেষ্টায় সমস্ত মদীনা ইসলামী ধ্যান-ধারনার আলোকে এমন ভাবে উদ্দীপ্ত হলো যে, এটাই পরবর্তীতে অল্প সময়ের মধ্যে অবিশ্বাস্য সংখ্যক মানুষের ইসলাম গ্রহনের ভিত্তি তৈরী করেছিলো। অন্যদিকে, মক্কায় যারা ইসলাম গ্রহন করেছিলো তাদের মধ্যেই ইসলামের আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা সীমাবদ্ধ ছিলো। উপরন্তু, তারা হয়েছিলো কুরাইশদের নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার। কিন্তু, মদীনাতে ইসলামী আদর্শ বিস্তৃতি লাভ করেছিলো দ্রুত গতিতে আর ইসলাম গ্রহন করায় সেখানকার মুসলিমরা ইহুদী বা কাফিরদের কোনরকম অত্যাচার বা নির্যাতনেরও শিকার হয়নি। মূলতঃ এ অবস্থা মদীনাবাসীর অন্তরে ইসলামকে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করতে সাহায্য করেছিলো এবং মুসলিমদের জন্য উম্মোচিত করেছিলো ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করার নতুন দ্বার।

মুহাম্মদ (সা) এর কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো যে, মদীনাই হতে পারে সেই উজ্জ্বল বর্তিকা যেখান থেকে ইসলামের আদর্শ, ঈমান ও জীবন-ব্যবস্থার আলো বিচ্ছুরিত হতে পারে বিশ্বময়। অতঃপর তিনি (সা) মদীনায় হিজরতের সিদ্ধান্ত নিলেন, যা তাঁর সাহাবীদের তাদের মুসলিম ভাইদের সঙ্গী হবার সু্যোগ করে দিলো, তারা মুক্ত হলেন তাদের উপর আপতিত কুরাইশদের নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে এবং খুঁজে পেলেন একটি পবিত্র ও নিরাপদ আশ্রয়। রাসূল (সা)-এর এ পদক্ষেপ তাদের দাওয়াতী কার্যক্রমে সম্পুর্ণভাবে মনোনিবেশ করার সুযোগ করে দিলো এবং তারা খুব স্বাভাবিক ভাবেই পরবর্তী পর্যায়ের দিকে অগ্রসর হলেন, যেটা ছিলো মূলতঃ ইসলামকে বাস্তব জীবনে কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করা এবং ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থার সহায়তায় ইসলামের আহবানকে বলিষ্ঠভাবে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া।

এখানে এটা বলে রাখা দরকার যে, মুহাম্মদ (সা) দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে যে প্রচণ্ড পরিমাণ বাঁধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন, তা অতিক্রম করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা কিংবা এ ব্যাপারে চুড়ান্ত ধৈর্য্য ও একনিষ্ঠতার পরিচয় না দিয়েই শুধুমাত্র অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রক্ষা পাবার জন্য মদীনায় হিজরতের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেননি। তিনি মক্কায় দীর্ঘ দশটি বছর প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছেন, দাওয়াতী কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য গভীর ভাবে চিন্তা করেছেন। তিনি (সা) এবং তাঁর সাহাবীগণ এজন্য সবরকমের ভয়ঙ্কর অত্যাচার ও নির্যাতনকে হাসিমুখে বরণ করেছেন। কুরাইশদের নিষ্ঠুর অত্যাচার ও প্রবল প্রতিরোধ আল্লাহর রাসূল (সা)-কে এক মূহুতের্র জন্য লক্ষ্যচ্যুত করতে তো পারেইনি, উপরন্তু এ প্রবল প্রতিরোধ তাঁর ঈমানী শক্তি ও আল্লাহর বাণীর প্রতি তাঁর বিশ্বাসকে প্রতিনিয়ত নিয়ে গিয়েছে নতুন এক উচ্চতায়। তিনি (সা) নিশ্চিতভাবেই জানতেন আল্লাহর সাহায্য আসবে এবং এ নিশ্চিত বিশ্বাসই তাকে করেছিলো আরও দৃঢ়প্রত্যয়ী ও আশাবাদী। শুধু তাই নয়, তাঁর কাছে এটাও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো যে মক্কাবাসীর হৃদয় আসলে কতো কঠিনভাবে অন্ধ গোয়ার্তুমির মধ্যে নিমজ্জিত, তাদের অন্তর কতো সংকীর্ন এবং সর্বোপরি তারা কতো নিষ্ঠুর ও পথভ্রান্ত। এ বাস্তবতা থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মক্কায় ইসলামের বিজয়ের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীন এবং তাঁর সকল প্রচেষ্টা হবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত। মূলতঃ এ কারনেই মক্কা ত্যাগ করা ও এর বিকল্প কোন স্থানের সন্ধান করা ছিলো খুবই জরুরী। আর তাই, এ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই তিনি (সা) মদীনায় হিজরতের সিদ্ধান্ত নেন। সুতরাং, অত্যাচার বা নির্যাতন নয়, এ কারণগুলোই ছিলো তাঁর ও সাহাবীদের মক্কা থেকে হিজরত করার এক ও একমাত্র কারণ।

এছাড়া, একই সাথে এটাও সত্য যে, রাসূল (সা) তাঁর সাহাবীদেরকে কুরাইশদের নিষ্ঠুর ও ভয়ঙ্কর অত্যাচার থেকে রক্ষার জন্য তাদের আবিসিনিয়া

হিজরত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারণ, যদিও নিমর্ম নির্যাতন ও অত্যাচার মুসিলমদের ঈমানী শক্তি ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসকে দৃঢ় করে, বাতিল শক্তির প্রবল প্রতিরোধ মুসলিমদের আরো প্রত্যয়ী করে তোলে, তারপরও জীবন রক্ষার তাগিদে নির্যাতনস্থল ত্যাগ করার অনুমতিও ইসলাম দিয়েছে। বস্তুতঃ এ দৃঢ় ঈমানী শক্তি থেকেই মুসলিমরা অবলীলায় আল্লাহর জন্য সকল দুঃখ-কষ্টকে তচ্ছু তাচ্ছিল্য করতে পারে। নির্দিধায় তারা উৎসর্গ করতে পারে নিজ জীবন সহ তাদের ধনসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, মানসিক স্বস্তি সহ সবকিছু। কিন্তু, তারপরও কোন কোন সময় বিরতিহীন অসহনীয় অত্যাচার ঈমানদারদের হাঁপিয়ে তোলে। তখন সঙ্গত কারনেই তাদের সকল প্রচেষ্টা দাওয়াতী কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কিংবা সত্যদ্বীনকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করার থেকে, নিজেকে ক্রমাগত অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে টিকিয়ে রাখাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। এ কারনেই মুসলিমদের এই জুলুম আর অত্যাচারের রাজত্ব থেকে হিজরত করে পাড়ি জমাতে হয়েছিলো আবিসিনিয়ায়।

যাই হোক, তাদের দ্বিতীয়বার হিজরত করতে হয়েছিলো সম্পূর্ন ভিন্ন কারণে। বস্তুতঃ দ্বিতীয়বার মুসলিমরা তাদের দ্বীনকে প্রাত্যহিক জীবনে ও সমাজে কার্যকর ভাবে প্রয়োগ করার জন্যই রাসূল (সা) সহ হিজরত করেছিলো। তারা তৈরী করতে চেয়েছিলো একটি পরিপূর্ণ ইসলামী সমাজ, যেখান থেকে তারা ইসলামের আহবানকে ছড়িয়ে দেবে সারা বিশ্বে। মূলতঃ এ রকম একটি প্রেক্ষাপটেই আল্লাহর রাসূল (সা) সাহাবীদের মদীনায় হিজরত করার বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু, এ সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে তাঁর প্রয়োজন ছিলো হজ্জ্ব করতে আগত মদীনার মুসলিমদের সাথে সাক্ষাৎ করা, দ্বীন ইসলামকে রক্ষা করার জন্য তাদের স্বতঃস্ফুর্ততাকে পরীক্ষা করা এবং সর্বোপরি ইসলামের জন্য তারা কতোটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত তা পর্যালোচনা করা। তাঁর এটাও নিশ্চিত করার প্রয়োজন ছিলো যে, মদীনার মুসলিমরা তাঁর সঙ্গে আনুগত্যের শপথে আবদ্ধ হবে এবং প্রয়োজনে তাঁর জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকবে, যা মূলতঃ তৈরী করবে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিভূমি।

এ অবস্থায় রাসূল (সা) হজ্জ্বযাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। এটা ছিলো ৬২২ খ্রীষ্টাব্দ, দাওয়াতী কার্যক্রমের বারোতম বছর। আগত বিপুল সংখ্যক হজ্জ্বযাত্রীর মধ্যে ৭৫ জন ছিলো মুসলিম (যার মধ্যে ৭২ জন ছিলো পুরুষ এবং ২ জন ছিলো নারী) । এদের মধ্যে একজন নারী ছিলো বনু মাযিন ইবন আল-নাজ্জার গোত্র থেকে আগত নুসাইবা বিনত কা’ব উম্ম আমারাহ্ এবং অন্যজন ছিলো বনু সালামাহ গোত্র থেকে আগত আসমা বিনত আমর ইবন আদি।

আল্লাহর রাসূল (সা) মুসলিম হজ্জ্বযাত্রীদের এ দলটির সাথে গোপনে সাক্ষাৎ করলেন এবং তাদেরকে দ্বিতীয় আনুগত্যের শপথের কথা জানালেন।

বস্তুতঃ এবারের অঙ্গীকার শুধুমাত্র দাওয়াতী কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও জুলুম-নির্যাতন থেকে নিরাপত্তা প্রদানের ব্যাপার সম্পর্কিত ছিলো না। বরং, এ অঙ্গীকারের সীমানা ছিলো বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এটা ছিলো মুসলিমদের সম্ভাব্য সকল আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে সামরিক শক্তি তৈরী করার অঙ্গীকার। এটা ছিলো ইসলামের এমন এক কেন্দ্রবিন্দু প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার, যা তৈরী করবে ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থার ভিত্তিভূমি। যে রার্ষ্টের থাকবে নিজেকে রক্ষা করার মতো প্রয়োজনীয় সামরিক শক্তি এবং সে শক্তি দূর করবে দ্বীন ইসলাম প্রচার ও প্রয়োগের পথে ছড়িয়ে থাকা সকল বাঁধা।

আল্লাহর রাসূল (সা) তাদের সাথে অঙ্গীকারের ব্যাপারে কথা বললেন, তাদের স্বতঃস্ফুর্ততাকে অনুভব করলেন। আবার, আগত মুসলিমরাও আইয়্যমে তাশরিকের দিনগুলোতে তাঁর সাথে আকাবার উপত্যকায় সাক্ষাৎ করতে সম্মত হলো। তিনি তাদের বললেন, “তোমরা কেউ কাউকে জাগাবে না, না কেউ অনুপস্থিত ব্যক্তির জন্য অপেক্ষা করবে।”তৃতীয় রাত্রি পার হবার পর তারা গোপনে আকাবা উপত্যকায় রাসূল (সা)-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য উপস্থিত হলো, যাদের মধ্যে আগত দু’জন মুসলিম নারীও ছিলো। আল্লাহর রাসূল (সা) সেখানে তাঁর চাচা আল-আব্বাসকে নিয়ে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত মুসলিমরা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলো। রাসূল (সা)এর চাচা তখন পর্যন্ত ঈমান না আনলেও তিনি চেয়েছিলেন তার ভাতিজার পূর্ণ নিরাপত্তা। বস্তুতঃ তিনিই প্রথম সংলাপ শুরু করেন এবং বলেন, “হে খাযরাজ সম্প্রদায়ের লোকেরা, তোমরা জানো যে মুহাম্মদের অবস্থান আমাদের কাছে কোথায়। আমরা তাকে এতোদিন পর্যন্ত নিজ সম্প্রদায়ের মানুষ হতে রক্ষা করে এসেছি। তিনি আমাদের মধ্যে পরিপূর্ণ সম্মান ও নিরাপত্তার সাথেই বসবাস করছেন। কিন্তু, এখন তিনি তোমাদের সাথে বসবাস করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যদি তোমরা মনে করে থাকো যে, তোমরা তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারবে এবং তাঁর প্রতি কৃত অঙ্গীকার পালন করে তাকে শত্র থেকে নিরাপত্তা দিতে পারবে, তাহলে তোমরা এ দায়িত্ব গ্রহন করো। আর যদি তোমরা মনে করে থাকো যে, তোমরা তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং বিপদে তাঁকে  পরিত্যাগ  করবে,  তবে  তা  এখনই  জানিয়ে  দাও।”  প্রত্তুতরে  তারা  বললো, “আমরা  শুনেছি  আপনি  কি  বলেছেন।  হে  আল্লাহর  রাসূল,  এখন আমরা আপনার কথা শুনতে চাই। আপনি আপনার ও আপনার রবের জন্য যা ইচ্ছা পছন্দ করুন।” রাসূলুল্লাহ (সা) কুরআন তিলওয়াত করার পর তাদের বললেন, “আমি তোমাদের কাছে এই অঙ্গীকার চাই যে, তোমরা আমাকে রক্ষা করবে সেভাবে, যেভাবে তোমরা তোমাদের নারী ও সন্তানদের রক্ষা করো।” আল-বারা (রা) শপথ গ্রহনের জন্য তার হাত উঠালেন এবং বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমরা আপনার পূর্ণ আনুগত্যের শপথ করছি। আল্লাহর কসম, আমরা হচ্ছি যোদ্ধাজাতি। যুদ্ধ ও অস্ত্রের ঝনঝনানি বংশ পরম্পরায় আমাদের ধমনীতে প্রবাহিত হয়েছে।”

আল-বারা (রা) কথার মাঝেই আবু আল-হাইছাম ইবন আল-ছাইহান প্রবেশ করলেন এবং বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের অন্য সম্প্রদায়ের (ইহুদী) সাথে মৈত্রী চুক্তি রয়েছে, আমরা যদি সে চুক্তি ছিন্ন করে আপনার পক্ষ অবলম্বন করি এবং তারপর যদি আল্লাহ আপনাকে বিজয় দান করেন, তবে কি আপনি আমাদের ছেড়ে আপনার নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসবেন?” এ কথার উত্তরে আল্লাহর রাসূল (সা) হেসে বললেন, “না, এখন থেকে তোমাদের রক্তই আমার রক্ত এবং তোমাদের কাছে যা পবিত্র আমার কাছেও তা পবিত্র। আমি তোমাদের একজন এবং তোমরা আমাদের। আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং তাদের সাথে শান্তিচুক্তি করবো যারা তোমাদের সাথে সন্ধি করবে।”অতঃপর আল-’আব্বাস ইবন ’উবাদাহ (রা) বললেন, “হে খাযরাজ গোত্রের লোকেরা, তোমরা কি বুঝতে পারছো তোমরা কোন বিষয়ে সহায়তা দেবার জন্য এ ব্যক্তির সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ হচ্ছো? এর অর্থ হচ্ছে যে কোন মূল্যে তাঁর জন্য লড়াই করা। তোমরা যদি সম্পদ হারানোর ভয় করে থাকো, তোমাদের মধ্যে সম্মানিত ব্যক্তিদের নিহত হবার আশঙ্কা করে থাকো, তাহলে এখনই পিছু হটে যাও।

আল্লাহর কসম, যদি তোমরা তা করো, তবে এ দুনিয়া ও আখেরাতে তোমরা হবে চরম ভাবে লাঞ্চিত। কিন্তু, যদি তোমরা আনুগত্যের শপথ পূর্ণ করো, তবে তোমাদের সম্পদের ক্ষতি বা সম্মানিত ব্যক্তিরা নিহত হলেও এটাই তোমাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে বয়ে নিয়ে আসবে সাফল্য।” মদীনার মুসলিমদের দলটি এ সকল শর্তেই আল্লাহর রাসূল (সা) এর আনুগত্য মেনে নিলো এবং জিজ্ঞেস করলো, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনার আনুগত্য করার বিনিময়ে আমরা কি পাবো?” রাসূলুল্লাহ (সা) দৃঢ় ভাবে উত্তর দিলেন, “জান্নাত।”

তারা তাদের হাত বাড়ালেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-ও তাঁর হাত বাড়ালেন, অতঃপর তারা এ বলে আল্লাহর রাসূল (সা)-এর সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন যে, “আমরা এই বলে শপথ গ্রহন করছি যে, আমরা সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ সর্বাবস্থায়ই আপনার আনুগত্য করবো। সর্বদা সত্য কথার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবো এবং আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করতে কারো সামনেই মাথা নত করবো না”। শপথ গ্রহন শেষে আল্লাহর রাসূল (সা) বললেন, “তোমাদের মধ্যে সমাজে নেতৃস্থানীয় যে বারোজন আছে, তাদের আমার কাছে নিয়ে আসো।” তারা খাযরাজ গোত্র থেকে নয়জন এবং আউস গোত্র থেকো তিনজনকে নিয়ে আসলেন। রাসূল (সা) এ সকল গোত্র প্রধানদের বললেন, “তোমরা তোমাদের জনগণের উপর দায়িত্বশীল, যেভাবে ঈসা(আ) ছিলেন তাঁর অনুসারীদের উপর দায়িত্বশীল। আর আমি আমার লোকদের উপর দায়িত্বশীল।”একথা শোনার পর তারা যে যার শয্যায় ফিরে গেলেন, অতঃপর নিজ নিজ ক্যারাভানে পৌঁছে মদীনায় ফিরে আসলেন।

তারপর, আল্লাহর রাসূল (সা) মুসলিমদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মদীনায় হিজরত করার নির্দেশ দিলেন এবং মুসলিমরাও এ নির্দেশ অনুযায়ী একাকী কিংবা ছোট ছোট দল গঠন করে মক্কা ত্যাগ করতে শুরু করলো। ইতিমধ্যে কুরাইশদের কাছে শপথ গ্রহনের খবর পৌঁছে গেলে তারা মুসলিমদের হিজরতে বাঁধা দিতে লাগলো। তারা স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মাঝে এসে দাঁড়ালো যেন তারা মক্কা ত্যাগ না করতে পারে। কিন্তু, তা সত্তেও মুসলিমদের মক্কা থেকে মদীনা যাত্রা অব্যাহত থাকলো। আল্লাহর রাসূল (সা) মক্কায় রয়ে গেলেন এবং তিনি আদৌ মদীনায় যাবেন কিনা এ ধরনের কোন ইঙ্গিতও কাউকে দিলেন না। কিন্তু, বিভিন্ন ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে, তিনিও মক্কা ত্যাগ করবেন। মুহাম্মদ (সা) কিছু না বলা পর্যন্ত আবু বকর (রা) তাঁর কাছে হিজরতের অনুমতি চাইতে থাকলেন। এক পর্যায়ে, আল্লাহর রাসূল (সা) বললেন, “এতো তাড়াহুড়ো করো না, এমনও হতে পারে যে আল্লাহ তোমার জন্য একজন সফরসঙ্গী নির্ধারন করে দেবেন।” আবু বকর (রা) তখন বুঝতে পারলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) হিজরত করতে চাচ্ছেন।

আল্লাহর রাসূল (সা) মদীনায় হিজরত করবেন এটা বুঝতে পেরে কুরাইশরা খুবই চিন্তিত হয়ে গেলো। কারণ, তারা জানতো যে মদীনায় মুসলিমদের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নিঃসন্দেহে সেখানে মুসলিমরা এখন অনেক বেশী শক্তিশালী। তার উপর যদি মক্কার মুসলিমরাও মদীনায় হিজরত করে তবে মুসলিমদের প্রভাব-প্রতিপত্তি স্বভাবতই আরও বৃদ্ধি পাবে। তারা এটাও আশঙ্কা করছিলো যে, রাসূল (সা) যদি কোনভাবে মদীনায় গিয়ে পৌঁছাতে পারে তাহলে তাদের অস্তিত্ব হবে বিপন্ন। এজন্য তারা রাসূলুল্লাহ (সা) এর মদীনা গমন কিভাবে ঠেকানো যায় তা নিয়ে দিনরাত চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলো। আবার চিন্তা করে দেখলো যে, রাসূলুল্লাহ (সা) যদি মক্কায়ও থেকে যায় তাহলেও মদীনার মুসলিমরা তাদের নবীর সম্মান রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হবে কুরাইশদের বিরুদ্ধে। তখন তাদের সংঘবদ্ধ এ শক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করা হয়ে যাবে আরেক সমস্যা। সবদিক ভেবেচিন্তে তারা মদীনার মুসলিম, ইসলাম এবং মুহাম্মদের সাথে সম্ভাব্য সকল সংঘর্ষ এড়ানোর লক্ষ্যে আল্লাহর রাসূল (সা)-কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলো এবং সেইসাথে নবী (সা)-কে মদীনায় হিজরতে বাঁধা দেবার কৌশল অবলম্বন করলো।

সীরাতের গ্রন্থগুলোতে ’আয়িশা (রা) এবং আবু উমামাহ ইবন শাম কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, আকাবার উপত্যকায় ৭৩ জন মুসলিম উপস্থিত হয়ে

যখন মুহাম্মদ (সা)-কে নিরাপত্তা ও সবরকম সহায়তা দিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলো, তখন থেকেই হিজরত করতে চাওয়ায় মক্কার মুসলিমদের উপর কাফিরদের অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা প্রচন্ড আকার ধারণ করলো। কুরাইশরা তাদের যেখানে সেখানে অপমান ও বিভিন্ন ভাবে আক্রমণ করতে লাগলো। তারা এ ব্যাপারে মুহাম্মদ (সা)এর কাছে অভিযোগ করলে তিনি উত্তরে বললেন, “আমাকে তোমাদের হিজরতের জন্য বাসভূমি নির্ধারন করে দেয়া হবে।

এর কিছুদিন পরেই তিনি অত্যন্ত আনন্দের সাথে বললেন, “আমাকে বলা হয়েছে যেন তোমরা ইয়াসরিবে (মদীনায়) হিজরত করো। যে ব্যক্তি সেখানে যেতে চায় সে যেন নিশ্চিন্তে তার যাত্রা শুরু করে।” এ নির্দেশের পরপরই মুসলিমরা শহর ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো । তারা গোপনে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মক্কা ত্যাগ করতে লাগলো। কিন্তু, আল্লাহর রাসূল (সা) তখনও তাঁর নিজের ব্যাপারে আল্লাহর অনুমতির অপেক্ষা করছিলেন। আবু বকর (রা) তাকে বারবার এ ব্যাপারে প্রশ্ন করায় তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, “এতো তাড়াহুড়ো করো না, এমনও হতে পারে আল্লাহতায়ালা তোমার জন্য একজন সফরসঙ্গী নির্বাচন করে দেবেন”। আবু বকর (রা) মনে মনে প্রত্যাশা করতে লাগলেন যে, আল্লাহ তা’য়ালা হয়তো স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা)-কেই তাঁর সফরসঙ্গী হিসাবে নির্বাচন করবেন।

কুরাইশরা মুসলিমদের দলে দলে মক্কা ত্যাগের কথা জানার সাথে সাথেই বুঝতে পারলো যে, খুব শীঘ্রই লড়াই এর ময়দানে তাদের রাসূল (সা)-কে মুকাবিলা করতে হবে। তারা কুরাইশদের দারুল নাদওয়ার পরামর্শ কক্ষে একত্রিত হয়ে কিছুক্ষন তর্কবিতর্কের পর মুহাম্মদ (সা)-কে হত্যার সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। জিবরাইল (আ) মুহাম্মদ (সা)-কে এ ঘটনা অবহিত করলেন এবং তাকে নিজ শয্যায় না ঘুমানোর নির্দেশ দিলেন। সে রাত্রে তিনি(সা) তাঁর শয্যায় ঘুমানো থেকে বিরত থাকলেন এবং এ সময়েই আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের অনুমতি আসলো।

মদীনায় ইসলামের শক্তিশালী অস্তিত্ব হিসাবে আত্মপ্রকাশ, সেখানকার মানুষের মধ্যে আল্লাহর রাসূল (সা)-কে গ্রহণ করার মতো স্বতঃস্ফুর্ততা এবং সর্বোপরি সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র্ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাই মুহাম্মদ (সা)-কে মদীনায় হিজরত করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। যে কারও এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া বা এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করা একেবারেই অনুচিত হবে যে, কুরাইশরা তাকে হত্যা করে ফেলতে পারে এই ভয়ে তিনি (সা) মক্কা ত্যাগ করেছিলেন। তিনি (সা) তাঁর উপর আপতিত বিপদ-আপদ বা অত্যাচার-নির্যাতন নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত ছিলেন না, বরং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য সবসময়ই তাঁর জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন। বস্তুতঃ তাঁর হিজরতের মূল উদ্দেশ্যই ছিলো দাওয়াতী কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সেই সাথে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য অর্জনে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়া এটাও পরিষ্কার যে, কুরাইশরা মুহাম্মদ (সা)-কে হত্যা করতে চেয়েছিলো এই ভয়ে যে, তিনি মদীনায় পৌঁছে গেলে পূর্ণ নিরাপত্তা ও সামরিক শক্তির অধিকারী হবেন। কিন্তু, সর্বাত্মক প্রচেষ্টার পরও কুরাইশরা তাদের ষড়যন্ত্র সফল করতে ব্যর্থ হলো। রাসূল (সা) মদীনায় হিজরত করলেন এবং তাদের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণিত করে, তাঁর এ হিজরতের ঘটনাই ইসলামের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো। এটা মূলতঃ মানুষকে সত্য দ্বীনের পথে আহবানের অধ্যায় থেকে আল্লাহর দ্বীনের আলোকে একটি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার অধ্যায়ে প্রবেশ করলো। প্রতিষ্ঠিত হলো ইসলামী রাষ্ট্র যেখানে শাসন-কর্তৃত্ব হলো শুধুই আল্লাহর। এছাড়া  ইসলামী  রাষ্ট্র  আল্লাহর  দ্বীনকে  প্রাত্যহিক  জীবনে  বাস্তবভাবে  প্রয়োগ  করে,  যৌক্তিক প্রমাণের মাধ্যমে মানুষকে দ্বীনের পথে আহবান করলো এবং এর সামরিক শক্তি মুসলিমদের রক্ষা করলো সকল প্রকার বিপদ-আপদ এবং শত্রুদের জুলুম-নিপীড়ন ও অত্যাচার থেকে।

Leave a Reply