[নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘আদ-দাওলাতুল ইসলামীয়্যাহ’ (ইসলামী রাষ্ট্র) বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে নেয়া হয়েছে]
মক্কায় মুহাম্মদ (সা)-এর দাওয়াতী কার্যক্রমের মূলত দুটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে রাসূল (সা) সাহাবীদের দ্বীন শিক্ষা দেন এবং তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও আত্মিক উন্নতি ঘটান। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে দ্বীন ইসলামের প্রচার করেন এবং সেই সাথে শুরু হয় সংগ্রাম। প্রথম পর্যায়ের মূল লক্ষ্য ছিল দ্বীনের এই সম্পর্কে নতুন ধ্যান-ধারণা তাদের অন্তরে দৃঢ় ভাবে প্রোথিত করে সেই আলোকে তাদের চরিত্রকে গড়ে তোলা এবং তাদের সংগটিত করা। আর পরবর্তী পর্যায়ের লক্ষ্য ছিল এই আদর্শ ভিত্তিক ধ্যান-ধারণা গুলোকে এমন এক চালিকা শক্তিতে পরিণত করা যা সমাজের প্রতিটি স্তরে এগুলোকে বাস্তবায়ন করে সমাজকে একেবারে নতুন করে ঢেলে সাজানো। আসলে বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত যে কোন আদর্শ বা ধ্যান-ধারনাই হলো প্রাণহীন কতগুলো তত্ত্ব কথার সমষ্টি, জীবনে যার কোন বাস্তব প্রভাব নেই। নির্জীব এই সব তত্ত্ব কথাগুলোতে প্রাণের সঞ্চার করতে এবং এগুলো সমাজের প্রতিটি স্তরে কার্যকরী করতে প্রথমে প্রয়োজন এই ধ্যান-ধারণা গুলোকে প্রচন্ড এক চালিকা শক্তিতে পরিণত করা। যা সমাজের মানুষ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে গ্রহন করবে, এগুলোর গভীরতা অনুভব করবে, প্রচার করবে এবং সর্বোপরি এগুলোর বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করতে প্রস্তুত থাকবে। এরকম একটা পরিস্থিতেই কেবল সমাজে নতুন এই আদর্শকে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে ।
মুহাম্মদ (সা) ঠিক এ পদ্ধতিতেই মক্কায় তাঁর দ্বীন প্রচার করেছিলেন। প্রথম পর্যায়ে তিনি মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করেন, ইসলামী ধ্যান-ধারণার আলোকে তাদের চরিত্রকে গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ইসলামের নিয়ম নীতি গুলো শিক্ষা দেন। এ পর্যায়ে তিনি মানুষকে ইসলামী আকীদাহর (বিশ্বাস) ভিত্তিতে একত্রিত করতেন এবং গোপনে তাদেরকে দ্বীন শিক্ষা দিতেন। আল্লাহর রাসূল (সা) বিরতিহীন ভাবে মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করেন এবং প্রচন্ড নিষ্ঠার সাথে ইসলামের আলোকে তাঁর অনুসারীদের চরিত্র গড়ে তোলেন। তিনি তাদেরকে আল আরকাম (রা)-এর বাড়িতে একত্রিত করতেন অথবা নওমুসলিমের নিজ বাড়িতে বা উপত্যকায় কাউকে পাঠাতেন, যেখানে তারা গোপনে কয়েকজন একত্রিত হয়ে দ্বীন শিক্ষা করতেন। এভাবে তাদের মধ্যে ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে, তাদের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক গভীর হয় এবং সবোর্পরি নতুন এই দ্বীনকে তারা এমন ভাবে অনুধাবন করে যে, দ্বীন প্রচারের জন্য তারা সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
ইসলামের আদর্শ তাদের হৃদয়ে ও অন্তরে এমন ভাবে প্রোথিত হয়ে যায় যে, তাদের রক্তের প্রতিটি অনু পরমানুর মধ্যে মিশে যায় ইসলামী চিন্তা চেতনা এবং তারা প্রত্যেকে হয়ে যায় দ্বীন ইসলামের জীবন্ত উদাহরন। তাদের প্রতিটি কার্যকলাপের মাধ্যমে প্রকাশ পেতে থাকে ইসলামের সৌন্দর্য এবং তারা শত চেষ্টার পরও কুরাইশদের কাছ থেকে তাদের ইসলাম গ্রহনের সংবাদ গোপন করতে ব্যর্থ হয়।
তারা বিশ্বস্ত এবং ইসলাম গ্রহন করার মতো মন-মানষিকতা সম্পন্ন লোকদের সাথে কথা বলতে শুরু করেন। এভাবে, মক্কাবাসীরা তাদের আহবান সম্পর্কে জানতে শুরু করে এবং সমাজে তাদের অস্তিত্ব অনুভব করতে শুরু করে। এটা ছিল মূলতঃ দাওয়াতের প্রাথমিক পর্যায় এবং এরপর প্রয়োজন হয় ইসলামী আহবানকে সমাজের মাঝে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে দেয়ার। পরবর্তীতে যখন শুরু হয় ব্যাপক গণসংযোগ এবং ইসলামের আহবান লিপ্ত হয় সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারনার সাথে প্রকাশ্য সংঘর্ষে, মূলতঃ তখন থেকেই ইসলামী দাওয়াত নওমুসলিমদের একত্রিত করে তাদের দ্বীন শিক্ষা দেবার পর্যায় অতিক্রম করে দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করে। এ পর্যায়ে মানুষ ইসলামী আদর্শ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে শুরু করে। ফলে, কিছু মানুষ ইসলামের আহবানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহন করে আর বাকীরা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং এর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বস্তুত, কুফর ও বাতিলশক্তির উপর এবং ঈমান এবং ন্যায়পরায়নতা জয়লাভের পূর্বে এ ধরনের সংঘাত অনিবার্য। এছাড়া সত্যকে গ্রহন না করতে মানুষ যতই দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে, তাদের অন্তর সত্যের অর্নিবান শিখাকে পাশ কাটিয়ে যেতেও পারে না, আবার আলোকিত আদর্শ দিয়ে প্রভাবিত না হয়েও পারে না। না পারে তারা তাদের বিদ্বেষী মনোভাব দিয়ে সত্য বিকাশের পথকে চিরকালের জন্য রুখে দিতে।
এভাবেই কুফর আর ইসলামের প্রচন্ড রকম পরস্পর বিরোধী ধ্যান-ধারনার মাঝে সংঘাত ও সংঘষের্র মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে ইসলামী দাওয়াতের গণসংযোগ পর্যায়। এ পর্যায় শুরু হয় সেই সময় থেকে যখন আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর সাহাবীদের সঙ্গে করে এমন ভাবে কাবাঘর প্রদক্ষিন করেন যা মক্কাবাসীদের কাছে ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। মূলতঃ এই সময় থেকেই রাসূল (সা) কাফিরদের প্রচলিত জীবন-ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে প্রকাশ্যে সমাজের মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করেন।
এ সময় রাসূল (সা)-এর উপর অবতীর্ণ ওহী দ্বারা আল্লাহ সুবহানুওয়াতায়ালা তাঁর একত্ববাদের ঘোষনা দেন এবং একই সাথে কোরআনের আয়াতের মাধ্যমেই কুফর জীবন-ব্যবস্থা ও মুর্তিপুজাকে বাতিল বলে ঘোষনা করেন। এছাড়া, এ সময়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন সব আয়াত নাজিল হয় যেখানে কাফিরদের অন্ধভাবে তাদের পূর্বপুরুষদের জীবনধারাকে অনুকরন করাকে তীব্র ভাবে সমালোচনা করা হয়। আয়াত নাজিল হয় সমাজের প্রতারনাপুর্ণ লেনদেনের প্রকৃত চেহারা উম্মোচন করে, যে সকল আয়াতে সুদভিত্তিক লেনদেন এবং ওজনে কম দেয়ার মতো ক্ষয়ে যাওয়া মূল্যবোধকে প্রচন্ড ভাবে আক্রমণ করা হয়। সমাজের মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করার জন্য মুহাম্মদ (সা) তাদের একত্রিত করে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। এ লক্ষ্যে তিনি তাঁর গোত্রের লোকদের একত্রিত করতেন, তাদের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন, তারপর তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন এবং তাদের সহযোগিতা চাইতেন। কিন্তু গোত্রের লোকেরা তাকে প্রত্যাখ্যান করত। তিনি (সা) সাফা পাহাড়ের পাদদেশে মক্কাবাসীদের একত্রিত করে তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করেছিলেন, কিন্তু তাঁর এ আহবান শুধুইমাত্র কুরাইশ নেতাবৃন্দের বিশেষ করে আবু লাহাবের ক্রোধের কারণ হয়েছিলো। ফলে, আল্লাহর রাসুলের সাথে কুরাইশ সম্প্রদায় ও অন্যান্য আরবের মধ্যকার সম্পর্কের তীক্ষতা আরও গভীর হয়েছিলো। এভাবে সাহাবীদের দার-উল-আরকাম এবং উপত্যকায় গোপনে বিশেষ ভাবে শিক্ষা দেবার সাথে সাথে গণসংযোগের পর্যায়ও দাওয়াতী কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হলো।
এভাবে, ইসলামের আহবান শুধুমাত্র যোগ্য এবং সম্ভাবনাময় ব্যক্তিদের পরিবর্তে সাধারন ভাবে সমাজের সমস্ত মানুষের কাছে পৌঁছে গেল। বস্তুতঃ ইসলামের আহবানের শক্তিতে শঙ্কিত হয়ে কুরাইশরা যখন রাসূল (সা) ও তাঁর সাহাবীদের দিকে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ আর ঘৃণার বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলো, তখনই ইসলামের প্রকাশ্য এ আহবান এবং ইসলামী চেতনাদৃপ্ত ব্যক্তি তৈরীর প্রভাব সমাজে প্রকাশিত হতে লাগলো। ইসলামী আদর্শ বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে যত বেশী শক্তিশালী হয়ে উঠলো, তা ততবেশী কাফিরদের ক্রোধ আর ঘৃণার কারণ হয়ে উঠলো । কাফিররা যখন অনুভব করলো তারা কোনভাবেই মুহাম্মদ (সা) এবং তাঁর প্রচারিত আদর্শকে পাশ কাটাতে পারবে না, তখন তারা ইসলামের আহবান চিরতরে বন্ধ করে দেবার লক্ষ্যে উঠে পড়ে লাগলো। আর সেইসাথে মুহাম্মদ (সা) এবং তাঁর সাহাবীদের প্রতি কাফিরদের অত্যাচার নির্যাতন ধারণ করলো।
বস্তুতঃ মুসলিমদের প্রকাশ্য জনসম্মুখে আহবান সমাজকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করেছিলো। যা দাওয়াতী কার্যক্রমকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সমাজে তৈরী করেছিলো প্রয়োজনীয় জনমত এবং এর সাহায্যেই পরবর্তীতে দাওয়াতের এই কার্যক্রম সমস্ত মক্কাব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিলো। এভাবে যতই দিন যেতে লাগলো মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলো। ইসলামের ছায়াতলে যেভাবে আসতে লাগলো বঞ্চিত, নির্যাতিত আর নিপীড়িত জনগোষ্ঠি, একই ভাবে সমাজের সম্মানিত ও নেতৃস্থানীয় মানুষ সহ ধনী ব্যবসায়ী শ্রেনীর মানষুও আলোকিত হলো সত্যের আলোয়। বস্তুতঃ তাদের ধনসম্পদ বা ব্যবসা-বাণিজ্য তাদেরকে রাসূল (সা) এর সত্য আহবানে সাড়া দেবার কর্তব্য থেকে বিরত রাখতে পারেনি। বস্তুতঃ যারা ইসলাম গ্রহন করেছিলো তারা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলো পবিত্রতা, প্রজ্ঞা ও সত্যের সৌন্দর্যকে। যা তাদের মুক্ত করেছিলো মানবচরিত্রের অন্ধ গোয়ার্তুমি এবং মিথ্যা অহমিকার কলুষতা থেকে। ইসলাম গ্রহন করার মূহুর্তেই তারা বঝুতে পেরেছিলো এ আহবানের ন্যায়সঙ্গত ভিত্তি ও আহবানকারীর সত্যনিষ্ঠতা। এভাবে মক্কার প্রতিটি প্রান্তে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে গেল এবং মক্কার নারী-পুরুষ ইসলাম গ্রহন করতে লাগলো। যদিও মক্কাবাসীদের প্রকাশ্যে এবং সমষ্টিগত ভাবে আহবান করার ফলে মুসলিমদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা তীব্র হয়েছিলো, তবুও মূলতঃ এ প্রকাশ্য আহবানই ইসলামের আহবানকে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভে সহায়তা করেছিলো। ইসলামী দাওয়াতের সাফল্য নেতৃস্থানীয় কুরাইশদের শুধু ক্রোধের কারনই হয়নি, বরং এ সাফল্য তাদের অন্তরে তীব্র প্রতিহিংসার আগুন প্রজ্জ্বলিত করেছিলো। কারণ, আল্লাহর রাসূল (সা) মক্কার সমাজে শক্তিশালী ভাবে প্রতিষ্ঠিত জুলুম-নির্যাতন ও শোষন-বঞ্চনার মতো অসুস্থ, অনৈতিক ও বিকৃত ধ্যান- ধারনাগুলোকে প্রচন্ড ভাবে আঘাত করেছিলেন এবং এর বিরুদ্ধে অনমনীয় ভাবে আদর্শিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন।
প্রকাশ্য ভাবে আহবানের এই পর্যায়টি ছিলো মূলতঃ একটি চুড়ান্ত ভাবে পার্থক্যকারী পর্যায়। এর একদিকে ছিলেন আল্লাহর রাসূল (সা) ও তাঁর সাহাবীবৃন্দ এবং অপরদিকে ছিলো কাফির নেতৃবৃন্দ ও কুরাইশ সম্প্রদায়। যদিও এর মধ্যবর্তী সময় অর্থাৎ, ইসলামী ব্যক্তিত্ব গঠন এবং প্রকাশ্যে গণসংযোগের মধ্যকার সময়টিকেও বিবেচনা করা হয় খুবই নাজুক এবং স্পর্শকাতর হিসাবে, কারণ এই সময় ইসলামের দাওয়াতকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রয়োজন ছিলো প্রচন্ড পরিমাণ প্রজ্ঞা, অন্তর্দৃষ্টি, ধৈয্য এবং সর্বোপরি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার নিপুন ক্ষমতার। কিন্তু, তারপরও প্রকাশ্য গণসংযোগ পর্যায়কেই সবচাইতে কঠিন সময় বলে বিবেচনা করা হয়। কারণ, এ জন্য মুসলিমদের সত্যকে নির্ভয়ে প্রচার করা এবং বাতিল শক্তি ও শাসন-ব্যবস্থাকে সরাসরি অস্বীকার করার মতো প্রচন্ড পরিমাণ সাহস ও পরিণতিতে যে কোন ধরনের পরিণাম মেনে নেবার জন্য মানসিক দৃঢ়তার প্রয়োজন ছিলো। এটা এ কারনেই যে, মুসলিমদের জন্য দ্বীন এবং ঈমানের পরীক্ষা ছিলো অবধারিত।
আল্লাহর রাসূল (সা) এবং তাঁর সাহাবীরা পর্বতসম অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন ও আক্রমন সহ্য করে ঈমানের এ পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন।
প্রচন্ড আক্রমনাত্মক ও নিপীড়নমূলক এ অত্যাচারের সম্মুখীন হয়ে মুসলিমদের একটি দল মক্কা ত্যাগ করে আবিসিনিয়ায় চলে যায়, কেউ কেউ নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করে আর কিছু সংখ্যক মুসলিম নির্যাতন সহ্য করে মক্কায়ই থেকে যায়। মুসলিমরা ততক্ষন পর্যন্ত একাগ্রচিত্তে দৃঢ়তা এবং একনিষ্ঠতার সাথে বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন ও সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে যতক্ষন পর্যন্ত না ইসলামের আলোকিত আহবান কুফর ধ্যান-ধারনার নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবে থাকা মক্কার সমাজকে প্রচন্ড ভাবে আঘাত করে। যদিও মুহাম্মদ (সা)-এর দাওয়াতী কার্যক্রমের প্রথম তিনবছর মূলতঃ আল-আরকাম (রা) এর গৃহেই সীমাবদ্ধ ছিলো এবং এ সময়টাই ছিলো দাওয়াতের প্রাথমিক পর্যায়, কিন্তু তারপরও পরবর্তী আটবছর আল্লাহর রাসূল (সা)কে করতে হয়েছিলো কঠিন সংগ্রাম। বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে নবুওতের সুস্পষ্ট প্রমাণ দেবার পরও পরবর্তী বছরগুলোতে তাকে লিপ্ত হতে হয়েছিলো বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে ভয়াবহ সংগ্রামে। বস্তুতঃ এ সময়টা স্মরণীয় হয়ে আছে এজন্য যে, এ দীর্ঘ আটবছরে কুরাইশরা মুসলিমদের একমহুর্তের জন্য অত্যাচার ও নির্যাতন করা থেকে বিরত হয়নি, না তারা দেখিয়েছিলো মুসলিম ও ইসলামের প্রতি কোনরকমের কোন সহানুভূতি। মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যকার এই সাংঘষির্ক এবং বিপরীতমুখী অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতেই ইসলামের আহবান সমস্ত আরব উপদ্বীপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং সমস্ত মানুষের কাছে ইসলাম একটি আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। এছাড়া, হজ্জ্ব করতে আগত আরবদের মাধ্যমেও এ আহবান আরব গোত্রগুলোর মাঝে বিস্তৃতি লাভ করে। কিন্তু, এ আরব গোত্রগুলো কুরাইশদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবার আশঙ্কায় ঈমান আনার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে মূলতঃ দর্শকের ভূমিকা পালন করে এবং মুহাম্মদ (সা) এবং তাঁর প্রচারিত আদর্শকে সম্পূর্ন ভাবে পাশ কাটিয়ে যায়। বস্তুতঃ মুহাম্মদ (সা) এবং তাঁর সাহাবীদের এই ভয়ঙ্কর অবস্থাই দাওয়াতের তৃতীয় পর্যায় অর্থাৎ যে পর্যায় ইসলামকে সম্পূর্ন ভাবে প্রয়োগ করবে তার অপরিহার্যতাকে প্রমাণ করে।
মক্কাবাসীর ইসলামী দাওয়াতের প্রতি এরূপ বিদ্বেষ ও সহিংসতা ধীরে ধীরে মক্কায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার সমস্ত সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়।
উপরন্তু, মুসলিমদের উপর কাফিরদের ক্রমবধর্মান অত্যাচার ও নির্যাতন দাওয়াতী কাযর্ক্রমের পথে বিরাট বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থা আরও জটিল আকার ধারন করে যখন মক্কাবাসী সম্পূর্ণ ভাবে ইসলামকে প্রত্যাখান করে।