[নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘আদ-দাওলাতুল ইসলামীয়্যাহ’ (ইসলামী রাষ্ট্র) বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে নেয়া হয়েছে]
মুহাম্মদ (সা) কে যখন আল্লাসে অনুযায়ী দরদাম হাঁকতে পারে? আল্লাহ্ তা’য়ালা প্রথমদিকে রাসূল হিসাবে মনোনিত করেন, তখন মক্কার মুশরিকরা তাকে এবং তাঁর প্রচারিত বানীকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। দাওয়াতী কাজের প্রাথমিক দিকে কুরাইশরা তাঁর আহবানকে সাধু-সন্যাসীদের সমগোত্রীয় ভেবে উপেক্ষা করতে থাকে এবং ভাবতে থাকে যে, ইসলাম গ্রহণকারী মুসলিমরা হয়তো ধীরে ধীরে আবার তাদের পূর্বপুরুষের ধর্মে প্রত্যাবর্তন করবে। মূলতঃ এই কারনেই কুরাইশরা প্রথমদিকে তাঁর (সা) কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। মুহাম্মদ (সা) যখনই কুরাইশদের সম্মুখীন হতেন তারা বলতো, “এই হচ্ছে আবদ আল মুত্তালিবের পুত্র যার উপর কিনা আসমান থেকে ওহী অবতীর্ন হয়।” কিন্তু অল্প কিছুদিন পরই তারা তাঁর প্রচারিত আদর্শের শক্তিতে শঙ্কিত বোধ করতে শুরু করে এবং তাঁর সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। প্রথমদিকে তারা মুহাম্মদ (সা) এর নবুয়তের দাবীকে মিথ্যা বলে উপহাস করে। পরবর্তীতে তারা নবুয়তের প্রমাণ হিসাবে নবী (সা) অলৌকিক নিদর্শন সমূহ উপস্থাপন করতে বলে। তারা বলতে থাকে, মুহাম্মদ যদি সত্য সত্যই আল্লাহর নবী হয়ে থাকে তবে সে কেন সাফা ও মারওয়াকে সোনার পাহাড়ে পরিনত করছে না? কেন তাঁর কাছে আসমান থেকে লিখিত কিতাব নাযিল হচ্ছে না? কেন জিবরাইল মুহাম্মদের সাথে কথা বলে কিন্তু তাদের সামনে উপস্থিত হয় না? কেন সে মৃতকে জীবিত করতে পারে না? কেন সে মক্কাকে পরিবেষ্টনকারী পাহাড়গুলোকে অন্যত্র সরিয়ে দিচ্ছে না? কেন তার সমাজের মানুষের পানির এতো কষ্ট থাকা সত্ত্বেও সে তাদের জন্য জম্জম্ এর চাইতে ভাল কোন কুপ খনন করে দিচ্ছে না? কেন তাঁর রব তাঁকে দ্রব্যসমূহের মূল্য আগে থেকেই অবহিত করছে না যেন তারা সে অনুযায়ী দরদাম হাঁকতে পারে?
বেশ কিছুকাল যাবত চলতে থাকে আল্লাহর রাসুলের (সা) বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য মূলক এসব অপপ্রচার। কুরাইশরা নবী (সা)-কে জর্জরিত করতে থাকে তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, তিরস্কার আর অত্যাচারে। তা সত্ত্বেও তিনি (সা) অবদমিত কিংবা সত্য পথ থেকে বিচ্যুত না হয়ে একাগ্রতার সাথে মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করতে থাকেন এবং সেই সাথে যারা মূর্তিপূজা করে ও মূর্তির কাছে প্রার্থনা করে তাদের র্নিবুদ্ধিতা আর চিন্তার অসারতা সমাজের মানুষের সামনে তুলে ধরে মূর্তিপূজাকে অযৌক্তিক এবং হাস্যকর প্রমাণ করেন।
তাদের উপাস্য মুর্তির বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ এ প্রচারনা কুরাইশদের সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, ফলে তারা যে কোনও হীন উপায়ে মুহাম্মদ (সা) এর কার্যকলাপ বন্ধের জন্য সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করে, কিন্তু দাওয়াতী কার্যকলাপ বন্ধের তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইসলামী দাওয়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য কুরাইশরা প্রধানত তিনটি উপায় গ্রহণ করে:
১. অত্যাচার
২. সমাজের ভিতরে এবং বাইরে মিথ্যা প্রচারনা
৩. বয়কট (সমাজচ্যূত করন)
পারিবারিক নিরাপত্তা পাবার পরও মুহাম্মদ (সা) অত্যাচারের শিকার হন, অত্যাচারিত হন তাঁর (সা) সঙ্গী-সাথীরাও। কুরাইশরা তাদের নির্যাতন করার জন্য ঘৃন্য সকল পদ্ধতি গ্রহন করে এবং এ সকল ঘৃনিত কাজে তারা ব্যাপক পারদর্শিতা অর্জন করে। সত্যদ্বীন থেকে বিচ্যুত করার জন্য আল-ইয়াসির (রা) এর পরিবারকে র্নিমম অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়, কিন্তু এ সমস্ত অত্যাচার শুধুমাত্রই তাদের দৃঢ়তা ও মনোবল বৃদ্ধি করে। কুরাইশরা যখন ইয়াসির (রা) এর পরিবারকে অত্যাচার করছিল, তখন আল্লাহর রাসূল (সা) তাদের অতিক্রম করছিলেন এবং তিনি (সা) তাদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন, “ধৈর্য ধর ইয়াসির পরিবার! তোমাদের পুরস্কার তো জান্নাত। তোমাদের গন্তব্য তো আল্লাহর কাছে।” এর জবাবে ইয়াসির (রা) এর স্ত্রী সুমাইয়া (রা) বলেছিলেন,” হে আল্লাহর রাসুল, আমি তা দেখতে পাচ্ছি।”
ততদিন পর্যন্ত রাসূল (সা) এবং তাঁর সাহাবী (রা)দের উপর কুরাইশদের এ ভয়ংকর অত্যাচার পূর্ণ শক্তিতে চলতে থাকে যতদিন পর্যন্ত না তারা বুঝতে পারে, তাদের সকল প্রচেষ্টা আসলে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এরপর তারা ইসলামী দাওয়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অন্য পদ্ধতি গ্রহণ করে, যা ছিল মূলতঃ ইসলাম এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারনা যা তারা মক্কা এবং মক্কার বাইরে যেমন, আবিসিনিয়ায় প্রচার করে। এ পদ্ধতি সফল করতে তারা যুক্তি, তর্ক, বিদ্রুপ, মিথ্যা অপবাদ-অভিযোগ সহ সকল রকম পদ্ধতি গ্রহণ করে। তাদের অপপ্রচার ছিল ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস (আকীদাহ্) এবং রাসুল (সা)-এর বিরুদ্ধে। কুরাইশরা মুহাম্মদ (সা)-কে নানারকম মিথ্যা অপবাদ এবং অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তাঁকে (সা) সমাজের মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তারা নানারকম পরিকল্পনা এবং কুটকৌশলের আশ্রয় নেয়।
বিশেষ করে হজ্জের মৌসুমে কুরাইশরা ইসলামকে হীন প্রতিপন্ন করার জন্য খুবই সর্তকতার সাথে প্রস্তুতি নেয়। তারা ওয়ালিদ ইবন মুগীরার সাথে পরামর্শ করে মুহাম্মদ (সা) এর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গাত্মক শোক রচনা করে। এরপর তারা মক্কায় হজ্জের উদ্দেশ্যে আগত আরবদের মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে কী বলা যায় এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকে। কেউ কেউ প্রস্তাবনা করে, তারা আগত আরবদের মাঝে প্রচার করবে যে মুহাম্মদ (সা) একজন কাহিন (গনক)। কিন্তু ওয়ালিদ ইবন মুগীরা এ প্রস্তাব নাকচ করে দেয় এ যুক্তিতে যে, মুহাম্মদের বাণী একজন নির্বোধ কাহিনের অসাড় প্রলাপ কিংবা ছন্দময় আবৃত্তির বহু উর্ধে। কেউ কেউ প্রস্তাব করে যে, তারা বলবে মুহাম্মদ একজন কবি। কিন্তু তারা পদ্য রচনার সকল প্রকার এবং রূপ সম্পর্কে খুব ভালই অবহিত ছিল বলে শেষ পর্যন্ত এ প্রস্তাবটিও বাতিল করে। অন্যেরা প্রস্তাব করে, তারা প্রচার করবে মুহাম্মদ জিনের আছরগ্রস্থ। কিন্তু, ওয়ালিদ ইবন মুগীরা এ প্রস্তাবও নাকচ করে দেয় কারণ, মুহাম্মদ (সা) এর আচরন জিনের আছরগ্রস্থ মানুষের মতো নয়। অনেকে আবার মুহাম্মদ (সা)-কে যাদুকর হিসাবে অভিযুক্ত করার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু আল-ওয়ালিদ এ প্রস্তাবও নাকচ করে দেয় কারন মুহাম্মদ (সা) যাদুকরদের মতো গুপ্তবিদ্যার চর্চাও করে না, যেমন, সুপরিচিত গিরায় ফুক দেয়ার প্রথা।
দীর্ঘ আলোচনার পর তারা একমত হয় যে, তারা প্রচার করবে মুহাম্মদ (সা) কথার মাধ্যমে মানুষকে যাদুগ্রস্থ করে (সিহর আল-বায়ান)। এরপর তারা আরবদের মুহাম্মদের ব্যাপারে সর্তক করার জন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে হজ্জ কাফেলাদের মধ্যে ঢুকে পরে। আল্লাহর রাসুল (সা)-কে তারা কথার যাদুকর হিসাবে মানুষের কাছে উপস্থাপিত করে এবং হজ্জ্ব যাত্রীদের তাঁর (সা) প্রচারিত বাণী শ্রবন করা থেকে বিরত থাকতে আহবান করে। তারা প্রচার করে, মুহাম্মদের প্রচারিত বাণী মানুষকে তার আপন ভাই, বাবা, মা এমনকি তার নিজ পরিবার থেকে পৃথক করে ফেলে। বস্তুতঃ তাদের এ মিথ্যা অপপ্রচার তাদের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়, এবং ইসলামী দাওয়াত ক্রমশ মানুষের অন্তর জয় করতে থাকে। এরপর কুরাইশরা আল নযর ইবন আল-হারিছকে মুহাম্মদ (সা) এর বিরুদ্ধে নিয়োজিত করে। যখনই তিনি (সা) জনগণকে দাওয়াত দিয়ে তাদের আল্লাহর কথা স্মরন করিয়ে দিতেন কিংবা পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের প্রতি আল্লাহর সতর্কবাণীর কথা বলতেন, তখনই নযর ইবন হারিছ সেখানে উপস্থিত হয়ে পারস্যের বাদশাহ্ ও তাদের ধর্মের গল্প বলতে শুরু করতো। সে দাবী করতো, “কোন দিক থেকে মুহাম্মদ গল্প বলায় আমার থেকে বেশী পারদর্শী? সে কি আমার মতোই পূর্ববর্তীদের কাহিনী বর্ণনা করে না?” এভাবে কুরাইশরা বিভিন্ন ধরনের গল্পকাহিনী জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে থাকে। তারা মক্কাবাসীদের বলে, আসলে মুহাম্মদ যা বলে এগুলো আল্লাহর বাণী নয়, বরং এগুলো জাবির নামে একজন খ্রীষ্টান তরুণের শেখানো কথা। এই অপপ্রচার চলতে থাকে যতক্ষন পর্যন্ত না আল্লাহ নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন,
“আমরা তো জানি তারা বলে যে, তাকে শিক্ষা দেয় একজন মানুষ; তারা যার কথা বলে তার ভাষা তো আরবী নয়; কিন্তু কোরআনের ভাষা তো বিশুদ্ধ আরবী।” [সুরা নাহল: ১০৩]
এভাবে সমগ্র আরব উপদ্বীপ জুড়ে চলতে থাকে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং মুসলিমদের উপর অত্যাচার। যখন কুরাইশরা শুনতে পেল কিছু মুসলিম জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত হবার ভয়ে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছে, সাথে সাথে তারা আবিসিনিয়াতে তাদের পক্ষ থেকে দু’জন চৌকষ দূত পাঠিয়ে দিল মুসলিমদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য। তাদের আশা ছিল আবিসিনিয়ার শাসক নাজ্জাসী হয়ত মুসলিমদের তার দেশ থেকে বের করে দিয়ে মুসলিমদের মক্কায় ফিরে আসতে বাধ্য করবে। কুরাইশরা তাদের পক্ষ থেকে দূত হিসাবে ‘আমর ইবন আল ‘আস ইবন ওয়া’ইল এবং আব্দুলাহ্ ইবন রাবি’আহ্কে প্রেরণ করে। তারা আবিসিনিয়া গমনের পর বাদশাহ নাজ্জাসীর সভাসদবৃন্দকে উপঢৌকন প্রদানের মাধ্যমে মুসলিম শরণার্থীদের তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করার ব্যাপারে তাদের সহায়তা কামনা করে। তারা সভাসদবৃন্দকে বলে, “আমাদের জনগণের মধ্য হতে কিছু নির্বোধ লোক আপনাদের বাদশাহর আশ্রয়ে আছে। তারা আমাদের ধর্ম ত্যাগ করেছে আবার আপনাদের ধর্মও গ্রহণ করেনি, উপরন্তু তারা এমন এক ধর্মের দিকে মানুষকে আহবান জানাচ্ছে যে ধর্মের ব্যাপারে না আমরা কিছু জানি, না আপনারা জানেন। আমাদের সম্মানিত নেতারা তাদের ফিরিয়ে নেবার জন্য আমাদেরকে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছেন। সুতরাং, তাদের আমাদের হাতে তুলে দিন কারণ, নিজ সম্প্রদায়ের লোক হিসাবে তাদের ভুল-ভ্রান্তির ব্যাপারে আমাদেরই পরিপূর্ণ এবং স্বচ্ছ ধারনা রয়েছে।” মুসলিমরা অনাকাঙ্খিত কিছু বলে ফেলবে এই ভয়ে কুরাইশদের প্রেরিত দূতেরা বার বার এটা নিশ্চিত করতে চাচ্ছিল যেন, মুসলিম শরনার্থীরা কোনভাবেই বাদশাহর সাথে সাক্ষাৎ না করে। সভাসদবৃন্দ নাজ্জাসীর সাথে সাক্ষাৎ করে এবং আশ্রয়প্রার্থী মুসলিমদের তাদের নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে ফিরিয়ে দেবার আবেদন করে।
সভাসদবৃন্দের আবেদন শোনার পর নাজ্জাসী আশ্রয়প্রার্থী মুসলিমদের তাঁর দরবারে হাজির হবার নির্দেশ দেন এবং তাদের নিকট হতে তাদের প্রচারিত আদর্শ শুনবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মুসলিমরা তাঁর দরবারে উপস্থিত হলে তিনি বলেন,”আমার দ্বীন কিংবা অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ না করে তোমরা কোন দ্বীনের দিকে মানুষকে আহবান করছো?” এমতাবস্থায় জা’ফর ইবন আবি তালিব তাদের ইসলাম পূর্ববর্তী অজ্ঞতা এবং তাদের বর্তমান অবস্থার সাথে পূর্বের অবস্থার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে নাজ্জাসীর প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি বাদশাহকে বলেন,”আমাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা আমাদের অত্যাচার করত। আমাদের উপর ক্ষমতাশীন থাকা অবস্থায় তারা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে এবং শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের ও আমাদের দ্বীনের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা আপনার দেশে এসে আপনাকে অন্যদের উপর প্রাধান্য দিয়েছি, আমরা আশা রাখি যে যতদিন আমরা আপনার সাথে রয়েছি, ততদিন আমাদের সাথে অন্যায় আচরন করা হবে না। নাজ্জাশী বললেন, “তোমাদের রাসূল আলাহর নাযিলকৃত যে বাণী প্রচার করছে তার কিছু অংশ কি তোমরা আমাকে শোনাতে পারো?” জবাবে জা’ফর (রা) বললেন, হ্যাঁ, শোনাতে পারি। অতঃপর তিনি সুরা মারিয়মের প্রথম থেকে নিম্নোক্ত আয়াত পর্যন্ত তিলাওয়াত করলেন যেখানে আল্লাহ বলেছেন,
“অতঃপর মারিয়ম ঈঙ্গিতে তাঁর সন্তানকে দেখালো। তারা বললো যে, কোলের শিশুর সাথে আমরা কিভাবে কথা বলবো? সে [শিশুটি] বললো, আমি তো আল্লাহর দাস, তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নবী করেছেন। যেখানেই আমি থাকি না কেন, তিনি আমাকে তাঁর অনুগ্রহভাজন করেছেন। যতদিন জীবিত থাকি আমাকে নামাজ ও যাকাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং জননীর অনুগত থাকতে এবং আমাকে তিনি উদ্ধত ও হতভাগ্য করেননি। আমার প্রতি সালাম যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন পুনরুজ্জীবিত হয়ে উত্থিত হব।” [সুরা মারিয়মঃ ২৯-৩৩]
কুরআন তিলওয়াত শুনে সভায় উপস্থিত পাদ্রীরা একযোগে বলে উঠলো, “এ তো সেই একই উৎস থেকে আগত যেখান থেকে এসেছে আমাদের প্রভু ঈসা মসীহ্র বাণী।” নাজ্জাশী বললেন,”সত্যিই, মুহাম্মদের বাণী এবং মুসার প্রচারিত বাণী একই উৎস থেকে আগত। তারপর, কুরাইশদের প্রেরিত দূতদ্বয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা এখন যেতে পার। আর আল্লাহর কসম আমি কখনই এদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দেবো না, আর না আমি তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবো।” একথা শোনার পর মক্কা থেকে আগত দুতেরা রাজসভা থেকে বেরিয়ে আসল এবং তাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ভিন্ন পথ খুঁজে বেড়াতে লাগল। পরদিন ‘আমর ইবন আল’আস পুনরায় নাজ্জাসীর কাছে গেল এবং বলল, “মুসলিমরা মারিয়ম পুত্র ঈসার নামে জঘন্য কথা বলে, আপনি তাদেরকে ডেকে পাঠান আর জিজ্ঞেস করুন।” তিনি মুসলিমদের ডেকে জিজ্ঞেস করায় জা’ফর বললেন,”আমরা মারিয়ম পুত্র সম্পর্কে তাই বলি যা আমাদের রাসুল (সা) আমাদের শিখিয়েছেন, তিনি (সা) বলেছেন, ঈসা মসীহতো আল্লাহর একজন বান্দা এবং তাঁর প্রেরিত রাসুল, তাঁর রুহ্ এবং তাঁরই কালিমা, যা তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) ফুঁকে দিয়েছেন তাঁর সম্মানিত বান্দা কুমারী মারিয়মের মধ্যে।” নাজ্জাসী নীচু হয়ে একটি লাঠি তুলে নিয়ে মাটির উপর একটি সোজা দাগ দিয়ে বললেন, “তোমাদের দ্বীন আমাদের দ্বীনের মাঝে এই একটি রেখার পার্থক্য ছাড়া আর কিছুই নেই।” অতঃপর তিনি কুরাইশ দুতদের খালি হাতে ফিরিয়ে দিলেন।
শেষ পর্যন্ত ইসলামী দাওয়াতী কার্যক্রম বন্ধ করার লক্ষ্যে কুরাইশদের সকল ষড়যন্ত্র, মিথ্যা অপপ্রচার সবই ব্যর্থ হয় এবং সকল মিথ্যা, অপবাদ, অপপ্রচার আর ষড়যন্ত্রকে পরাভূত করে রাসূল (সা) প্রচারিত আল্লাহর মহান বাণী তার আপন আলোয় উদ্ভাসিত হয়। এরপর কুরাইশরা মুসলিমদের পরাভূত করতে তাদের সর্বশেষ অস্ত্র প্রয়োগ করে, যেটা ছিল ‘বয়কট’। তারা সকল গোত্র প্রধানরা একত্রিত হয়ে মুহাম্মদ (সা) এবং তাঁর পরিবারকে সামাজিক ভাবে বয়কট করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। এ লক্ষ্যে তারা একটি চুক্তিপত্র প্রণয়ন করে যে, বনু হাশিম এবং বনু আবদ আল মুত্তালিব-এর সাথে কেউ কোনও ধরনের লেন-দেন করবে না, তাদের গোত্রের মেয়েদের না কেউ বিয়ে করবে, না তাদের গোত্রে কেউ নিজের মেয়ে বিয়ে দেবে, না তাদের কাছে কেউ কোনও দ্রব্য বিক্রি করবে, না তাদের কাছ থেকে কেউ কিছু ক্রয় করবে। এ চুক্তির ব্যাপারে একমত হবার পর তারা চুক্তির শর্ত গুলো লিখে চুক্তিপত্রটি কাবার অভ্যন্তরে ঝুলিয়ে রাখে যেন কেউ চুক্তি ভঙ্গ না করার সাহস করে। তারা ধারনা করে যে, তাদের লক্ষ্য অর্জনে এ পদ্ধতি অপপ্রচার বা নির্যাতনের চাইতে বেশী কার্যকরী হবে এবং এভাবেই তাদের উদ্দেশ্য সাধিত হবে।
তিন বছর পর্যন্ত চলে কুরাইশদের এই বয়কট। পুরোটা সময় জুড়ে কুরাইশরা আশায় থাকে এবার হয়তো বনু হাশিম আর বনু আবদ আল মুত্তালিব মুহাম্মদকে ত্যাগ করে স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন করবে। ফলশ্রুতিতে সঙ্গী-সাথীহীন মুহাম্মদ পরিণত হবে তাদেরই করুনার পাত্রে। তারা আরও ভাবতে থাকে, হয় তাদের আরোপিত এই বয়কট মুহাম্মদকে দাওয়াতী কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য করবে, না হয় মুহাম্মদের আহবানে তাদের দ্বীনের অস্তিত্ব যে হুমকীর সম্মুখীন হয়েছে সেটা বন্ধ হবে। কিন্তু তাদের গৃহীত এ সমস্ত কৌশল মুহাম্মদ (সা)-কে করে তোলে আরও দৃঢ়প্রত্যয়ী আর দাওয়াতী কাজ চালিয়ে নেবার জন্য সাহাবীদেরও করে পূর্ণ উদ্যমী। মক্কার ভিতরে বাইরে সর্বত্রই ইসলামের আহবান প্রচার এবং প্রসারে কুরাইশদের বয়কট সম্পূর্ণ ভাবে ব্যর্থ হয়। বরং মুহাম্মদ (সা) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের বয়কট করার সংবাদ মক্কার বাইরে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় আর এভাবে বিভিন্ন গোত্রের কাছে পৌঁছে যায় ইসলামের আহবান। এবং সমস্ত আরব উপদ্বীপে ইসলাম একটি আলোচনার বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়।
যাই হোক, মুসলিমদের উপর কোনও রকম দয়া প্রদর্শন ছাড়াই নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চলতে থাকে এই বয়কট এবং কুরাইশরা চুক্তিবদ্ধ গোত্রের মানুষকে প্রতিটি শর্ত মানতে বাধ্য করে। ফলে, রাসূল (সা) এর পরিবার এবং সাহাবীরা ক্ষুধা তৃষ্ণায় অবর্ণনীয় কষ্টের শিকার হয় এবং গুটি কয়েক সহানুভুতিশীল ব্যক্তির দেয়া নূন্যতম খাদ্যে দিন পার করতে থাকে। এই নির্মম কষ্টকর সময়ের মধ্যে শুধুমাত্র পবিত্র মাস গুলোই ছিল তাদের জন্য তুলনামূলক ভাবে স্বস্তির সময়, যখন মুহাম্মদ (সা) কাবায় যেতেন, সেখানে মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের পথে আহবান করতেন, তাদের দিতেন জান্নাতের সুসংবাদ আর সতর্ক করতেন জাহান্নামের ভয়াবহতা সম্পর্কে, তারপর ফিরে আসতেন পার্বত্য উপত্যকায়। এই সমস্ত ঘটনা প্রবাহ ধীরে ধীরে মুহাম্মদ (সা), তাঁর পরিবার এবং সাহাবীদের প্রতি মক্কাবাসীদের অন্তরকে বিগলিত করে। এদের কেউ কেউ মুহাম্মদ (সা) এর আহবানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে, আবার কেউ কেউ তাদের গোপনে খাবার সরবরাহ করতে থাকে। হিশাম ইবন ‘আমর নামক এক মক্কাবাসী রাতের অন্ধকারে উট বোঝাই করে খাবার নিয়ে যেত মুসলিমদের জন্য, তারপর পার্বত্য উপত্যকার অভ্যন্তরে যেখানে মুসলিমরা কতো সেখানে ঢুকিয়ে দিত তার উট। এভাবে মুসলিমরা তার সরবরাহ করা খাবার খেতো এবং উটটিও জবাই করে খেয়ে ফেলতো।
বয়কট কার্যকর থাকাকালীন কষ্টকর এই তিনটি বছর মুসলিমরা অসম্ভব ধৈর্য্যের সাথে অতিবাহিত করে। মূলতঃ এই সময় তারা পার করে রুক্ষ, প্রস্তরময় একটি পথ, যে পর্যন্ত না আল্লাহ তায়ালা তাদের পরীক্ষা হতে অব্যহতি দেন এবং শেষ পর্যন্ত কুরাইশরা বয়কট প্রত্যাহার করে।
কুরাইশদের মধ্য হতে জুহাইর ইবন আবি উমাইয়াহ, হিশাম ইবন ‘আমর, আল মুত’য়িম ইবন ‘আদি, আবু আল বাখতারি ইবন হিশাম এবং জামা’য়াহ ইবন আল আসওয়াদ নামে পাঁচজন তরুণ একত্রিত হয়। ঐ সময়ের অন্য অনেক কুরাইশদের মতো তারাও বয়কট এবং চুক্তিপত্রের ব্যাপারে তাদের বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করে। শেষ পর্যন্ত তারা অনৈতিক ভাবে মুহাম্মদ (সা) এবং তার সঙ্গী-সাথীদের বয়কটের চুক্তিপত্রটি বাতিলের ব্যাপারে একমত হয়।
পরদিন জুহাইর কাবাগৃহকে সাতবার প্রদক্ষিন করার পর উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”হে মক্কাবাসী, আমরা কি ভালো খাবো, ভালো কাপড় পরবো আর কোনও রকম ক্রয়-বিক্রয় না করতে পেরে বনু হাশিম গোত্রের লোকেরা কি ধ্বংস হয়ে যাবে? আলাহর কসম এই অন্যায় বয়কট বাতিল আর চুক্তিপত্র ছিঁড়ে ফেলা না পর্যন্ত আমি বিশ্রাম নেবো না।” খুব নিকটেই ছিল আবু জাহল, সে ক্রোধান্বিত হয়ে বলল, “তুমি মিথ্যাবাদী, আল্লাহর কসম, এই চুক্তিপত্র আমি কখনোই ছিড়ঁবো না।” এই পর্যায়ে মক্কাবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা বাকী চারজন জুমা’য়াহ, আবু আল বাখতারি, আল মুত’য়িম এবং হিশাম জুহাইরের সমর্থনে চিৎকার করে উঠে। আবু জাহল তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারে পুরো ব্যাপারটিই আসলে পূর্ব পরিকল্পিত এবং আরও খারাপ কিছু ঘটার আশংকায় পিছু হটে যায়। যখন আল মুত’য়িম চুক্তিপত্রটি ছিঁড়ে ফেলার জন্য কাবার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তখন তারা দেখে “তোমার নামে, হে আল্লাহ” এ বাক্যটি ছাড়া বাকী সবটুকু ইতিমধ্যেই পোকার আক্রমনে নষ্ট হয়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর রাসূল (সা) ও তাঁর সাহাবীরা পুনরায় মক্কায় ফিরে আসে এবং ইসলামী দাওয়াতের পথ রোধ করার কুরাইশদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে মক্কায় মুসলিমদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। কুরাইশরা সব রকম উপায়ে ক্রমাগত চেষ্টা করেছিলো মুসলিম এবং তাদের দ্বীনের মাঝে বাঁধা হয়ে দাড়াঁতে। তারা চেষ্টা করেছিলো মুহাম্মদ (সা) কে দ্বীন প্রচার থেকে বিরত রাখার, কিন্তু সব রকম বাঁধা বিপত্তি সত্ত্বেও আল্লাহর সাহায্যে চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল ইসলামী দাওয়াতের আহবান।