গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসির ক্ষমতা চ্যুতির পরে, মিশর আবারো অস্থিতিশীল অবস্থায় পরিণত হয়েছে। মুরসির স্বপক্ষে ও বিপক্ষে হাজারো সমর্থক রাস্তায় অবস্থান করছে। তারা পরস্পর এবং সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ায় সহিংস ঘটনার সূত্রপাত ঘটছে। মুরসির সংঘটন, মুসলিম ব্রাদারহুড দেশকে সিরিয়ার মতো সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানকে অভিযুক্ত করেছে। রিপাবলিক গার্ড কম্পাউন্ডের সামনে সেনাবাহিনী কতৃক মুরসির সমর্থক ৫১ জন হত্যা ও ৪৩০ জন আহত হওয়ার পর ব্রাদারহুড এই অভিযোগ তুলল। অপরদিকে সেনাবাহিনী আন্দোলনরত মুরসির সমর্থকদের “সন্ত্রাসী” আখ্যা দিয়েছে। বিদ্যমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে তাকালে যে কারো প্রশ্ন জাগবে, কোন দিকে যাচ্ছে মিশর?
মূলত তিনটি কারণের ভিত্তিতে সেকুলার দলগুলো জনগণকে রাস্তায় নামাতে সক্ষম হয়েছে। কারণগুলো হল শোচনীয় অর্থনৈতিক অবস্থা, দেশ পরিচালনায় ব্রাদারহুডের অযোগ্যতা ও আরব বসন্ত পরবর্তী জনগণের বৈপ্লবিক আকাঙ্ক্ষা বিরাজ করা। ১৯৫২ সালের সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন জামাল আবদেল নাসের পরবর্তী মিশরের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী একমাত্র ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান। যা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে যখন মিশরের আগের সব প্রেসিডেন্টের সবাই সেনাবাহিনীর সাবেক নেতা। মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান ছিল মূলত তুরস্কের উসমানীয় খিলাফত ধবংসের প্রতিক্রিয়া স্বরপ। দীর্ঘ ৮৫ বছরের সংগ্রাম, উম্মার ইসলামী আবেগ ও ২০১১ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্ত পরবর্তী আমেরিকার মদদপুষ্ট সেনাবাহিনী ব্রাদারহুডের ক্ষমতা আরোহণে সমর্থন দিতে বাধ্য হয়। মিশরের রাজনীতিতে সেকুল্যার দলগুলোর ভঙ্গুর অবস্থানের কারণে বরাবরি মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের রাজনৈতিক উত্থান তথা প্রভাব বাড়ুক তা মোটেও চায়না। তাই তারা বিদ্যমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো লিবারাল ইসলামি দলগুলোকে স্বাগত জানাতে আগ্রহী। লিবারাল ইসলামি দলগুলোর রাষ্ট্র নেতৃত্বে আসীন হওয়ায় আমেরিকা মোটেও চিন্তিত নয়, কেননা রাষ্ট্রের প্রকৃত ক্ষমতা সেকুল্যার কতৃপক্ষের হাতেই থাকে। মিশরের ক্ষেত্রে স্পষ্টত তা সেনাবাহিনী ধারণ করে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ পরবর্তী সামরিক জান্তার কোনো ধরনের সমালোচনা না করাই প্রমাণ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জনগণের একাংশের দাবির মুখে সেনাবাহিনীর সামরিক পদক্ষেপে সন্তুষ্ট। মুরসী বিরোধী জনগণের জাগরণকে আমেরিকা মিশরের রাজনীতিতে শুধুমাত্র ব্রাদারহুডকে নয় বরং ইসলামের রাজনৈতিক উত্থানকে ঠেকানোর সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। যদিও এই ধরনের পরিবর্তনে ইসলামপন্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিবে যা মিশরকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে সে ব্যাপারে আমেরিকা ভালোভাবে অবগত আছে। তাহলে কেন যুক্তরাষ্ট্র ও মিশরের সামরিকজান্তা মুরসিকে পরিবর্তনের ঝুঁকি নিল?
সেনাবাহিনীর ক্যুয়ের পেছনে প্রথম সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, রাজনীতিতে তথা সরকার ও প্রাদেশিক প্রশাসনের উপর ব্রাদারহুডের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে ঠেকানো। আমেরিকার রাজনৈতিক কৌশলের সাথে একমত অনেকে মনে করেন, ইসলামিস্টদের মধ্যে যারা প্রকৃত পরিবর্তনের কথা বলে তাদেরকে ঠেকাতে হলে, লিবারাল ইসলামিস্টদের সাথে আরো বেশী সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে কিন্তু অনেকে আবার লিবারাল ইসলামিস্টদের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখে, এই মতের অনুসারীরাও শক্তিশালী। তারা মনে করেন এই ধরনের আন্দোলন প্রায়োগিক (Pragmatic) হলেও তাদের মূল উদ্দেশ্য ক্ষমতা দখল করা এবং গণতন্ত্রকে অপসারণ করা। সেনাবাহিনী মূলত দ্বিতীয় মতের অনুসারী যারা মিশরের তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ইসলামিস্ট প্রভাব দেখতে আগ্রহী নয়। ফলে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তাই মিশরের চলমান রাজনৈতিক সংকট সেনা ক্যুর অনিবার্য ফল যা সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
দ্বিতীয় সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, আমেরিকা মিশরকে সশস্ত্র সংগঠন ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার সংঘাতের মধ্যদিয়ে দীর্ঘমেয়াদী একটি সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করতে চায়। মুরসি পরবর্তী মিশরের সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি বিশেষকরে সেনাবাহিনীর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ থেকে তা সহজে অনুধাবন করা যায়। পশ্চিমারা ভালভাবে বুঝতে পেরেছে রাজনৈতিক ইসলাম জনগণ কতৃক জোরালো সমর্থন পাচ্ছে যা আমরা নব্বইয়ে আলজেরিয়া, ইরাক; ২০০০ সালে পাকিস্তান, সুদান এবং বাংলাদেশ, সিরিয়ায় দেখতে পাচ্ছি। সিনাই উপত্যকার সশস্ত্র সংগঠন গুলো সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ চালানোর খবর আসছে। মিশরের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন যে কোন মুহূর্তে সংঘাতের দিকে চলে যাতে পারে যা ব্রাদারহুডের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নাও হতে পারে।
২০১১ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্ত পরবর্তী মিশরের রাজনীতিতে চেহরার পরিবর্তন ছাড়া প্রকৃত পরিবর্তন আনতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে ইসলামি চেহারার মধ্য দিয়ে থামানো হয়েছে। ফলে মিশরের রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার প্রভাব আগের মতো বজায় রয়েছে এবং আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামো ও নীতিকে প্রভাবিত করছে। ব্রাদারহুডকে ক্ষমতা আরোহণের রাজনৈতিক ফাঁদে আটকানো হয়েছে যদিও প্রকৃত ক্ষমতা তাদের হাতে ছিল না। ফলশ্রুতিতে মুরসির ক্ষমতাচ্যুতি সেনাবাহিনীর মর্জির উপর নির্ভর করে। মিশরের চলমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে ব্রাদারহুডের উচিত হবে না সেনাবাহিনীর সাথে রাজনৈতিক সমঝোতা করা। যে কোনো ধরনের সমঝোতা, মিশরের রাজনীতিতে মুসলিম বাদারহুডের অবস্থানকে দূর্বল করবে। ব্রাদারহুডের উচিত হবে তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সম্পর্কচ্ছেদ করে জনগণকে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে আহবান করা যা তাকে প্রকৃত ক্ষমতা প্রদান করবে এবং মিশরের অধিকাংশ জনগণকে তার পেছনে পাবে।
(আবু আনাসের লেখা অবলম্বনে)
এম.এম.আলম
ভূরাজনীতি বিশ্লেষক