মানব ইতিহাসের শুরু থেকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা মানুষের সামনে দুটি পথ খোলা রেখেছেন- আল্লাহ্, তাঁর নবী-রাসুল, আল্লাহ্’র ও’হী, আখিরাত-হাশর, জান্নাত-জাহান্নাম বিশ্বাসের পথ আর অন্যটি হচ্ছে অবিশ্বাস ও কুফরের পথ। মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই ঈমান আর কুফরের এক চিরন্তন দ্বন্দ্ব ও সংঘাত চলে আসছে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন,
“এবং আমি তাকে (মানুষকে) দুটো পথ (ভালো-মন্দ) দেখিয়েছি।” [সূরা আল-বালাদ:১০]
বর্তমান সময়ে এসে এই সংঘাত বিশ্বজনীন রূপ লাভ করেছে। আজ সেই সংঘাতের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্ এবং পশ্চিমা বিশ্ব তথা আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সকল অবিশ্বাসী কুফর শক্তি। মুসলমানদের উপর আমেরিকার আগ্রাসন এই উম্মাহ্’র উপর পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বের ধারাবাহিক হত্যা, নির্যাতন, দখলদারিত্ব আর নগ্ন শোষণের আরেকটি নির্মম অধ্যায়। পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্ব সবসময় চায় আমাদের উপর তাদের কুফর জীবনব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে আমাদেরকে শোষণ করতে।
আমরা মুসলমানরা সবাই জানি কিভাবে এই পূর্বে আমেরিকা ১০ বছরের ইরান-ইরাক যুদ্ধে সাদ্দামকে প্রকাশ্যে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে ও অস্ত্রের যোগান দিয়েছে।
এরপর আমেরিকা ও বৃটেন ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র রাখার অজুহাতে ইরাকী জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছে যাচ্ছে এক অন্যায় যুদ্ধ। যদিও তারা বিশ্বজনমতকে নিজের পক্ষে রাখার জন্য সাদ্দামের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের প্রস্তাব লংঘন এবং বিভিন্ন বিপজ্জনক অস্ত্র রাখার অভিযোগ এনেছে কিন্তু এটা সবার কাছেই স্পষ্ট যে এই যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য আরও সংহত করা ও ইরাকের বিশাল তেল সম্পদ লুঠ করা। আজ পর্যন্ত বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ যারা লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করার কাজে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আনবিক বোমা ও ভিয়েতনামে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছে। অপর দিকে ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনী ভূমি দখল ও হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যার প্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত আনীত অভিযোগগুলোর ব্যপারে জাতিসংঘ প্রস্তাব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষতঃ পশ্চিমা দেশগুলো ক্রমাগতভাবে উপেক্ষা করে চলেছেই। অপরদিকে উত্তর কোরিয়া যখন নিজেই পারমানবিক অস্ত্র রাখার ঘোষণা দেয় তখন আমেরিকা তার বিরুদ্ধে শুধু কুটনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলছে। এসব আচরণ পশ্চিমা বিশ্বের দ্বৈতনীতি ও স্ব-বিরোধিতার আসল চেহারা যেমন প্রকাশ করে দিয়েছে তেমনিভাবে এটাও প্রমাণ করেছে যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মূলতঃ মুসলিম বিশ্বের সম্পদ ভাগাভাগির জন্য পশ্চিমাদের একটি ক্লাব মাত্র।
কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি সবসময় চেষ্টা করেছে বিশ্বব্যাপী তাদের নিজস্ব পুঁজিবাদী জীবনব্যবস্থা কায়েম করতে। পুঁজিবাদী জীবনাদর্শের মূল ভিত্তি হচ্ছে দ্বীন এবং দুনিয়াকে আলাদা করা। এই জীবন দর্শন বিশ্বাস করে মানুষ হচ্ছে সার্বভৌম অর্থাৎ যা ইচ্ছা তাই করার মত স্বাধীন এবং মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের স্বার্থকে সর্বোচ্চ মাত্রায় অর্জন করা ও চরমভাবে জীবনকে উপভোগ করা।
মার্কিনীদের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী বিশ্বের একমাত্র প্রেরণা ও চালিকাশক্তি হচ্ছে এই ভোগবাদী জীবন দর্শন। “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের” নামে আমেরিকা, বৃটেন, ইসরায়েল, ভারত ও অন্যরা আমাদের দেশগুলোতে তাদের ঔপনিবেশিক স্বার্থকেই আরও নিরাপদ ও সুসংহত করতে চায়। তাদের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্রই হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের সম্পদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং ইসলাম যাতে জীবনব্যবস্থা হিসাবে মুসলিম বিশ্বে পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা। আজকের বিশ্বে ইসলামই পুঁজিবাদীদের জন্য একমাত্র আদর্শগত হুমকি।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বিশ্বব্যাপী প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে করে মুসলমানরা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার দেয়া জীবনব্যবস্থা ইসলামকে তাদের জীবনে গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। এটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যখন বুশ তার ২০০১ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর এর ভাষণে বলেছিল, “মার্কিন জনগণ এই ক্রুসেড কী তা বুঝতে শুরু করেছে”। এখন তারা একদিকে যে মুসলমানই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার শরীয়াহ্ দিয়ে জীবন যাপন করতে চায় তাকেই “মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী” বলে আখ্যায়িত করছে অপরদিকে নিজেদেরকে দাবী করছে শান্তিস্থাপনকারী হিসাবে। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে যে পশ্চিমা পুঁজিবাদী গোষ্ঠী নিজেদের কায়েমী স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আর্মি-ট্যাংক-মিসাইল সজ্জিত নিজেদের সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকেই উন্মাদের মত ইরাক, ফিলিস্তিন,কাশ্মীর থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশে নিরীহ মুসলমানদেরকে নির্বিচারে হত্যার কাজে ব্যবহার করছে – আদতে তারাই আসল সন্ত্রাসী। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন,
“যখন তাদেরকে বলা হয় “পৃথিবীতে বিশৃংখলা সৃষ্টি করো না” তারা বলে “আমরা তো শান্তি স্থাপনকারী”। বস্তুতঃ তারাই অশান্তি সৃষ্টিকারী, কিন্তু তারা তা বুঝতে পারে না” [সুরা-বাকারা:১১-১২]
তারা ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের কথা বলে যাতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা’র প্রদত্ত দিক নির্দেশনা মসজিদ, মুনাজাত আর রমাযান মাসে কিছু বিষয়ে মানা হয় আর আমাদের সমস্ত সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবন চলে মানবরচিত পুঁজিবাদী চিন্তা, মূল্যবোধ, প্রথা ও আইন-কানুন দ্বারা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও চলছে তাদের অব্যাহত প্রচার-প্রচারণা। এদেশের বিভাজনের রাজনীতিতে ইন্ধন দিয়ে আমাদের বিভক্ত রাখতে তারা অত্যন্ত সক্রিয়। তাদের এইসব কর্মকাণ্ড ও প্রচারণা সম্পর্কে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা আমাদেরকে সতর্ক করে বলছেন,
“নিঃসন্দেহে যেসব লোক কাফের, তারা ব্যয় করে নিজেদের ধনসম্পদ, যাতে করে বাধাদান করতে পারে আল্লাহ্ ‘র পথে“[সূরা-আনফাল:৩৬]
গত চল্লিশ বছর ধরে ধর্মনিরপেক্ষতা, পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র ইত্যাদি পশ্চিমা চিন্তা-ভাবনা বারবার আমাদের সমাজে প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা কি একটি সত্যিকার সভ্য ও বাসযোগ্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি ? বরং বর্তমানে আমাদের সমাজে যে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজী, দুর্নীতি, ধনী-গরীবের ব্যাপক বৈষম্য, অন্যান্য জাতির উপর অপমানজনক নির্ভরশীলতা ইত্যাদি অন্যায় চলছে তা এসব কুফর চিন্তা চেতনা গ্রহণ করার প্রত্যক্ষ ফল।
ইসলাম এবং ধর্ম নিরপেক্ষ পুঁজিবাদী জীবনব্যবস্থা কখনোই একসাথে চলতে পারে না। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা ও তাঁর রাসূল (সাঃ) এর প্রতি আমাদের ঈমান কখনোই আমাদের এই অনুমতি দেয়না যে সমাজে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার দেয়া জীবনব্যবস্থার বদলে মানুষের তৈরী জীবনব্যবস্থা চলবে আর আমরা তা নীরবে মেনে নেব। ইসলাম আমাদেরকে মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে, হোক সে ব্যক্তিগত ইবাদত কিংবা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কার্যাবলী, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার সার্বভৌমত্বকে মেনে নেয়ার হুকুম দিয়েছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন ও সতর্ক করছেন,
“রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহ্কে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ্ কঠোর শাস্তিদাতা” [সূরা আল-হাশর:৭]
“তবে কি তোমরা কিতাবের এক অংশ বিশ্বাস কর আর অন্য অংশকে অস্বীকার কর ? তোমাদের মধ্যে যারা এরকম করবে এই পৃথিবীতে তাদের জন্য রয়েছে চরম লাঞ্ছনা আর পরকালে তারা আস্বাদন করবে সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক আযাব” [সূরা-বাকারা:৮৫]
হে মুসলমানগণ! হে সমাজের নেতৃস্থানীয় মানুষেরা!
এখন সময় এসেছে একটি সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়ার- সময় এসেছে ইসলামকে আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করার। এখন আমাদেরকে ইসলাম ও কুফর এর মধ্যকার সংগ্রামের ব্যাপকতর বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে হবে। আমাদের সমাজে কুফর চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি ও কাজ-কর্মের ব্যাপক বিস্তার দেখেও আমরা যদি চুপ করে থাকি তাহলে আমরা কীভাবে দাবী করব যে আমরা আসলেই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা ও তাঁর রাসূল (সাঃ) কে ভালবাসি ও তাঁর (সাঃ) সুন্নাহকে অনুসরণ করি ? হক-বাতিলের এই সংগ্রামে আমরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারিনা- এটা আমাদের ঈমানের প্রশ্ন। মুসলমান হিসাবে এই দায়িত্বকে অবহেলা করার মানে হচ্ছে কাফেরদের দ্বারা আমাদের সমাজ ধ্বংসের যে ষড়যন্ত্র চলছে তাতে সাহায্য-সহযোগিতা করা।
এখন সময় এসেছে রাসূল (সাঃ), সাহাবা (রাঃ) এবং যুগে যুগে যেসব মুসলমান কুফর এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গিয়েছেন তাদের পক্ষ অবলম্বন করার; আর নিশ্চিতভাবেই এই পক্ষের মানুষেরা দুনিয়াতে ও পরকালে সফল হবেন।
যখন সংখ্যায় মুসলমানরা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার একচর্তুাংশ, মুসলমানদের হাতে আছে ব্যাপক খনিজ সম্পদ ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিসমূহ – তখন কেন আমরা পশ্চিমা আগ্রাসনের মুখে অসহায়ভাবে মার খাচ্ছি ? এর একটাই কারণ আর তা হচ্ছে আমরা পশ্চিমা পুঁজিবাদী শক্তির চিন্তা-চেতনা, আইন-কানুন ও নিয়ম-নীতির দাসত্বের শৃংখলে বাঁধা পড়ে আছি। এখন আমরা কেবলমাত্র পশ্চিমা সামরিক শক্তির দখলদারিত্ব নয় বরং তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এমনকি বুদ্ধিবৃত্তিক দখলদারিত্বেরও শিকার। যদি আমরা সত্যিই আমাদের ইরাকী মুসলিম ভাই-বোনদের সমব্যথী হই এবং আমেরিকা আর তার জোট দেশ গুলোর আগ্রাসনের প্রতি ঘৃণা অনুভব করি তবে তা আমাদেরকে অবশ্যই সক্রিয় প্রেরণা যোগাবে যাতে করে আমরা আমাদের ভূমি থেকে তাদের সকল কুফর প্রভাব সমূলে উৎখাত করতে পারি।
রাসুল (সাঃ) এর প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে, ইসলামের আদর্শগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামের মাধ্যমে সকল কুফর-পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের প্রভাব থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করাই হবে বাংলাদেশে আমাদের প্রধান দায়িত্ব। তার মানে আমাদেরকে সব ধরনের পশ্চিমা কুফর চিন্তা-চেতনাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে ইসলামকে পরিপূর্ণ আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে আর এভাবেই আমাদের সমাজের সমস্যা-সংকট সমূহের যথার্থ ও স্থায়ী সমাধান আসবে।
মুসলমান হিসেবে আমাদের এখন একটাই করণীয় আর তা হল আমাদের সমাজকে ইসলামি আক্বীদার ভিত্তিতে গড়ে তোলা এবং খিলাফত রাষ্ট্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। এই খিলাফত রাষ্ট্রের নেতৃত্বেই সমস্ত মুসলিম উম্মাহ্ও জান-মাল, সম্মান-সম্ভ্রম এবং সহায়-সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে ইনশাআল্লাহ্।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বিশ্বাসীদেরকে তাঁর পথে সংগ্রামের জন্য সাহায্য ও বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন,
“হে বিশ্বাসীগণ! যদি তোমরা আল্লাহ্কে সাহায্য কর, আল্লাহ্ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদেরকে দৃঢ়পদে প্রতিষ্ঠিত করবেন” [সূরা-মুহম্মদ:৭]