রাসুল (সা)-এর দেখানো আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা কিভাবে অপরাধ দূরীকরণে ভূমিকা রাখে?

আজকে আমি আলোচনা করব এমন একজন মানুষ সম্পর্কে যে মানুষ এসেছিলেন সমস্ত বিশ্বের জন্য রহমত সরূপ। তিনি হচ্ছেন আমাদের সবার প্রাণপ্রিয় রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা)। আর তিনিই যে পৃথিবীর জন্য রহমত সরূপ তা আল্লাহ্‌ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন “আমিতো তোমাকে বিশ্ব জগতের জন্য কেবল রহমত রূপেই প্রেরণ করেছি” (সূরা আম্বিয়া: ১০৭)। আমরা কি জানি রাসূল (সা) কিভাবে একটি আদর্শ সমাজ গঠন করেছিলেন এবং কিভাবে সমাজ থেকে আপরাধ নির্মূল করেছিলেন? বর্তমান সেকুলার পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কিভাবে সমাজ গঠনে ও অপরাধ নির্মূলে ভূমিকা রাখছে?

বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায় অপরাধ একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনের সংবাদপত্র বা টিভি মিডিয়ার প্রধান শিরোনামই থাকে কোন না কোন অপরাধের খবর এই অপরাধ গুলো হলো হত্যা, খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, গ্যাংস্টার, পিডফিলিয়া, ড্রাগ ইত্যাদি ইত্যাদি এ তো হল পশ্চিমা বিশ্বের অপরাধের স্টাইল আর আমাদের দেশে অপরাধের বিষয়গুলো আরো ব্যাপক যেমন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, রাহজানি, লুটতরাজ, ট্যাঁনডার বাজী, এসিড নিক্ষেপ, ইভটিজিং, ভূমী দখল, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের হল দখল ইত্যাদি ইত্যাদি। এই অপরাধের সংখ্যা দিনে দিনে বছরে বছরে আরো ব্যাপক হচ্ছে । গত বছর ২০১১-২০১২ ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে এ ৯.১ মিলিয়ন এর মত সব ধরণের crime case রেকর্ড হয়েছে। এতেই বুঝা যায় অপরাধের মাত্রা মারাত্নক আকার ধারণ করেছে। Capitalist সমাজ অপরাধের মূল উৎপাটনে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে অপরাধের পরিসংখ্যান মেপে অপরাধ বেড়েছে না কি কমেছে তা নির্ণয় করে থাকে।

আর যে কোন রাষ্ট্রের সামাজিক কালচার, অপরাধ তৈরী বা নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। সামাজিক কালচার গড়ে উঠে সে রাষ্ট্রের আদর্শের উপর ভিত্তি করে ।

আর সেকুলার সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠে বিভিন্ন ধরণের freedom এর উপর। এই so called freedom মানুষকে উৎসাহিত করে যে ভাবে ইচ্ছা সে ভাবে চলার। আর এ ধরণের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে মানুষ মনে করে আমি যদি আইনকে ফাঁকি দিয়ে যে কোন ধরণের crime করি এবং যদি ধরা না পড়ি তাহলে এটা কোন সমস্যা নয়।

আর সেকুলার পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আপরাধ করার প্রবনতা শুধু বঞ্ছিতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বড় বড় অপরাধের সাথে এখন শিক্ষক, নার্স, ডাক্তার, পেশাজিবি, এমন কি এমপি ও মন্ত্রীরা জড়িত।

আর বর্তমান সেকুলার সমাজে বিচার ব্যবস্থায় অপরাধীদের জন্য যে প্রতিষেধক বা প্রতিরোধক নয় তা তাদের জেলের সংখ্যার আধিক্য ও একজন মানুষের বার বার অপরাধ সংগঠনের প্রবণতায় প্রমাণিত হয়। আবার জেল থেকে বের হয়ে অপরাধী আরো বড় অপরাধী হয়ে উঠছে। ছিচকে সন্ত্রাসী হয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসীদের গডফাদার, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা হয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় নেতা, তাদের জেল থেকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হচ্ছে।

এতেই প্রমাণিত হয় সেকুলারিজম ব্যবস্থা এবং তার প্রচলিত আইনের মাধ্যমে অপরাধ নির্মূল করা কখনো সম্ভব নয়। কারণ যারা আইন তৈরী করেন তারা মানুষ। আর মানুষের চিন্তা শক্তি সীমিত। আর সীমিত চিন্তা শক্তি দিয়ে কোন আইন তৈরী করলে তা সমস্যা সমাধান করতে পারেনা, আর পারবেও না। তার প্রমাণ হল দিনের পর দিন অপরাধের সংখ্যা না কমে বাড়ছে।

তাই আমাদের বর্তমান প্রচলিত সেকুলার ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাধান না খুঁজে যিনি মানব জাতিকে তৈরী করেছেন আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর দেওয়া আইন ও নবী করীম (সা) এর দেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী যদি আমরা সমাধান খুঁজি তাহলেই সমাধান সম্ভব।

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন, আমাদের ফিতরা বা স্বভাব তাঁর জানা। তাই তাঁর কাছ থেকে প্রেরিত ব্যবস্থা দ্বারা যদি সমাজ পরিচালিত হয় এবং আইন প্রয়োগ করা হয় তাহলেই পৃথিবীতে অপরাধ দূর করা সম্ভব। তার প্রমাণ ইসলামিক শাসন ব্যবস্তার ১৩০০ বৎসরের ইতিহাস। কারণ ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠে তাকওয়ার ভিত্তিতে। তারপরে এটা গড়ে উঠে ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ করার ভিত্তিতে। এর ফলে মানুষের মধ্যে খোদাভীরুতা কাজ করে। সে মনে করে আমার প্রতিটি কাজের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে জবাবদিহি করা লাগবে এবং সাথে সাথে সামাজিক ভাবে মুনকারকে খারাপ চোখে দেখা হয়। যার ফলে মানুষ খারাপ কাজ থেকে অনেক দূরে সরে থাকে। তারপর ইসলামি রাষ্ট্রের মধ্যে যথাযথ আইনের ব্যবস্থা থাকে ফলে মানুষ কোন ধরণের অন্যায় করলে তাকে অবশ্যই ইসলামি দণ্ডবিধি অনুযায়ী বিচারের ব্যবস্থা করা হয়।

তাকওয়ার ভিত্তিতে সমাজ গড়ে উঠার কারণে মানুষের মধ্যে খোদাভিরুতা কাজ করে যার ফলে মানুষ চিন্তা করে আমি যদি অন্যায় করে আইনকে ফাঁকি দিতে পারলেও আমিতো আল্লাহ্‌র কাছ থেকে রেহাই পাব না। মৃত্যুর পর রয়েছে কঠোর শাস্তি। ফলে মানুষ এমনিতেই নিজেকে পাপাচার থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আবার অন্যদিকে পাপাচারকে সমাজে খারাপ চোখে দেখা হয় আর এরই সাথে সাথে রাষ্টীয় ভাবে পাপাচারের সব ব্যবস্থা বন্ধ রাখা হয়। দুই একটি উদাহরণ দিলে ইনশাল্লাহ আরো পরিষ্কার হবে।

“একদা রাসূল (সা) এর কাছে একজন মহিলা এসেছিলেন জেনা করার পর তাঁর শাস্তি ভোগ করার জন্য। রাসূল (সা) যখন শুনলেন মহিলাটি সন্তান সম্ভাবা তখন তাকে ফিরিয়ে দিলেন এবং বললেন সন্তান জন্মের পর আসার জন্য। মহিলা সন্তান জন্মের পর আবার ফিরে আসল। রাসূল (সা) তাকে আবার ফিরিয়ে দিলেন এবং বললেন তোমার সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর সময় শেষ হওয়ার পর আসার জন্য। মহিলা আবার ফিরে আসলেন দুধ খাওয়ানোর সময় শেষ হওয়ার পর এরপর রাসূল (সা) ইসলামের দেওয়া বিধান অনুযায়ী জেনার শাস্তির ব্যবস্তা করলেন। আর মহিলা জানতেন জেনার শাস্তি হবে কঠোর। কিন্তু তিনি বার বার ফিরে আসছিলেন তাঁর কৃত কর্মের শাস্তি ভোগ করার জন্য।

খলীফা উমর (রা) খিলাফতের সময়ের একটি ঘটনা- তিনি সবসময় রাতে বের হতেন নাগরিকদের সার্বিক অবস্থা দেখার জন্য। একদিন এক মহিলার ঘরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তিনি শুনতে পেলেন মহিলা কবিতা পাঠ করছে (উনার স্বামী তখন যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন) কবিতাটি এ রকম “এ রাত অতি দীর্ঘ ও কালো এবং বীভৎস, আর আমাকে ব্যথিত করে কারণ আমার কোন খেলার সাথী বা বন্ধু নেই। আল্লাহ্‌র কসম আমি আল্লাহ্‌কে ভয় না করলে এ পালঙ্কের বিভিন্ন দিক (পর পুরুষের সাথে মিলনে) নড়াচড়া করে উটত।

এ ধরণের উদাহরণ থেকেই প্রমাণিত হয় ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা কিভাবে মানুষকে পাপাচার থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। অতপরও কেউ যদি পাপাচার করে থাকে তাঁর জন্য কঠোর শাস্তির বিঁধান রয়েছে। সূরা মায়েদায় আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন “যে পুরুষ ও নারী চুরি করে তাদের হাত কেটে দাও তাদের কৃত কর্মের সাজা হিসাবে এ হল আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে দণ্ড”। এই ধরণের শাস্তি প্রয়োগে সাধারণ জনগণ আথবা ক্ষমতার অধিকারি সর্বোচ্চ ব্যাক্তির মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় না। সবার জন্য শাস্তি সমান। এই ব্যাপারে রাসুল (সা) বলেন “সে সত্তার শপথ যার হাতে আমি মুহাম্মদের প্রাণ নিহিত (মুহাম্মদের আপন কন্যা) ফাতেমাও যদি চুরি করতো তবে অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম।

খলীফা মনসুর এর সময়ে দেখি একজন সাধারণ ব্যাক্তি তখনকার কাজী ইমাম আবু ইউসুফ (র) এর কাছে অভিযোগ নিয়ে এসেছিলেন যে খলিফা তাঁর বাগান দখল করেছেন, এই অভিযোগ পাবার পর কাজী খলিফাকে আদালতে তলব করলেন। খলীফা মনসুর আদালতে হাজির হয়ে বিচারককে বললেন এই বাগানটি তিনি কিনেছেন, কিন্তু এর সপক্ষে কোন দলিল দেখাতে পারলেন না। ফলে বিচারক ইমাম আবু ইউসুফ (র) রায় দিলেন যে খলীফা যেন বাগানটি অভিযোগকারির নিকট বুঝিয়ে দেন।

এই রকম হাজারো উদাহরণ ইসলামিক শাসন ব্যবস্থায় রয়েছে। আর এতেই প্রমাণিত হয় সমাজ থেকে অপরাধ দূরীকরণে একমাত্র সঠিক ব্যবস্থা হচ্ছে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা।

তাই সেকুলার ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত বাংলাদেশে যে পাপাচার প্রকাশ্যে চলছে, যেমন পদ্মা সেতু দুর্নীতি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটেনি কেলেঙ্কারি ইত্যাদির সাথে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিবিদ ও আমলারা জড়িত, ঠিক তেমনি ভাবে মাঠ পর্যায়ে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির সাথে জড়িত। অন্যদিকে ভিন্ন সংস্কৃতির ফলে আমাদের তরুণরা বেহায়াপনা, অশ্লীলতা, নাচ গান, লিভ টুগেদারের মত অমুসলিম সংস্কৃতির সাথে জড়িত।

তাই এই অধপতিত ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থা থেকে মানুষকে বেরিয়ে আসতে হলে কুরআন এবং রাসূল (সা) কে ভালভাবে জানতে হবে। কুরআনের আইন এবং রাসূল (সা) এর দেখানো পদ্ধতি যদি আমরা ব্যাক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় ভাবে পালন করি তাহলেই সম্ভব একটি সুন্দর সমাজ গঠন। আর এটি সম্ভব একমাত্র খিলাফত রাষ্ট্রের মাধ্যমে।

Leave a Reply