শুধু আবেগ নির্ভর আন্দোলন নয়, চাই বিবেক নিয়ন্ত্রিত সঠিক সিদ্ধান্ত

মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিষয় দান করেছেন। একটি হচ্ছে আবেগ, অপরটি বিবেক। আবেগ এবং বিবেক এই দু’টি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ দু’টো এমন বিষয় যার কোনো একটিকেও বাদ দেয়া সম্ভব নয়। মানুষের যে কোনো কাজে এই দু’টি বিষয়ের সমন্বিত ও পরিমিত উপস্থিতি সেই কাজ ও বিষয়কে সর্বোচ্চ সফলতায় উন্নীত করতে পারে। একইভাবে এই দু’টি বিষয়ের সমন্বয়হীনতা বা কম-বেশি যে কোনো কাজ বিশেষত আন্দোলনকে নিক্ষেপ করতে পারে অন্ধকার আস্তাকুড়ে।

আবেগ হচ্ছে গতি। দ্রুততা। চলার শক্তি। আর বিবেক হচ্ছে নিয়ন্ত্রক। এখন যদি কোনো গাড়ির গতি যত দ্রুত আর শক্তিশালীই হোক না কেন, যদি সেই গাড়ির নিয়ন্ত্রণ বা নিয়ন্ত্রক সুস্থ্য ও বিচক্ষণ না হয় তাহলে যে কোনো সময় এই গতি ও দ্রুততাই সেই গাড়ি ও তার সকল আরোহীর জন্য মৃত্যু ডেকে নিয়ে আসতে পারে।

আবার শুধু নিয়ন্ত্রক যদি একা একা বসে থাকে, যদি গতি ও চলার শক্তি না থাকে তাহলেও কিন্তু সেই গাড়ি কোনো কাজে আসবে না। এক্ষেত্রে গতি ও নিয়ন্ত্রক উভয়ের সমন্বিত সুষম ব্যবহারই একমাত্র আবশ্যক কর্তব্য।

আমাদের দেশের সাম্প্রতিক সময়ে শুরু হওয়া শাহবাগ আন্দোলনের পুরোটাই আমার কাছে তরুণ প্রজন্মের আবেগকে ব্যবহার করে স্বার্থান্বেষী একটি মহলের ফায়দা লোটার অপচেষ্টা বলে মনে হয়েছে। এক্ষেত্রে বিবেকবানদের ভূমিকা ছিলো খুবই গৌন। নীরব। অনেকে নিজেদের বিবেককে ইচ্ছাকৃতভাবেই ঘুম পারিয়ে রেখেছিলেন। এই সুযোগে যৌবনের উন্মত্ত আবেগের পাগলা ঘোড়া ছুটেছে তার নিজ গতিতে। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টেছে দাবী-দাওয়া ও চাওয়া-পাওয়া। এই আন্দোলন এতোটাই আবেগ নির্ভর ছিলো যে তারা কার কাছে চাচ্ছে? কি চাচ্ছে? কিভাবে চাচ্ছে? আর কি কি তারা চাইবে? এর কোনোটিরই সুনির্দিষ্ট কোনো ছক বা পরিকল্পনা তাদের মাথায় ছিলো না। উম্মাহর এই তরুণ-যুবকদেরকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে এবং এখনও দিচ্ছে তারা কিছুক্ষণ পর পর রহস্যময় উৎস থেকে কিছু ওহী (নির্দেশনা) এনে পাঠ করছিলেন। কখনো কখনো উদ্দীপ্ত তারুণ্যকে শপথ পড়াচ্ছিলেন। দীক্ষা দিচ্ছিলেন। আবার তারপর তাদেরকে নাচ-গানসহ নানাবিধ বিনোদন আর নারী-পুরুষ ফ্রি-মাইন্ড সহাবস্থানের নামে বেলেল্লাপনা উসকে দিয়ে শাণিত করার নামে নির্জীব করছিলেন।

শুধু আবেগ নির্ভর হওয়ার কারণে মাত্র অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই এই আন্দোলন আজ যে কোন পর্যায়ে এসেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের ভবিষ্যতও বিচক্ষণ ব্যক্তিদের কাছে আজ উদ্ভাসিত হয়ে গেছে।

একইভাবে এই শাহবাগের এই আন্দোলন ও নাস্তিকদের অন্যায় আস্ফালনের বিরুদ্ধে এক পর্যায়ে দেশের আপামর আলেম-উলামা ও ইসলামী প্রতিষ্ঠান সমূহ পাল্টা আন্দোলনে নামেন। অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো দেশ জেগে উঠে। সারা দেশের ধর্মপ্রাণ তাওহীদী জনতা আলেমদের পাশে এসে দাঁড়ান। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সমর্থনে তারা তাদের সাধ্যানুযী প্রতিবাদ, বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। যার ফলে কল্পনাতীত দ্রুত গতিতে শাহবাগী নাস্তিকদের সূর পাল্টে যায়। এর চেয়েও দ্রুততার সাথে তাদের ধর্ম ও ইসলাম বিদ্বেষী সূর পরিবর্তিত হয় ধর্মকারী হিসেবে। এবার তারা নিজেদেরকে ইসলামের অনুগত ও খুবই ভক্ত একেকজন মুত্তাকী প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেন। চিহ্ণিত যেই নাস্তিকগুলো গত কয়েকবছর বুক ফুলিয়ে নিজেদেরকে নাস্তিক বলে পরিচয় দিতো তারাও যেনো শেয়াল থেকে বেড়াল হয়ে গেলো। তাদের হুক্কা হুয়া আজ মিঁউ মিঁউ শব্দে প্রতিধ্বনিত হয়ে মুমিনদের হাসির খোরাক যোগাচ্ছে। তাদের এই দ্বিমুখী স্বভাব বুঝতে পেরেই গত প্রায় বছর খানেক আগে ‘দুই কেজি মুরগীর কতটুকু খাবেন’ নামক নাস্তিকদের বাস্তবতা ও স্বভাব বিষয়ক একটি লেখায় বলেছিলাম আসলে আমাদের দেশে প্রকৃত নাস্তিক নেই বললেই চলে। সারা দেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজে দু’ই একজন প্রকৃত নাস্তিকও পাবো কিনা সন্দেহ আছে। কারণ নাস্তিকতার ভেকধারী কেউ আজ পর্যন্ত দুই কেজি মুরগীর পুরোট খেয়েছে বলে শোনা যায়নি। তারা এমনিতে সুবিধা নেয়ার জন্য নাস্তিকতার ভাব ধরলেও মুরগী খাওয়ার সময় ধর্ম এবং সামাজিক রীতি মেনেই যবেহ করে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করেই খেয়ে থাকে। এছাড়া অন্যান্য প্রায় সকল সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করে থাকে। -যাই হোক এটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। ভবিষ্যতে কখনো এ বিষয়ে আলাদা করে লেখার ইচ্ছা আছে।

নাস্তিকদের বিরুদ্ধে আজ যে বিশ্বাসী মুমিনদের আন্দোলন শুরু হয়েছে সত্য বলতে গেলে তাও মূলত: আবেগ থেকেই। এই আন্দোলনের মূল উপজীব্য বিষয় মুমিনদের অন্তরে বিদ্যমান ইসলাম ও প্রিয়নবী (সা) এর প্রতি শর্তহীন ভালোবাসা। আবেগের শক্তি ও গতি যেমন উপকারী তেমনি বিবেকের নিয়ন্ত্রণ ও সুশৃংখল পরিচালনাও অপরিহার্য বাস্তবতা। আজ উলামায়ে কিরাম যদি পুরো উম্মাহর মনের দাবী এ দেশে ইসলাম বিরোধীদের অপতৎপরতার বিষয়ে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ ও সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মূল দাবীতে এই আন্দোলনকে প্রথিত করতে না পারেন তাহলে শুধু আবেগ নির্ভর এই আন্দোলনও যে শীঘ্রই হারিয়ে যাবে -তা এক কঠিন তিক্ত অতীত সত্য বাস্তবতা।

অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ও বাস্তব প্রমাণ হাতে থাকার পরও উলামায়ে কিরাম ও উম্মাহর নেতৃবৃন্দ যদি দেশের আপামর জনসাধারণকে সংগঠিত ও সুশৃংখল করে একটি চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিতে না পারেন তাহলে এটি হবে আমাদের এক বিশাল ব্যর্থতা।

মিডিয়াতে ইসলাম ও উলামায়ে কিরামদের অবস্থান খুবই সীমিত প্রায় নেই বললেই চলে। মিডিয়ার ব্যাপারে শ্রদ্ধেয় আলিমদের কেনো এই উদাসীনতা ও সীমাহীন নিরাসক্তি তার বোধগম্য কোনো গত বিগত এক যুগেও আমি পাইনি। অথচ যদি শীর্ষ উলামাগণ চাইতেন তাহলে আজকে আলিমদের হাতে অন্তত ১৫ টি শক্তিশালী মিডিয়া থাকতো। এই অবিবেচক নির্লিপ্ততার কারণেই আজ বিশ্বাসীদের অনেক বড় বড় অর্জন গুলোর সঠিক সংবাদও জাতি পাচ্ছে না। এ বিষয়ে উলামায়ে কিরাম ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের সজাগ দৃষ্টি দেয়ার সময় কি এখনও আসেনি?

পাশাপাশি নাস্তিক ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালালদের ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদী শাস্তি ও সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। কারণ আজ আমরা যাদের কাছে নাস্তিকদের শাস্তি চাচ্ছি, আসলে তারাই তো তাদেরকে গানম্যান ও প্রটেকশন দিয়ে নিরাপদে অপকর্ম করে যাবার সুযোগ দিয়ে রেখেছে। ইসলামের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি তো তারাই করছে -সুতরাং তাদের একটি মিথ্যা আশ্বাস বা আইওয়াশ মূলক কাজের ফলে বিভ্রান্ত হয়ে উলামায়ে কিরাম ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ যদি তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন তবে এটি হবে আমাদের জন্য খুবই দু:খজনক একটি অধ্যায়।

মহান আল্লাহ আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দকে সঠিক বিষয়টি যথাযথভাবে উপলব্ধি করার তাওফীক দিন। মানুষের স্বার্বভৌমত্ব ও গোলামীতে আটকা পরে যাওয়া, গণতন্ত্রের মড়কের নিচে চাপা পরে থাকা অসহায় মানবতার মুক্তির জন্য ইসলামকে পুনরায় সমাজ ও রাষ্ট্রে বিজয়ী হিসেবে নিয়ে আসার লক্ষ্যে সঠিক কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করার তাওফীক দিন, আমীন।

ইসহাক খান

সংকীর্ণ জীবন

Leave a Reply