ইসলামের একদম শুরু থেকেই যখন আদি পিতা ইব্রাহীম (আ) দা’ওয়াহ করছিলেন তখন থেকেই থেকেই তিনি প্রচুর প্রতিকূল বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা) ও সাহাবাগণও (রা) একইভাবে বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজ পর্যন্ত ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দা’য়ীরা সম্মুখীন হয়ে আসছে বিভিন্ন প্রতিকুল অবস্থার।
যুগের পরিবর্তনে হয়ত পরিবেশের পরিবর্তন ঘটেছে; কিন্তু প্রতিকূলতা আজও বর্তমান।
অর্থ্যাৎ ইসলাম প্রতিষ্ঠায় প্রতিকূলতার সম্মূখীন হওয়া দা’য়ীদের জন্য অবশ্যম্ভাবী এক বাস্তবতা।
এই প্রতিকূলতা পরিবার, সমাজ, বন্ধু-স্বজন, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি ক্ষেত্র হতে আসতে পারে।
কিন্তু একজন দা’য়ীর জন্য এটা অনুধাবন করা অত্যাবশ্যকীয় যে, এই সকল প্রতিকূলতা আসে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ থেকে।
তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
“আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করবো ভয়-ভীতি, ক্ষুধা-অনাহার, তোমাদের জান-মাল ও ফসলাদির ক্ষতিসাধন করে; কিন্তু ধৈর্য্যশীলদের জন্য সুসংবাদ।” (আল বাকারাহ: ১৫৫)
“তোমরা কি মনে করা নিয়েছ যে, তোমরা এমনিতেই জান্নাতে চলে যাবে? অথচ পূর্ববর্তীদের মতো কিছুই এখনো তোমাদের ওপর নাযিল হয়নি, তাদের ওপর বহু ধরণের বিপর্যয় ও সংকট এসেছিল, কঠোর নির্যাতনে তারা নির্যাতিত হয়েছিল, কঠিন নিপীড়নে তারা শিহরিত হয়ে উঠেছে, এমনকি স্বয়ং আল্লাহ’র নবী ও তাঁর সঙ্গীরা এই বলে আর্তনাদ করে উঠেছে, আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য কবে আসবে? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আল্লাহ’র সাহায্য অতি নিকটে।” (আল বাকারাহ: ২১৪)
উপোরক্ত আয়াতগুলো দ্বারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মু’মিনদের বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাধ্যমে পরীক্ষার কথা বলেছেন।
ওহীয়ে গাইরে মাতলু অর্থ্যাৎ
মাহমুদ বিন লাবিদ হতে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন:
“যখন আল্লাহ আযযা ওয়া জাল কাউকে ভালোবাসেন, তিনি তাদের পরীক্ষা করেন। যে ব্যক্তি ধৈর্য্য ধারণ করে, তাকেও গ্রহণ করা হবে ধৈর্য্যশীল হিসেবে, এবং যে ক্লেশ প্রদর্শন করবে, তার জন্যও ক্লেশ সংরক্ষিত।” (আহমদ)
মুস’আব বিন সা’দ তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন,
তিনি রাসূলকে (সা) জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আল্লাহ’র রাসূল (সা), কোন ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়? তিনি (সা) বলেন, সর্বপ্রথম নবীগণ, এরপর সৎকর্মশীলেরা, এর পরবর্তীদের মধ্য থেকে সর্বোত্তম যারা এবং এর পরবর্তীদের মধ্যে সর্বোত্তম যারা। (এখানে পরীক্ষার কাঠিন্যতা বা পরিণাম দ্বারা বিভাগ বুঝানো হয়েছে) একজন ব্যক্তি তার দ্বীনের উপর আনুগত্যের উপর ভিত্তি করে পরীক্ষিত হয়। কেউ তার অঙ্গীকারের উপর দৃঢ় থাকলে তার পরীক্ষার পরিমাণও তীব্র হয়। এবং যদি তার অঙ্গীকারে দুর্বলতা থাকে, তবে তার পরীক্ষাও হাল্কা করা হয়। এবং একজন ব্যক্তি (যাকে আল্লাহ ভালোবাসেন) ক্রমাগতভাবে পরীক্ষিত হবে যতক্ষণ না সে পৃথিবীর বুকে কোন গুনাহ ছাড়া হাটবে।” (আহমদ)
অর্থ্যাৎ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা করেন ক্রমাগতভাবে। এবং আমাদের উচিত, এই সময়ে আল্লাহ’র উপর তাওয়াক্কুল করা; অর্থ্যাৎ ধৈর্য্যের সাথে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার উপর ভরসা করা এবং প্রতিকুলতার সম্মুখীন হওয়া। সকল ধরণের পরীক্ষাসমূহ আল্লাহ’র ইচ্ছা এবং এতে ধৈর্য্য ধারণ করে আল্লাহ’র কাছে সাহায্য চাওয়াই মু’মিনদের দায়িত্ব।
আয়িশা (রা) একবার রাসূল (সা)-কে প্লেগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি (সা) বলেন: “আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে এটি (প্লেগ) শাস্তিরূপে প্রদান করেন। এবং বিশ্ববাসীদের জন্য এটি রহমতস্বরূপ। আল্লাহ’র ইচ্ছায় যে বান্দা প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয় কিন্তু সে ধৈর্য্য ধারণ করে (আল্লাহ থেকে পুরষ্কারের আশায়) এবং বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তার জন্য যা অবধারিত করেছেন, তা ছাড়া তার কোনো ক্ষতি হবেনা, তবে সেই বান্দা শহীদের মতোই পুরস্কৃত হবে।” (বুখারী)
আবু হুরায়রা (রা) বরণনা করেন, রাসূল (সা) বলেছেন,
“আল্লাহ বলেন, ‘আমি আমার ঐ বিশ্বাসী দাসের জন্য জান্নাত পুরস্কার হিসেবে নির্ধারিত করেছি, যার কোন প্রিয় বন্ধুর (আমি) মৃত্যু ঘটায়, সে ধৈর্য্য ধারণ করে এবং আল্লাহ’র পক্ষ থেকে পুরস্কার আশা করে।” (বুখারী)
সুতরাং, প্রতিটি মুমিনের জন্য এটা আবশ্যক যে, তারা সকল প্রতিকূলতা ধৈর্য্যের সাথে আল্লাহ’র উপর ভরসা করেই সম্মুখীন হবে, এগুলো সবই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রদত্ত হুকুম, যাতে অসন্তোষ প্রকাশ করা সম্পূর্নরূপে হারাম।
‘আবদ আল্লাহ কর্তৃক বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, “যখন কোন মুসলিম কোন ক্ষতি দ্বারা কষ্ট পায় না, তখন আল্লাহ তার গুনাহসমূহ মাফ করে দেন যেভাবে গাছের পাতা গাছ থেকে ঝরে পড়ে।” (বুখারী ও মুসলিম)
আয়িশা (রা) বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন,
“আল্লাহ কোন মুসলিমকে বিপদ দ্বারা পরীক্ষা করেন এবং তার দ্বারা তার গুনাহ সমূহ মাফ করে দেন এবং তাকে সম্মানিত করেন। যদিও ঐ বিপদটি তার পায়ে একটি কাঁটা বিদ্ধ হওয়ার কষ্টই বা হয়ে থাকে”। (বুখারী ও মুসলিম)
এই হাদীসসমূহ এই বিষয়টিই স্পষ্ট করে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর বান্দাকে তাঁর হুকুমের প্রতি ধৈর্য্য ও কৃতজ্ঞতার ভিত্তিতেই পুরষ্কৃত করে থাকেন। এবং আল্লাহর এই হুকুমের বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ ব্যক্তিকে শুধুমাত্র আল্লাহ’র ক্রোধের পাত্র হিসেবে মনোনীত করে।
অর্থ্যাৎ, দা’ওয়াহর বার্তা বহনে এবং ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আমাদের কখনোই ধৈর্য্যহীন হওয়া সমীচীন নয়। বরং, আল্লাহ’র উপর তাওয়াক্কুল এবং তাঁর নির্ধারিত হুকুম (ক্বাদা) সন্তুষ্টির সাথে, আল্লাহকে ভালোবেসে তাঁর পক্ষ থেকে পুরস্কারের আশায় গ্রহণ করা আমাদের দায়িত্ব।
“সুতরাং, ধৈর্য্যশীলদের সুসংবাদ দাও”। (আল বাকারা: ১৫৫)