২০১১ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরে “শাসককে জবাবদিহিতা করার ফিকহ” শীর্ষক কর্মশালা আয়োজিত হয়েছিল। যেখানে ইবন কামালুদ্দিন আল হানাফি, উস্তাদ মুহাম্মদ আলি, উস্তাদ ইয়াহিয়া আবু ইয়ুসুফ, উস্তাদ কামাল আবু যাহ্রা, উস্তাদ আবু লুকমান ফাতহুল্লাহ প্রমুখ এ বিষয়ে লেকচার দেন। আমি চেষ্টা করছি লেকচারগুলোর ট্রান্সক্রিপ্ট যোগাড় করে বাংলায় আনুবাদ করতে। আপাতত দুটো লেকচার বাংলায় অনুবাদ করেছি আলহামদুলিল্লাহ এবং বাকিগুলোর কাজ চলছে, যা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে ইনশাল্লাহ। যেসব লেকচার গুলো অনুবাদ করা হবে বা হয়েছে তার তালিকা:
· সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ এর দায়িত্ব
· ইসলামে জবাবদিহিতা
· শাসককে জবাবদিহিতা করা মুসলিমদের অত্যাবশ্যকীয় কাজ
· শাসক ইসলাম দিয়ে শাসন করতে বাধ্য
· শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা নিয়ে প্রখ্যাত আলেমদের মতামত
· বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল এর শরীআহ দলীল
সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ এর দায়িত্ব
পবিত্র কুরআনে মুমিন ব্যাক্তিদেরকে সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ এর দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে অনেক আয়াত রয়েছে, তার মধ্যে একটি হল – “বনী ইসরাইল এর মধ্যে যারা (মাসীহ এর ব্যাপারে আল্লাহের ঘোষণা) অস্বীকার করেছে তাদের উপর দাউদ ও মারিয়াম এর পুত্র ইসাহর মুখ থেকে অভিশাপ দেয়া হয়েছে, কেননা তারা আল্লাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং সীমালঙ্ঘন করেছে। তারা যেসব গর্হিত কাজ করতো, তা থেকে তারা একে অপরকে বারণ করতো না, তারা যা করতো নিঃসন্দেহে তা ছিল নিকৃষ্ট। (সুরাহ মায়িদাহ, আয়াত: ৭৮-৭৯)
আল্লাহের রাগ এবং অভিশাপ বনী ইসরাইল এর উপর আপতিত হয়েছিল কারণ পাপ, মন্দকাজ, আল্লাহের-অবাধ্যতা থেকে তারা একে অপরকে বিরত রাখত না বা বারণ করতো না।
আব্দুল্লাহ বিন আলাওয়ী হাদ্দাদ (মৃত্যু ১৭২০) বলেন: সৎ কাজে আদেশ হল ওয়াজিব, অসৎ কাজে নিষেধ হল ওয়াজিব, কিন্তু মানদুব কাজে আদেশ এবং মাকরুহ কাজে নিষেধ করা মুস্তাহাব।
তাই, বলা যায়
১) এই দায়িত্ব কে কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমান করা যায়
২) এই দায়িত্ব কে এড়ানো যাবে না
৩) এই দায়িত্ব এড়ানোর ফলে আল্লাহের ক্রোধের কারণ হতে পারে।
আল সাইয়িদ আল শারিফ আল জুরজানি (মৃত্যু ১৪১৩) তার ইসলামিক অভিধানে “সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ” এর ব্যাপারে বর্ণনা করেছেন: সৎ কাজে আদেশ এর অর্থ হল “মুক্তির পথের জন্য নির্দেশনা”, এবং “অসৎ কাজে নিষেধ” এর অর্থ হল “শরীয়াহ এর পরিপন্থি ব্যাপারে সতর্ক / সাবধান করা”।
আলেমগণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলে থাকেন দুটো কাজের মধ্যে কোন বিভাজন নেই, অন্যভাবে বলতে গেলে দুটো কাজ আসলে একই, কেউ একটি কাজ বাদ দিয়ে অন্য কাজ করতে পারে না (যেমন অসৎ কাজে নিষেধ না করে শুধু সৎ কাজে আদেশ দেয়া)।
সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ এর গুরুত্ব:
কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সুরাহ আল-ই-ইমরানের আয়াত ১১০ এ বলেন: “তোমরাই (হচ্ছো দুনিয়ার) সর্বোত্তম জাতি, সমগ্র মানব জাতির (কল্যাণের) জন্যই তোমাদের তুলে আনা হয়েছে, (তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে) তোমরা দুনিয়ার মানুষদের সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে, আর তোমরা নিজেরাও আল্লাহের উপর (পুরোপুরি) ঈমান আনবে…”।
ইমাম আশ-শাওকানি (মৃত্যু ১৮৩২) এই আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, মুসলিমদের প্রতি আল্লাহ্ তায়ালার এই নতুন সম্বোধনই (সর্বোত্তম জাতি) বলে দেয় অন্যান্য সকল জাতি থেকে মুসলিম জাতি কেন উত্তম। কোন আলেম বলেনঃ লাওহে মাহফুজেই মুসলিমদেরকে উত্থিত করা হয়েছে। অন্য একজন আলেম বলেছেন – মুসলিমরা বিশ্বাস স্থাপন করার আগেই তাদেরকে সর্বোত্তম জাতি হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহ সকল জাতি (এমনকি পূর্ববর্তী নবীদের উম্মাহ) থেকেও উত্তম –এ ব্যাপারটি সাহাবাগণ বুঝতে পেরেছেন এবং তারা তাদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে পেরেছেন। “সমগ্র মানব জাতির (কল্যাণের) জন্যই তোমাদের তুলে আনা হয়েছে” – এ বিষয়টি সম্পর্কেও সাহাবাদের ধারণা পরিষ্কার ছিল। এবং আয়াতে “তোমরা দুনিয়ার মানুষদের সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে” – মুসলিমদের প্রতি আল্লাহ্ তায়ালার আরেকটি নতুন সম্বোধন যা মুসলিমদের সর্বোত্তম জাতি হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত অর্থাৎ যতক্ষণ মুসলিম জাতি একাজ করবে – তারা সর্বোত্তম জাতি হিসেবেই থাকবে। তাই মুসলিম জাতি যখন এই মহান কাজ বন্ধ করে দিবে তখনই তারা তাদের এই বিশেষ গুণ থেকে বঞ্চিত হবে।
ইবন কাসীর বলেন আল্লাহ্ তা’লা “সর্বোত্তম জাতি” বলতে মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সা) এর উম্মতকেই বুঝিয়েছেন। বুখারি বলেন – “সমগ্র মানব জাতির (কল্যাণের) জন্যই তোমাদের তুলে আনা হয়েছে” এ ব্যাপারে আবু হুরাইরা (রা) হতে আবু হাজিম হতে সুফিয়ান ইবন মায়সারা হতে মুহাম্মাদ ইবন ইয়ুসুফ বর্ণনা করেন – মুসলিমরা মানবজাতির মধ্যে সর্বোত্তম জাতি কারণ তাদেরকে গলায় শিকল দ্বারা বেঁধে তোলা হয়েছে এবং পরবর্তীতে তাঁরা ইসলাম গ্রহন করেছে।
একইভাবে ইবন আব্বাস, মুজাহিদ, ‘আতিয়া আল ‘আওফি, ইকরিমা, ‘আতা, আল রাবি’ ইবন আনাস বর্ণনা করেছেন – মুসলিমরা হল সমগ্র মানব জাতির মধ্যে সর্বোত্তম জাতি।
ইমাম আহমাদ বলেন, আবু লাহাবের কন্যা দুররা’র স্বামী আব্দুল্লাহ ইবন উমাইরা হতে সাম্মাক হতে শুরায়ক বলেছেন: আহমাদ ইবন আব্দুল মালিক বর্ণনা করেনঃ এক ব্যাক্তি উঠে দাঁড়িয়ে মুহাম্মাদ রাসুল্ললাহ (সাঃ) এর কাছে যায় (যখন তিনি মিম্বারে দাঁড়িয়ে ছিলেন) এবং জিজ্ঞাসা করেন, “ও রাসুলুল্লাহ, কারা সর্বোত্তম মানুষ?”; তিনি (সা:) উত্তর দিলেন, “তারাই হচ্ছে সর্বোত্তম মানুষ যারা কুরআন বেশী তিলাওয়াত করে, আল্লাহ্র ব্যাপারে সবচেয়ে সচেতন (বা হালাল/হারাম এর ব্যাপারে সতর্ক), সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করে এবং আত্মীয়স্বজনদের সাথে সম্পর্ক রাখে”।
উপরোক্ত আয়াত হতে আমরা বুঝতে পারি:
১) মুসলিম উম্মাহ কে সর্বোত্তম জাতির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করার শর্তে
২) অন্য কোন জাতি বা গোষ্ঠীকে এধরণের মর্যাদা দেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সা) বহু হাদীসে “সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ” এর মহৎ কাজকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন – যেমন:
১) মুসলিমদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হল সে, যে এই কাজে সবচেয়ে উৎসাহী
২) যে এই কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে, তাকে আল্লাহ্র প্রতিনিধি উপাধি দেওয়া হয়েছে
৩) যে এই কাজ করে, তাকে আল্লাহ্, কোরআন এবং রসুল্লালাহ (সা) এর প্রতিনিধি বলা হয়েছে
৪) মৃত ও জীবিত মানুষের মধ্যে মূল পার্থক্য হল এই মহান কাজ
সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ এর মৌলিক বিষয়সমূহ:
একই বিষয়ে সুরাহ আল-ই-ইমরানের ১১০ আয়াতে আল্লাহ্ (আজ্জা ওয়া জ্বাল) বলেন:
“আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম”।
এসকল আয়াত থেকে আমরা কিছু মৌলিক বিষয় বিবেচনা করে পারি:
· ‘আমীর (যারা কাজটা করবে) – যেকোনো মুসলিম (আল জায্যায – মা’আনি আল কোরআন ওয়া ই’রাবুহু), কিছু মুসলিম (আল জামাখশারি – আল কাশ্যাফ; আল কুরতুবি – আল জামি’লি আহকাম আল কোরআন; আল রাজি – মাফাতিহ আল গাইব; যাদের উপর থেকে এই দায়ীত্ব অব্যহতি দেওয়া হয় এ মহৎ কাজ থেকে তারা হল মহিলা, শিশু, মানসিকভাবে অসুস্থ), উলামা (ইবন কুতাইবা – তা’উইল মুশকিল আল কুরআন, আল রাজি – মাফাতিহ আল গায়েব; সামারকান্দি – আত-তাফসির), সাহাবাগণ (তাবারি – আল জামি আ’ল বায়ান)।
· মা’মুর (যাদেরকে দাওয়াহ দিতে হবে) – যেকোন মানুষ যথা মুসলিম ও অমুসলিম (মুকাতিল – আল তাফসির), শুধুমাত্র মুসলিম (মুকাতিল – আল তাফসির, আবুল ফাতহ আল জুরানি – তাফসির ই শাফি), সমগ্র পৃথিবীর সকল মানুষ (ইবন ‘আতিয়া – আল মাহর)।
· খাইর: সাধারণভাবে “ভালো কাজ” বুঝানো হয়। তবে আত-তাবারি (মৃত্যু – ৯২৩)’র সংজ্ঞা অনুযায়ী এর অর্থ দাড়ায় “ইসলামের আধ্যাত্বিক ও শরীয়াহ আইন এর পথে অন্যকে ডাকা” – (আত তাবারি, জামি’ আল বায়ান)। এর চেয়ে শ্রেয় সংজ্ঞা দিয়েছেন ইবন কাসির – “কুরআন এবং সুন্নাহ কে আঁকড়ে ধরা”। ইবন মারদাওায়হ হতে বর্ণিত, আবু জাফর আল বাকির বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আয়াতটি পড়লেন (তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি…) এবং তারপর বললেন, “সৎকর্ম হল কোরআন এবং আমার সুন্নাহ কে আনুসরন করা’।
· মা’রুফ: মা’রুফ এর অনেক অর্থ পাওয়া যায়। ইবনুল কাইয়ুম আল জাউযিয়্যাহ (মৃত্যু ১২০১) বলেন: এই আয়াতে মা’রুফ বলতে আল্লাহ্ তা’লার উপাসনা এবং আল্লাহ্র আইনের (শরীয়াহ) এর প্রতি আনুগত থাকা, এবং মুনকার বলতে আল্লাহ্র অবাধ্যতা বুঝানো হয়েছে (ইবনুল কাইয়ুম আল জাউযিয়্যাহ – জাদ আল মাসির)। শরীয়াহ’র যেসব কাজ ভাল ও সঠিক তার সবই (আল জুরজানি – কিতাব আল তারিফাত)।
· মুনকার: মুনকারের অর্থও অনেকগুল পাওয়া যায় – যার মধ্যে অন্যতম হল – আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল (সাঃ) কর্তৃক নিষিদ্ধ সকল কাজ (অর্থাৎ হারাম), কোরআন এবং সুন্নাহ এর আলোকে যার কোন ভিত্তি নেই, আল্লাহ্ ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ব্যাপারে মিথ্যাচার ইত্যাদি। আত-তাবারানি বলেন – শরীয়াহ এবং সুন্নাহ দ্বারা স্বীকৃত নয় এবং শিরক কেই বুঝানো হয়েছে (তাফসির আল কাবির); আত তাবারি বলেন – মুনকার বলতে আল্লাহ্র প্রতি অবিশ্বাস, মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁর প্রতি নাযিলকৃত অহীকে আস্বিকার যেমনঃ জিহাদ বা গনীমাতের মাল ইত্যাদি, (জামি আল বায়ান)। আল জুরজানি বলেনঃ যেকোন কথা বা কাজ যা আল্লাহ্ কে সন্তুষ্টি করে না তা-ই মুনকার (কিতাব আত-তারিফাত)।
· আমর (আদেশ)
· নাহি (নিষেধ)
· দাওয়াহ
মূল: ইবন কামালুদ্দিন আল হানাফি
অনুবাদ: প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আবু নাদরাহ