[নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত ‘আদ-দাওলাতুল ইসলামীয়্যাহ’ (ইসলামী রাষ্ট্র) বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে নেয়া হয়েছে]
ভূমিকা:
বর্তমান প্রজন্ম সেই ইসলামী রাষ্ট্রের স্মরণ থেকে বিস্মৃত হয়েছে, যা সত্যিকার ভাবে ইসলাম কায়েম করেছিল। আর ইসলামী রাষ্ট্রের (উসমানী খিলাফত-এর) সমাপনী বছর গুলোতে যারা এখানে বসবাস করেছে, যখন পশ্চিমা বিশ্ব এ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষনা করে, তারা মূলতঃ একটি ক্ষয়ে যাওয়া ধ্বংসোম্মুখ রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাক্ষী যেখানে ইসলামী বিধিবিধানের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশই কার্যকর ছিল। তাই আজ অধিকাংশ মুসলিমদের পক্ষেই ইসলামী শাসন-ব্যবস্থার সত্যিকারের স্বরূপ নির্নয় করা খুবই কঠিন। সমস্ত মুসলিম জাতির মনমগজ আজ বর্তমানে বিরাজমান পরিস্থিতির বেড়াজালে বন্দী। আর তাই, রাষ্ট্র-ব্যবস্থা বলতে কেবলই তাদের মানসপটে ভেসে উঠে নীতি বিবর্জিত হীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বরূপ, যা মূলতঃ মুসলিমদের উপর জোরপূর্বক চাপানো হয়েছিল।
বস্তুতঃ মুসলিম জাতির এই দূর্ভাগ্যজনক অধ্যায়ের এটিই একমাত্র সমস্যাযুক্ত দিক নয়। বরং এর চাইতেও কঠিনতম সমস্যা হলো সেইসব মুসলিমদের মন-মানসিকতার আমূল পরিবর্তন ঘটানো, যা পশ্চিমা সংস্কৃতির মোহে আবিষ্ট। আর পশ্চিমা সংস্কৃতি হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব কর্তৃক প্রয়োগকৃত এমন এক অস্ত্র, যা দ্বারা তারা ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে করেছে ভয়ংকর ভাবে রক্তাক্ত আর ক্ষতবিক্ষত। তারপর সেই রক্তাক্ত খঞ্জর হাতে গর্বিত ভঙ্গিমায় এ রাষ্ট্রের সন্তানদের ডেকে বলেছে, ”আমি তোমাদের রুগ্ন জননীকে হত্যা করেছি। যার ব্যবস্থাপনা আর অভিভাবকত্ব অতিশয় দূর্বল, তারতো নিহত হওয়াই উচিত। এছাড়া আমি তোমাদের জন্য সংরক্ষিত করেছি এমন এক জীবন ধারা, যেখানে তোমরা পাবে সুখ আর সমৃদ্ধির নাগাল।” তারপর তারা সেই দূর্ভাগা জননীর সন্তানদের উদ্বুদ্ধ করেছে সেইসব খুনীদের সাথে হাত মিলাতে যাদের খঞ্জর তখনও ছিল তাদের জননীর রক্তে রঞ্জিত। এ যেন হিংস্র হায়েনার ইপ্সিত শিকারের সাথে আচরন সদৃশ। শিকার যেখানে নিশ্চল, হতবিহবল আর কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এক প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী আঘাত কিংবা ভোজের জন্য কোন উপত্যকার পাদপ্রান্তে টেনে হিচঁড়ে নিয়ে যাবার পূব পর্যন্ত সে যেন চেতনায় ফিরে আসে না।
সুতরাং কিভাবে এইসব মোহাবিষ্ট হতবিহবল মানুষেরা অনুভব করবে, যে বিষাক্ত খঞ্জর তাদের জননীকে হত্যা করেছে, সেই একই মারনাস্ত্রেও মুখে আজ তাদের অস্তিত্বও বিপন্ন। এই একই অস্ত্র তাদের জীবনও নাশ করবে যদি না তারা এর থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারে। জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা (ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করা) সহ আরো অনেক ইসলাম বিরোধী ধ্যান ধারনা যা আজ মুসলিমরা বয়ে বেড়াচ্ছে, এসবই হচ্ছে বিষাক্ত গরল যা পশ্চিমা সংস্কৃতি মুসলিমদের ধমনীতে প্রবাহিত করেছে। এই বইয়ের মিশনারীদের আগ্রাসন সম্পর্কে আলোচিত অধ্যায়ে উপযুক্ত তথ্য প্রমান সহ এ সকল হত্যাকারীদের প্রকৃত উদ্দেশ্য, তাদের অপরাধের পেছনের কারন এবং উদ্দেশ্য সাধনে গৃহীত পদ্ধতি ও উপায় উপকরন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুতঃ তাদের সকল কার্যক্রমের এক ও একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইসলামকে এই পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা। আর এ লক্ষ্যে তাদের সবচাইতে কার্যকরী অস্ত্র ছিল পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতি, যা তারা ঢালাও ভাবে প্রচার করেছিল এবং এর ফলে মুসলিমরা ক্রমশঃ পরিণত হয়েছিল তাদের স্বেচ্ছা প্রনোদিত শিকারে।
মুসলিম জনগোষ্ঠি ভিন্নবধর্মী এ সংস্কৃতির সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে ছিল সম্পূর্ন অজ্ঞ। তাই যদিও তারা একদিকে পশ্চিমাদের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলেছিল, কিন্তু অপরদিকে তাদের সংস্কৃতিকেই সাদরে বরণ করে নিয়েছিল, যা ছিল পশ্চিমাদের দখলদারিত্ব শেকড় গেড়ে বসার মূল কারন। নির্মম বাস্তবতা হলো, মুসলিমরা কোনও গভীর পর্যালোচনা বা যুক্তি প্রমান ছাড়াই বিদেশীদের পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল ও তাদের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল এবং একই সাথে তাদের আলিঙ্গন করতেই নিজ বাহু উন্মুক্ত করে দিয়েছিল, পান করছিল তাদেরই এগিয়ে দেয়া বিষের পেয়ালা থেকে যে পর্যন্ত না তারা প্রাণহীন, নির্জীব আর ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। কেউ কেউ হয়তো ভেবে থাকবে, এসবই হচ্ছে যুদ্ধের স্বভাব সুলভ ধ্বংসাত্মক ফলাফল, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মুসলিমরা ছিল অজ্ঞানতা আর ভ্রান্ত নির্দেশনার অসহায় শিকার।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আসলে মুসলিমরা কি চেয়েছিল? তারা কি চেয়েছিল এমন একটি রাষ্ট্র যার ভিত্তি হবে ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু? নাকি তারা চেয়েছিল মুসলিম ভূখন্ডে বহু সংখ্যক রাষ্ট্রের উপস্থিতি? পশ্চিমা বিশ্ব মুসলিম ভূখন্ডে শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী হবার পর, ইতিমধ্যেই মুসলিমদের উপহার দিয়েছে অনেকগুলো রাষ্ট্র। তারপর এ রাষ্ট্রগুলোর সরকারকে প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে, মুসলিম ভূখন্ড গুলোকে খন্ডে খন্ডে বিভক্ত করে এবং সর্বোপরি ইসলামী শাসনকে প্রয়োজনহীনতায় পর্যবসিত করে তারা তাদের পরিকল্পনার চূড়ান্ত বাস্তব রূপ দান করেছে। এভাবে যতই সময় যেতে থাকে, তারা মুসলিম বিশ্বে তৈরী করতে থাকে নতুন নতুন রাষ্ট্র। এবং এ প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে যতদিন পর্যন্ত মুসলিমরা তাদের প্রস্তাবিত নীতি এবং ধ্যান-ধারনার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
বস্তুতঃ এখানে মূল বিষয় বহু সংখ্যক রাষ্ট্র নয় বরং সমস্ত মুসলিম বিশ্বে একটি একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। আবার শুধুমাত্র একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাও নয়, এবং নয় প্রতিষ্ঠা করা একটি নাম সর্বস্ব ইসলামী রাষ্ট্র – যার শাসন ব্যবস্থা আল্লাহতায়ালার নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী পরিচালিত নয়। কিংবা এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাও নয়, যা ইসলামী বিধিবিধান বাস্তবায়ন করে কিন্তু একটি বুদ্ধিবৃত্তিক বলিষ্ঠ ইসলামী নেতৃত্ব ছাড়াই যা সমস্ত বিশ্বে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দেবে। বরং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, এমন একটি একক রাষ্ট্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যা ইসলামী আকীদার (বিশ্বাস) ভিত্তিতে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে আসবে ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা, মানুষের হৃদয় এবং মানষিকতার গভীরে ইসলাম প্রোথিত করে সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত করবে ইসলাম, এ বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে দেবে ইসলামের আহবান।
ইসলামী রাষ্ট্র কোনও স্বপ্ন নয়, নয় এটা কারও মগজ প্রসূত আকাশ কুসুম কল্পনা। বরং এটা এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যা পৃথিবী শাসন করেছে দাপটের সাথে আর দীর্ঘ তেরশত বছর ধরে প্রভাবিত করেছে এ বিশ্বের ইতিহাস। এটা এমন এক বাস্তবতা, যা সব সময় ছিল এবং থাকবে। ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব প্রমাণের অপরিহার্য উপাদানগুলো কোনও ব্যক্তি বা অন্য কোনকিছুর উপেক্ষা অথবা আক্রমনের বহু ঊর্ধ্বে। আলোকিত মানুষেরা এটাকে তাদের জীবনে বাস্তবায়িত করেছে এবং সমস্ত মুসলিম উম্মাহ্ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেদিনের, যেদিন ফিরে আসবে ইসলামের সেই হারানো গৌরবমন্ডিত অধ্যায়। ইসলামী রাষ্ট্র কোনও ব্যক্তির আপন খেয়ালের অভিলাষ নয় বরং এটা আল্লাহতায়ালার পক্ষ হতে মুসলিমদের উপর অর্পিত দায়িত্ব, যা পালনে তারা অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ দায়িত্ব পালনে অবহেলাকারীদের জন্য অপেক্ষা করছে শাস্তি। আর যারা নিষ্ঠার সাথে পালন করবে এ দায়িত্ব, তাদের জন্য রয়েছে প্রতিশ্রুত উত্তম পুরস্কার।
কিভাবে এই মুসলিম উম্মাহ্ তাদের রবের সন্তুষ্টি অর্জন করবে, যদি না তাদের রাষ্ট্রে সম্মান ও মর্যাদা না আল্লাহতায়ালা, না তাঁর রাসুল (সাঃ), না ঈমানদারদের জন্য নির্দিষ্ট হয়? কিভাবে তারা তাঁর শাস্তি থেকে নিজেদের রক্ষা করবে যদি না তারা এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, যা প্রস্তুত করবে এর সামরিক শক্তি, রক্ষা করবে এর সীমানা, বাস্তবায়িত করবে আলাহ্ প্রদত্ত আইন কানুন এবং শাসন করবে আলাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী? সুতরাং, মুসলিমদের অবশ্যই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, কারন ইসলামী রাষ্ট্র ব্যতীত দ্বীন ইসলাম প্রভাবশালী অস্তিত্ব হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে না এবং তাদের ভূখন্ড কখনোই দার-উল-ইসলাম হিসাবে বিবেচিত হবে না, যদি না তা শাসিত হয় আলাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী।
ইসলামী রাষ্ট্র কোনও অবস্থাতেই একটি সহজলব্ধ প্রচেষ্টা নয়। তাই এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি সুবিধাবাদীদের মনে জ্বালায় না মিথ্যা আশার আলো (রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহন করাই যাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য)। প্রচেষ্টার এ পথে বিছানো রয়েছে কন্টক, অপেক্ষা করছে ভয়াবহ বিপদ, রয়েছে শত বাঁধা এবং কঠিন কষ্ট। এছাড়া ইসলাম বর্হিভূত সংস্কৃতি, অগভীর চিন্তাধারা এবং পশ্চিমা বিশ্বের তাঁবেদার শাসন-ব্যবস্থা যা তৈরী করেছে লক্ষ্য অর্জনে ভয়ংকর বাঁধা, এগুলোর কথা বলাই বাহুল্য। ইসলামী রাষ্ট্র পূর্নগঠনে যারা সত্যিকার ভাবে এ আহবানের পথে পা বাড়িয়েছে, তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন এক শাসন ব্যবস্থা যা মুসলিম ভূখন্ড গুলোতে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা এবং ইসলামের বার্তা পৌঁছে দেবে সমস্ত বিশ্বে। আর এজন্যই তারা শত প্রলোভনের পরও প্রত্যাখান করবে অন্য কারও সাথে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব। ততক্ষন পর্যন্ত তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহনও করবে না, যতক্ষন পর্যন্ত না তারা ইসলামকে মৌলিক, তাৎক্ষনিক এবং সর্বতোভাবে প্রয়োগ করতে পারে।
পরিশেষে এটা বলা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্র সর্ম্পকিত এই বইটির উদ্দেশ্য নয় এ রাষ্ট্রের অতীত ইতিহাস বর্ণনা করা। বরং, আলাহর রাসুল (সা) কিভাবে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং অবিশ্বাসী সাম্রাজ্যবাদীরা কিভাবে এটাকে ধ্বংস করেছিল,তা ব্যাখ্যা করাই এর মূল উদ্দেশ্য। এই বইটি পরিস্কার ভাবে বর্ণনা করেছে মুসলিম জনগোষ্ঠি কিভাবে তাদের রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে, যেন যে আলো গভীরতম অন্ধকারে একসময় তাবৎ বিশ্বকে পথপ্রর্দশন করেছিল, সেই একই আলো যেন প্রত্যাবর্তিত হয় আবারও সমগ্র মানবতাকে আলোকিত করতে।