বরফের মতোই গলে যাওয়া…

আজকে অফিসে আসার সময় দেখলাম অনেক গুলো বড় বড় বরফের খন্ড একটি পিকআপে করে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের গন্তব্য সম্ভবত কাওরানবাজার। গাড়ি থেকে প্রতি মূহুর্তে বরফ গলে গলে পরছে। পথিমধ্যে জ্যামে পরলো গাড়ি। এবার প্রায় অঝোর ধারায় পানি পরছে। মোটা মোটা বরফের খন্ড গুলো ধীরে ধীরে চিকন আর পাতলা হয়ে আসছে।

কয়েকদিন আগে ইফতার কেনার জন্য বাইরে বের হয়েছি ঠিক ইফতারের আগ মুহূর্তে। ইফতারের বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে রাস্তার দু’ধারে অনেক দোকান। এর পাশে ছোট দু’টি দোকানী দেখলাম বরফও বিক্রি করছে। প্রচন্ড গরমের দিনে রোজা এলে তখন বরফের বিক্রিও বেড়ে যায়। অবশ্য গরম এবার অতো বেশি না হওয়ায় তাদের বরফ অতো বিক্রি হচ্ছে না। ভীড় পাশের দোকান গুলোতেই। বরফ বিক্রেতাদের মুখ তাই খুবই মলিন। একদিকে ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসছে, অপর দিকে তাদের বরফও গলে যাচ্ছে। যে কোনো মূল্যে ইফতারের আগেই তাদের সব বরফ বিক্রি করতে হবে। না হলে অনেক লস হবে!

বরফের গলে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের কাছে খুবই বাস্তব এবং চাক্ষুস মনে হলেও এই বরফের মতোই আমাদের জীবনও যে ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে। জীবনের মূল্যবান সময় চলে যাচ্ছে। একটি নিশ্চিত পরিণতি ও গন্তব্যের দিকে যে আমরা প্রতি মূহুর্তে ধাবিত হচ্ছি তীব্র থেকে তীব্রভাবে, সেটি কিন্তু আমাদের আর মনে আসে না। স্মরণেও থাকে না।

বরফটুকু গলে যাওয়ার আগেই যে তাকে বিক্রি করে দিতে হবে, কাজে লাগাতে হবে; না হলে সমূহ বিপদ আর ভীষণ লস এটি সকলে খুব ভালো করে জানলেও, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্ত গুলো যে অহেতুক কাজে কেটে যাচ্ছে, সেদিকে আমাদের কারো ভ্রুক্ষেপ নেই।

আমরা খুবই নিশ্চিতভাবে একটি মহাসত্যের দিকে ধাবিত হচ্ছি। সেটি হচ্ছে আমাদের জীবনের পরিসমাপ্তি তথা মৃত্যু। মৃত্যুর মাধ্যমে এ জীবনের বরফতুল্য হায়াতটি শেষ হয়ে যাবার পরই আমাদের সম্মুখীন হতে হবে এমন এক কঠিন বাস্তবতার, যার কোনো প্রস্তুতি নেই আমাদের অনেকেরই। বরফ বিক্রেতার জন্য একবার ব্যবসায় লস হলেও আরেকবার লাভের সুযোগ থাকে। কিন্তু আমাদের জীবনের এই সময়টুকু একবার চলে গেলে, এরপর শত আফসোস করলেও যে আর কাজ হবে না। বরং মৃত্যুর সাথে সাথেই আমরা সম্মুখীন হবো এক কঠিন জিজ্ঞাসাবাদের। যেখানে আমাদেরকে হিসাব দিতে হবে আমাদের এই জীবনের। হিসাব দিতে হবে প্রতিটি মূহুর্তের। এ বিষয়টিই কত সুন্দরভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন মহান রাব্বুল আলামীন। ঘোষণা করেছেন-

خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ

অর্থ: ‍“তিনিই সেই মহান স্বত্ত্বা, যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু এবং জীবন। যেনো তিনি এর মাধ্যমে তোমাদের পরীক্ষা নিতে পারেন, (দেখে নিতে পারেন) কে তার কাজে সৎকর্মশীল। আর তিনি তো পরাক্রমশালী, ক্ষমাকারী।” (সূরা মুলক, আয়াত ২)

সেই কঠিন দিন শীঘ্রই আমাদের সবার সামনে উপস্থিত হবে। সেদিনের সেই কঠিন অবস্থায় মুক্তি লাভের জন্য আজ জীবনের এই ক্ষয়ে যাওয়া মূহুর্তগুলোকেই কাজে লাগাতে হবে। যেটুকু সময় অবশিষ্ট্য আছে সেই সময়ের মধ্যেই পরকালের জন্য সম্বল তৈরী করতে হবে। দীনের জন্য, ইসলামের বিজয়ের জন্য এবং মানব রচিত মতবাদ আর মতাদর্শের জুলুম নির্যাতন থেকে বিশ্ব মানবতাকে মুক্ত করার জন্য কিছু করে যেতে হবে।

দুনিয়ার চাকচিক্য আর বিলাসিতার মোহে পরে, পরকালকে যেনো আমরা ভুলে না যাই। অবশ্যম্ভাবী সেই কঠিন বাস্তবতা যেনো আমাদের চিন্তা থেকে হারিয়ে না যায়। আল্লাহ আমাদেরকে সেই তাওফীক দিন।

يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ وَاخْشَوْا يَوْمًا لا يَجْزِي وَالِدٌ عَنْ وَلَدِهِ وَلا مَوْلُودٌ هُوَ جَازٍ عَنْ وَالِدِهِ شَيْئًا إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ فَلا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللَّهِ الْغَرُورُ (33)

অর্থ: “হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর এবং সেই দিনকে ভয় কর, যেদিন পিতা তার সন্তানের কোন উপকার করতে পারবে না এবং সন্তানও তার পিতার কোন উপকারে আসবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং দুনিয়ার জীবন যেন কিছুতেই তোমাদেরকে ধোকা দিতে না পারে এবং মহাপ্রতারক (শয়তান) যেন তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে ধোকায় ফেলতে না পারে।” (সূরা লুকমান, আয়াত ৩৩)

ইসহাক খান

Leave a Reply