পশ্চিমাদের বৈদেশিক সাহায্যই কি উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নে ভুমিকা রাখছে?

দশকের পর দশক ধরে বৈদেশিক সাহায্যকে উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এ পর্যন্ত উন্নয়নশীর দেশগুলোকে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য প্রায় ২.৩ ট্রিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এসব সাহায্য দেয়ার পেছনে কি কোন দুরভিসন্ধি কাজ করে?

কখনও কখনও কেবলমাত্র মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সাহায্য করা হয়। অনেক সময় আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সহযোগীকে অনুদান দেয়া হয়। আবার কখনও কখনও গ্রহণকারী রাষ্ট্রের রাজনীতিকে প্রভাবিত করবার জন্যও সাহায্য দেয়া হয়। বিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্র এবং পু্ঁজিবাদের দ্বন্দ্বের সময়, এইসব আদর্শের পুরোধা সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করা কিংবা দুর্বল সহযোগীকে সাহায্য করবার জন্য আর্থিক অনুদানকে ব্যবহার করেছে। মার্কিনীরা সবসময় ইউরোপকে সমাজতন্ত্রের হাত থেকে বাঁচিয়ে পুঁজিবাদের দিকে নিয়ে আসবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। অনুন্নত দেশে সাহায্য সবসময় প্রদানকারী দেশের অনুকূলে যায়। এখানে আনুকূল্য বলতে সামরিক সুবিধা, বাজার সম্প্রসারণ, বিদেশী বিনিয়োগ, মিশনারী কার্যক্রম এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তার বুঝায়। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাহায্য প্রদানের পেছনে প্রাথমিকভাবে বড় বড় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের নতুন বাজার তৈরির হীন উদ্দেশ্য কাজ করে – যদিও এর পেছনে সাহায্য গ্রহণকারী রাষ্ট্রের জনগণের সুখ-স্বাচ্ছ্যন্দের কথা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা হয় ।

বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক সাহায্যর পরিমান ২০০৭
(বিলিয়ন ডলারে)  
যুক্তরাষ্ট্র২১ বিলিয়ন
জার্মানি১১ বিলিয়ন
ফ্রান্স৮.৯ বিলিয়ন
যুক্তরাজ্য৮.৮ বিলিয়ন
জাপান৭.৮ বিলিয়ন
হল্যান্ড৫.৬ বিলিয়ন
স্পেন৫.১ বিলিয়ন
সুইডেন৩.৮ বিলিয়ন
কানাডা৩.৫ বিলিয়ন
যুক্তরাষ্ট্র২১ বিলিয়ন
জার্মানি১১ বিলিয়ন
সুত্র: ও.ই.সি.ডি

বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক উইলিয়াম ইস্টারলি উন্নয়ন ও বৈদেশিক সাহায্যের উপর প্রচলিত ধারার সমালোচনা করে বলেন, দাতাগোষ্ঠীর অনুদান লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। তার মতে, ‘এটা পৃথিবীর দরিদ্র মানুষের জন্য অত্যন্ত কষ্টের বিষয় যে, বিগত পাঁচ বছর ধরে পশ্চিমারা অনুদান হিসেবে ২.৩ ট্রিলিয়ন ডলার দেবার পরও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত শিশুদের অর্ধেককেও মাত্র বার সেন্টের ওষুধ দেয়া যাচ্ছে না। পশ্চিমারা ২.৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে ফেললেও দরিদ্র পরিবারগুলোতে ৪ ডলার দামের মশারির ব্যবস্থা করা যায়নি। ২.৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হবার পরও ৫ মিলিয়ন শিশুর মৃত্যুকে ঠেকানোর জন্য তাদের মায়েদের হাতে ৩ ডলার তুলে দেয়া সম্ভব হয়নি। এটা খুবই হৃদয়বিদারক যে, বিশ্বসমাজ ধনী , বয়ঃবৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য বিনোদনের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে, কিন্তু দরিদ্র মৃত শিশুদের জন্য মাত্র ১২ সেন্ট যোগানো সম্ভব হচ্ছে না।’

বৈদেশিক সাহায্যের সব দিক নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, এটি কোনভাবে প্রশ্নাতীত নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও দাতাগোষ্ঠী তাদের ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য সিদ্ধি করবার জন্য এই অনুদানকে ব্যবহার করছে। যেমন:

১. মার্কিনীরা সেসব জায়গায় সাহায্য দেয় যেখান থেকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার উপর হুমকি আসতে পারে, যেমন: মধ্যপ্রাচ্য এবং ঠান্ডা যুদ্ধকালীন সময়ে মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারেবিয়ান দেশসমূহ।

২. সুইডেনের লক্ষ্য হল তথাকথিত “প্রগতিশীল সমাজ”।

৩. ফ্রান্স তাদের সংস্কৃতি, ভাষা এবং প্রভাব বিস্তার করবার জন্য বিশেষত পশ্চিম আফ্রিকার দেশসমূহকে সহায়তা দিয়ে থাকে। আবার যাদের সাথে ফরাসীদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে তাদেরকে অনানুপাতিক হারে অনুদান দেয়।

৪. জাপান তাদের পণ্য ক্রয়ের শর্তে পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে সহায়তা প্রদান করে।

ঔপনিবেশিকতার অবসানের পর বিশেষ করে আফ্রিকাকে বৈদেশিক সাহায্যের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী আশ্বস্ত করা হয়। জি-৮ সম্মেলন থেকে অসংখ্যবার অনুদান ও ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল সম্পর্কে বলা হয়, ‘এটা অনস্বীকার্য যে ব্যাপক হারে অপশাসন, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার স্বীকার হয়েছে আফ্রিকা। এ্যাকশন ফর সাউদার্ন অফ্রিকা সম্মেলনে বলা হয় : ‘এটা অনস্বীকার্য যে, আফ্রিকায় সুশাসনের অভাব, দূর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা রয়েছে। তবে উপনিবেশবাদের কুপ্রভাব, ঠান্ডাযুদ্ধকালীন সময়ে অবহেলিত অঞ্চলসমূহে জি ৮ এর মাধ্যমে প্রদত্ত সহায়তা, ঋণের ফাঁদ সৃষ্টি, বিশ্বব্যাংক ও আই.এম.এফ কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া কাঠামোগত পরিবর্তন কর্মসূচীর (স্ট্রাকচারাল এ্যডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম) ব্যাপক ব্যর্থতা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অযথার্থ নীতিমালা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। আফ্রিকার সংকট সৃষ্টিতে জি ৮ এর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। সেকারণে এ সংস্থাকে সংস্কার করতে হবে এবং আফ্রিকার উন্নয়নের পথে অন্তরায় সৃষ্টিকারী অন্যায় নীতিসমূহের প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।’

আজকের বিশ্বে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্য গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। সুশাসন নামক এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশসমূহ উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রন ও বাজারকে বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর জন্য উন্মুক্ত করার ব্যবস্থা করে। উন্নত দেশের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশসমূহের কৃষি ও বস্ত্রখাতে পর্যন্ত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ও ভর্তুকির সম্মুখীন করে।

Leave a Reply