ইসরাইল কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বকে নিয়ন্ত্রন করে ?

(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি আদনান খান রচিত “Geopolitical Myths” বইটির বাংলা অনুবাদের একাংশ হতে গৃহীত)

পৃথিবীর অনেক লোক ইসরাইলের দিকে অত্যন্ত ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। অথচ শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা ছিল নির্যাতিত একটি জাতি। মাত্র ৬০ বছর বয়সে ইসরাইল প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছে যে তার রয়েছে পৃথিবীর সর্বাধুনিক সেনাবাহিনী। এর জনসংখ্যা একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রের সমান হলেও শুরু থেকে পর পর চারটি পাতানো যুদ্ধে সে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে পরাজিত করে এমন একটি ধারণার জন্ম দেয় যে, সে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিই নয় বরং পুরো পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রন করছে। কিন্তু এটা খুঁজে বের করা দরকার কে কাকে নিয়ন্ত্রন করছে এবং তা কী পরিমাণে?

বিগত ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সম্পর্ক মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। কংগ্রেসে কোনরূপ প্রশ্ন ছাড়াই প্রতিবছর প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের সামরিক ও আর্থিক সাহায্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসরাইলে পৌঁছানোর অনুমোদন দেয়। এ ব্যাপারে উদারমনারা – যারা বিভিন্ন সময় মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেন এবং রক্ষণশীলরা-যারা বিদেশীদের সাহায্যের ব্যাপারে অনাগ্রহী সকলেই বিনা প্রশ্ন ব্যায়ে সম্মতি দিয়ে থাকেন। বস্তুত সকল পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ ইসরাইলের শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি মার্কিনীদের অকুন্ঠ সমর্থনকে প্রশংসার চোখে দেখে। জাতিসংঘসহ অন্যান্য ফোরামে অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহ যখন ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের দায়ে কোন প্রস্তাব উত্থাপন করে তখন প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্র একা তাদের পক্ষে অবস্থান নেয়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারস্য অঞ্চলের তেলের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠে। আর এ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে হলে আমেরিকা একা পেরে উঠবে না-এটা সে ভালই বুঝতে পেরেছিল। ১৯৪৫ সালে আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্ট আরব উপদ্বীপ সম্পর্কে বলে যে, ‘এটি কৌশলগত শক্তির একটি বিশ্বয়কর ভান্ডার এবং বিশ্বের ইতিহাসে সম্পদের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার।’ মার্কিনীরা বুঝতে পারে যে, পুরো পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রনে আনতে হলে এ অঞ্চলের তেলের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রভাবশালী পরিকল্পনাবিদ জর্জ কেনান বলেন, ‘যদি আমেরিকা তেলের উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে ভবিষ্যত প্রতিদ্বন্দ্বী জার্মানী ও জাপানের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর ভেটো ক্ষমতা বজায় রাখতে পারবে।’ মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব বুঝতে পেরে এ কারণে আমেরিকা এ অঞ্চলকে ঘিরে অসংখ্য পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছে।

১৯০৬ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হেনরী বেনারম্যান একটি ইহুদী জন্মভূমির পরিকল্পনার কথা বলেন, ‘মুসলিমরা পুরো পৃথিবীজুড়ে এরকম অনেক অঞ্চল দখল করে আছে যেগুলো প্রচুর দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান প্রাচূর্যে ভরপুর। পৃথিবীর সংযোগস্থলসমূহে তারা আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। তাদের ভূমিসমূহ ধর্ম ও মানবসভ্যতার পীঠস্থান। তাদের এক বিশ্বাস, এক ভাষা, এক ইতিহাস এবং অভিন্ন লক্ষ্য। কোন প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা তাদের মাঝে বাধা হয়ে দাড়াঁতে পারে না.. যদি কোন কারণে এই দেশসমূহ এক হয়ে যায় তাহলে পৃথিবীর ভাগ্য তাদের হাতে চলে যাবে এবং তারা পুরো বিশ্ব থেকে ইউরোপকে আলাদা করে ফেলবে। সেকারণে আরবের হৃদয়ের মাঝখানে এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে যা আরব বিশ্বের একীভূত হওয়াকে প্রতিহত করবে এবং অবিনাশী যুদ্ধের মধ্যে তাদেরকে সবসময় বেধে রাখবে। এ রাষ্ট্র পশ্চিমাদের অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করবে।’

ইসরাইলের জন্মই হয়েছিল আরবে মুসলিম বিশ্বের মাঝখানে ব্রিটিশ স্বার্থ সংরক্ষণ করবার জন্য। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বৃটেনের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় আমেরিকা এ অঞ্চলে এ পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বৃহত্তর ইসরাইলের স্বপ্ন নিয়ে গঠিত হলেও আমেরিকা ইসরাইলকে একটি সুনির্দিষ্ট সীমান্তের মধ্যে দেখতে চেয়েছিল। এটা ছিল ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার প্রথম মতপার্থক্য। ইসরাইলের অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট। একেবারে শুরু থেকে তারা তাদের সীমানা নির্ধারণে মোটেও রাজী ছিল না। এ ব্যাপারটি এটাই প্রমাণ করে যে, ইসরাইল কখনওই মার্কিন উপনিবেশ ছিল না এবং তাদের দু’জনের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে।

জায়নবাদী আন্দোলনের শুরু থেকেই ইহুদীরা এ অঞ্চলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে কাজ করে আসছে। আমেরিকা ইউরোপীয়দের আধিপত্যের স্থলে ইসরাইলীদের আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনাকে প্রত্যাখান করেছে এবং সে তার স্বার্থকে অন্য কারও সাথে ভাগাভাগি করতেও রাজী নয়। আমেরিকা ইসরাইলের নিরাপত্তা, সুরক্ষা এবং ইহুদীদের উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করবার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারপরেও মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি সম্প্রসারণ ও প্রভাব বৃদ্ধিকে ঠেকানোর জন্য মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরাইলকে একঘরে করে ফেলার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা হল আধিপত্য বিস্তারের জন্য একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এর মাধ্যমে বর্তমান ইসরাইল ও অন্যান্য আরব দেশ যেমন জর্ডান, সিরিয়া, মিশর ও ভবিষ্যত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের মাঝে সীমান্তকে সুরক্ষিত করবার জন্য ব্যাপক বহুজাতিক সৈন্য সমাবেশ ঘটানোর মাধ্যমে আর্ন্তজাতিক অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা। আমেরিকা জেরুজালেমের আন্তর্জাতিকীকরণের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। কেননা জেরুজালেম অনেক সম্প্রদায়ের জন্য একটি স্পর্শকাতর স্থান- বিশেষত খ্রীস্টানরা এতে বেশ সন্তুষ্ট হবে এবং এর মাধ্যমে জাতিসংঘের নামে মার্কিন আধিপত্য সুনিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বর্তমান যে অবস্থান রয়েছে তার নেপথ্যে রয়েছে বেশ কিছু কারণ:

১.    অনেক আমেরিকান ইসরাইলীদের প্রতি একধরণের আবেগিক সম্পর্ক অনুভব করে বিশেষত যারা উদারমনা সরকারী নেতৃবৃন্দ এবং প্রচারমাধ্যম। অধিকাংশই ইসরাইলের ঐতিহাসিক সংগ্রাম, শতাব্দীর পর শতাব্দী সংখ্যালঘু একটি জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার নিবিড় প্রচেষ্টা প্রভৃতিকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার চোখে দেখে।

২.    আমেরিকান খ্রীস্টানদের ডানপন্থীরা ঐতিহাসিকভাবে মিলিয়ন মিলিয়ন রিপাবলিকান সমর্থকদের নিয়ে সবসময় মিডিয়া ও রাজনৈতিকভাবে ইসরাইলকে ও ডানপন্থী ইসরাইলী নেতাদের সমর্থন দিয়ে আসছে। ধর্মতত্ত্ব অনুসারে পবিত্র ভূমিতে ইহুদীদের প্রত্যাবর্তন দ্বিতীয়বার যীশু খ্রীস্ট আসবার পূর্বশর্ত মনে করা হয় এবং বলা হয় ইসরাইলী ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার এ সংঘাত এটাই প্রমাণ করে যে ইসরাইল ঈশ্বরের ইচ্ছায় কেবলমাত্র ইহুদীদের।

৩.    মূলধারার ইহুদী এবং রক্ষণশীল ইহুদী সংগঠনসমূহ তদবির করা, তহবিল সংগ্রহ, প্রচারমাধ্যমসমূহে ইসরাইলী সরকারের পক্ষে নাগরিক চাপ প্রয়োগ প্রভৃতির জন্য শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরী করেছে। ইহুদী সমর্থকগোষ্ঠীর কাজ হচ্ছে ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বার্থের পক্ষে একটি পরিবেশ তৈরী করা এবং উদারমনা ও প্রগতিশীল ইহুদীদের ভেতর ইসরাইলবিরোধী চেতনার বিপক্ষে চাপ সৃষ্টি করা।

৪.    এ.আই.পি.এ.সি (আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি) এবং অন্যান্য ইহুদীবাদী সংগঠনগুলোর চেয়ে অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানীগুলো পাঁচগুণ বেশী অর্থ ব্যয় করে কংগ্রেসনাল প্রচার ও লবির জন্য। এসব কোম্পানী ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান মিত্রদের কাছে ব্যাপক পরিমাণ অস্ত্র বিক্রয় করে থাকে। সেকারণে নিজ এলাকায় অবস্থিত অস্ত্র বিক্রেতা কোম্পানীগুলোর স্বার্থের দিকে তাকালে বিভিন্ন কংগ্রেসম্যানদের ইসরাইলের পক্ষ অবলম্বন করা ছাড়া আর কিছুই করবার থাকে না। ইসরাইলে ২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির এক প্রস্তাবের কাছে ইন্দোনেশিয়ায় ৬০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব তাই ধোপে টেকে না।

ইসরাইল খুব সফলভাবে একটি রাষ্ট্র গঠন করেছে এবং দীর্ঘমেয়াদী বিবিধ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তার সম্পদকে কাজে লাগিয়েছে। অবশ্যই পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া আজকের ইসরাইলের অবস্থান সম্ভব হত না। তবে ইহুদীদের ভাষায় তারা স্থায়ী সীমানাবিশিষ্ট সেই রাষ্ট্রটি এখন পর্যন্ত কায়েম করতে পারেনি যার ভূখন্ডগুলোর ব্যাপারে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এর একটিই কারণ। আর তা হল মার্কিনীদের পরিকল্পনার ভেতর এটা নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী এমন একটি ইহুদী রাষ্ট্রের কথা রয়েছে যার পাশে রয়েছে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র। ইসরাইলের ইতিহাসে যে দলটি সবচেয়ে বেশী সময় ধরে ক্ষমতায় ছিল তা হল লিকুদ পার্টি-যা ইসরাইলের সীমানা নির্ধারণের জন্য মুসলিমদের হটিয়ে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে আসছে। কিন্তু যে কোন ধরণের চূড়ান্ত স্থাপনার জন্য আমেরিকার সমর্থন ইসরাইলের দরকার। সেকারণে মার্কিন ও বিশ্ব প্রচারমাধ্যম ও বিভিন্ন লবির মাধ্যমে ইহুদীরা তাদের চূড়ান্ত স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে আসছে। বৃহত্তর ইসরাইলের ধারণা বেশ জটিল। কেননা লেবার পার্টি মনে করে প্রয়োজনে কিছু ভূমি ছাড় দিয়ে হলেও ইসরাইলের সীমানাকে সুনির্দিষ্ট করতে হবে। আর এই ছাড় দেয়া ভূমি প্রয়োজন বৃহত্তর ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য।

সুতরাং ইসরাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন করে না বরং বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাবিত করে মাত্র। আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যকে সংগঠিত করছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল একই নীতি গ্রহণ করে থাকে কিন্তু ইসরাইলের কারণে আমেরিকা তার নীতি থেকে সরে আসে না। ইসরাইলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন তার অন্যান্য মিত্রদের প্রতি সমর্থনের মতই। কোন ধরণের নৈতিক দায়বদ্ধতা এখানে কাজ করে না। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সর্বদাই তার কৌশলগত স্বার্থকে চরিতার্থ করবার জন্যই প্রণীত হয়।

Leave a Reply