জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখা ও সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের উপযুক্ততা প্রমাণ করে না।

ভবিষ্যতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার নিষ্ঠুরতা ও গণহত্যার মত ভয়াবহ কিছু যাতে না ঘটে সেজন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একটি বিশ্বসংস্থার ব্যাপারে ঐকমত্য গড়ে উঠেছিল। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ গঠিত হয় প্রধানত ‘পরবর্তী প্রজন্মগুলোকে যুদ্ধের উন্মাদনা থেকে রক্ষার জন্য’ এই উচ্চাভিলাষী চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে । সেসময় থেকে পুরো পৃথিবী প্রায় ২৫০ টি সংঘাতের মধ্য দিয়ে গেছে। সেকারণে এটা জোর দিয়ে বলা যায়, যে উদ্দেশ্য নিয়ে জাতিসংঘ গঠিত হয়েছিল তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

পশ্চিমা বিশ্ব এমনকি তৃতীয় বিশ্বের অনেক নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন জাতিসংঘ হল ২০০টির মত সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত একটিনিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক সংস্থা-যেটি আন্তর্জাতিকতাবাদ, বহুপক্ষীয় কর্মকান্ড, গণতন্ত্র, পরমতসহিষ্ণুতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সহনশীলতা, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার প্রেরণায় উদ্ধুদ্ধ। এর থেকে বড় মিথ্যাচার কিছু হতে পারে না।

বাস্তবে জাতিসংঘ হল সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যসমূহের শোষণ ও নিপীড়নকে আইনগত বৈধতা দেবার জন্য গড়ে তোলা একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা।

১৯৯৪ সালে স্থায়ী সদস্যসমূহের সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ১০ লক্ষ জনগণের গণহত্যার স্বীকার হয় রুয়ান্ডা। ফ্রান্স (নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য) তুতসীদের বিরুদ্ধে হুতো উপজাতীয়দের সমর্থন দিয়ে উপনিবেশকালীন সময়ের মত একটি গৃহযুদ্ধের অবতারণা করল। এ যুদ্ধকালীন সময়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীকে কেবলমাত্র রুয়ান্ডায় অবস্থিত বিদেশীদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে ব্যবহার করা হয়েছিল কিন্তু তুতসীদের সহায়তায় কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সেসময় বেলজিয়ান শান্তি রক্ষীরা ২০০০ উদ্বাস্তুসহ একটি টেকনিক্যাল স্কুল ছেড়ে চলে যায় যখন বাইরে হুতু জঙ্গীরা অপেক্ষমান ছিল। শান্তিরক্ষীদের প্রস্থানের পরই জঙ্গীরা স্কুলে প্রবেশ করে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তার শিকার হয় শত শত শিশু। এর চারদিন পরই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ তার শান্তিরক্ষী কমিয়ে ২৬০ এ নামিয়ে নিয়ে আসার পক্ষে মতামত প্রদান করে।

এর এক বছর পর সেব্রেনিৎজার গণহত্যার সময় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। বৃটেন এবং আমেরিকা উভয়ই চাচ্ছিল এ অঞ্চল ভেঙে টুকরো টুকরো হোক। কিন্তু আমেরিকা ন্যাটোকে একটি কার্যকরী ভূমিকায় দেখতে চেয়েছিল। জাতিসংঘ ৬০০ ডাচ শান্তিরক্ষী নিয়োগ করে সেব্রেনিৎজাকে উদ্বাস্তদের জন্য ‘নিরাপদ আশ্রয়’ ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে এই ডাচরা সেব্রেনিৎজার উদ্বাস্তুদের সার্ব বাহিনীর হাতে তুলে দেয় এবং তারা ইতিহাসের ন্যক্কারজনক গণহত্যা চালায়।

জাতিসংঘ গণতান্ত্রিক রিপাবলিক কঙ্গোতে দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধেও ভূমিকা পালনে আবারো ব্যর্থ হয়। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারীতে নিরাপত্তা পরিষদের ১২৯১ নং সিদ্ধান্তের মাধ্যমে শান্তি প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী গঠন করা হয়। এই শান্তিরক্ষা বাহিনীও গৃহযুদ্ধে ৫০ লক্ষ লোকের গণহত্যা ঠেকাতে পারেনি।

প্যালেস্টাইন-ইসরাইল ইস্যুতেও জাতিসংঘ সমানভাবে ব্যর্থ। ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্রমাগতভাবে এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ আইনসম্মত উপায়ে নিরাপত্তা পরিষদে একটি নিন্দা প্রস্তাব প্রদানে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে।

জাতিসংঘ ভীষণভাবে অকার্যকরী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা পরিচালিত একটি সংস্থা হিসেবে পরিস্ফুট হয়ে উঠে দ্বিতীয় ইরাক যুদ্ধের সময়। সেসময় যুক্তরাষ্ট্র কোন রাখঢাকের দরকার মনে করেনি। জাতিসংঘে তাদের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জন বোল্টন জাতিসংঘের সম্পর্কে ২০০৪ সালে বলেন, ‘জাতিসংঘ বলতে কোন জিনিস আসলে অস্তিত্বহীন। যা আছে তা হল একমাত্র অবশিষ্ট সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।’

জাতিসংঘ মূলত নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যগণের (যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, বৃটেন, ফ্রান্স এবং চীন) পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের জন্য করা একটি বর্ধিত আন্তর্জাতিক সংস্থা। সমস্যা হল আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাপারে, যা বস্ততপক্ষে অস্তিত্বহীন। এখানে রয়েছে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও ঐতিহ্য কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন নয়। জাতীয়তাবাদমুক্ত একটি বিশ্বেই কেবলমাত্র আন্তর্জাতিক আইন প্রতিপালন সম্ভব। যেহেতু এ ধরণের বিশ্ব এখন নেই, সেকারণে জাতি রাষ্ট্রসমূহ তার প্রয়োজনমত আইন প্রণয়ন করে তা আবার নিজেদের ইচ্ছেমত ভাঙ্গে- নব্য বাস্তববাদ (neo realism)(সি.এফ ওয়াল্টজ.কে.১৯৭৯. ‘এ থিওরি অব ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স’)।

Leave a Reply