(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি আদনান খান রচিত “Geopolitical Myths” বইটির বাংলা অনুবাদের একাংশ হতে গৃহীত)
একটি যুক্তিসঙ্গত শান্তি প্রস্তাবনার আওতায় বিশেষত কসোভোতে একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনায় যুগোস্লাভিয়ার একপেঁশে অস্বীকৃতি জানানোকে ১৯৯৩ সালে পশ্চিমারা ন্যাটো কর্তৃক যুগোস্লাভিয়া আক্রমণের পেছনে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। ন্যাটো কর্তৃক বলকান অঞ্চলে হস্তক্ষেপ এবং বোমাবর্ষনের মাধ্যমে মাধ্যমে পশ্চিমারা বর্তমান “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” কে শুধুমাত্র ইসলামের বিরুদ্ধে একটি অভিযান বলতে নারাজ; বরং তারা বলতে চায়, পৃথিবীর যেখানে মানবতা আক্রান্ত হয় সেখানেই এ অভিযান অব্যাহত থাকবে-এমনকি মুসলিমদের রক্ষার ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সাবেক উপদেষ্টা ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র জেমস রুবিন ২০০৩ সালে এ ব্যাপারে সাফাই গাইতে গিয়ে বলেন, ‘ইরাক দখল, কসোভোতে মুসলিমদের গণহত্যার হাত থেকে রক্ষা করা এবং বসনিয়ায় বিলম্বিত মার্কিন হস্তক্ষেপের মাধ্যমে আমেরিকা মানবাধিকার রক্ষায় তার দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটিয়েছে।’
বাস্তবে ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য অন্যরকম। ১৯৯০ সালে বলকান অঞ্চলে সংঘটিত অস্থিরতা ছিল অত্র অঞ্চলে রাশিয়ার আধিপত্যকে বিচূর্ণ করে মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা, তার উপর ইউরোপ এর নির্ভরশীলতা বাড়ানো এবং ন্যাটোকে নতুন ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে ঠান্ডা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এর উপযোগিতা প্রমাণ করা।
পশ্চিমারা বিশেষত মার্কিন এবং বৃটিশরা যুগোস্লাভিয়াকে টুকরো টুকরো করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। যা যুগোস্লাভিয়ায় অবস্থিত মার্কিন দূত ওয়ারেন জিমারম্যানের কথায় ফুটে উঠে, ‘আমরা যুগোস্লাভিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত করার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি।’ ১৯৯২ এর ১৮ মার্চ তারিখে ইউরোপীয় ইউনিয়ন লিসবনে বসনিয়ান মুসলিম, ক্রোয়েট এবং সার্বিয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সার্বিয়ান প্রজাতন্ত্রকে তিনটি জাতিভিত্তিক অঞ্চলে বিভক্ত করে কনফেডারেশনের মাধ্যমে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করতে চায়। মার্কিনীরা এ প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করে বসনিয়ান নেতা আলিজা ইজতবেগোভিচকে স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দিয়ে বলতে বলেন, “মার্চের ১ তারিখে অনুষ্ঠিত গনভোটের মাধ্যমে এর যৌক্তিকতা প্রমানিত হয়েছে”। পশ্চিম ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেক্রেটারী জেনারেল জোসে কিউটিলেরো বলেন, “সত্যি কথা বলতে আসলে প্রেসিডেন্ট আলিয়া এজেদবেগোভিক এবং তার সহযোগিরা এই চুক্তিটি না মেনে একক বসনিয়ো রাষ্ট্রের জন্য লড়াই করার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন পশ্চিমা মদ্ধস্ততাকারীদের কাছ থেকেই”। এভাবেই বসনিয়ান গৃহযুদ্ধের শুরু।
আজকে বসনিয়া, কসোভো ও মেসেডোনিয়ায় শান্তিরক্ষার জন্য ১১০০০ সৈন্য উপস্থিতি রয়েছে-যা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থকে সংরক্ষণ করছে। নিউইয়র্ক টাইমসের সাথে প্রাক্তন কংগ্রেসম্যান লি হ্যামিল্টন বলেন, ‘আমরা পুরোপুরি বলকান অঞ্চলের নিয়ন্ত্রন নিয়ে নিয়েছি। মার্কিন কর্মকর্তাগণ সাবেক যুগোস্লাভিয়ার সর্বত্র ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত আছে। আমরাই মুলত; দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত।
ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ কারেন টালবোটের মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো পুরো যুগোস্লাভিয়া বিশেষত কসোভোকে অফুরান প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য দখলে রাখতে চায়। রাশিয়ার পশ্চিমে পুরো ইউরোপের মধ্যে এককভাবে কসোভোতে সবচেয়ে দামী প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ রয়েছে।’
নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, ‘রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিশাল ট্রেপকা মাইনিং কমপ্লেঙ্ হল বলকানদের সবচেয়ে মূল্যবান ভূ-সম্পত্তি। এর মূল্য কমপক্ষে ৫ বিলিয়ন ডলার, এতে উৎপাদিত হয় স্বর্ণ, রৌপ্য, বিশুদ্ধ শীশা, দস্তা, ক্যাডমিয়াম এবং প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার মুনাফা হয়। কসোভোর আরও আছে ১৭ বিলিয়ন টন কয়লা ভান্ডার এবং কসোভোর (সার্বিয়া এবং আলবেনিয়ার মত) তেল বন্দরও আছে’।
প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনতো একবার বলেই বসলেন, ‘পুরো পৃথিবীব্যাপী পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমে আমরা যদি একটি শক্তিশালী অর্থনীতির দিকে যেতে চাই তাহলে ইউরোপকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে….আর এর জন্যই কসোভোকে দরকার।’
বোমাবর্ষণ শেষ হওয়ার পর মার্কিনীরা বলকান অঞ্চলে অসংখ্য সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। কসোভোতে মার্কিনীরা একটি বড় সামরিক ঘাঁটি করে-যা ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর বিদেশে করা যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। ন্যাটোতে মার্কিনীদের ব্যাপক প্রভাব মূলত: এ অঞ্চলে ন্যাটোর আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকেই মজবুত করেছে। ফাঁস হয়ে যাওয়া পেন্টাগণের ১৯৯৪-১৯৯৯ প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা নির্দেশনা রিপোর্টে বলা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে, ‘ইউরোপীয়ানদের প্রাধান্য সৃষ্টির যে কোন পথ রুদ্ধ করতে হবে-যা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ন্যাটোকে চ্যালেঞ্জ করবে….একারণে পশ্চিমা নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার প্রাথমিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার এবং ইউরোপের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকতর প্রভাব ও অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ন্যাটোকে রক্ষা করা মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।’
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা বলা যায় যে, রাশিয়ার প্রভাবকে ক্ষুন্ন করা, কাস্পিয়ান সাগরে তেল সম্পদ এবং ন্যাটোর মাধ্যমে মার্কিন আধিপত্যকে আরও বেশী পাকাপোক্ত করাই ছিল বলকান অঞ্চলে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য। হাজারও নিষ্পাপ মানুষের জীবন এবং সেব্রেনিৎজায় অসংখ্য লাশ ছিল মার্কিনীদের এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠা প্রচেষ্টার চরমমূল্য।