বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি অধিকার (Intellectual Property Rights)

ভুমিকা

পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থায় বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি অধিকার (intellectual property right) একটি বহুল আলোচিত বিষয়। WIPO (World Intellectual Property Organization) এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৫ সাল থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে গড়ে ৩০ লক্ষের উপর আই পি আবেদন জমা পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন কংগ্রেসে উত্থাপিত (Stop online piracy act – SOPA) এবং (Protect intellectual property act – PIPA) বিলের প্রেক্ষিতে বিষয়টি আবারো আলোচনায় উঠে আসে। অনলাইনে কপিরাইটকৃত সম্পত্তির (বই, গান, চলচ্চিত্র ইত্যাদি) আদান প্রদান রোধের উদ্দেশ্যে বিল দুটি উত্থাপিত হয়। এই আইনের আওতায় সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের যেকোন অভিযুক্ত ওয়েব সাইটের বিরুদ্ধে যেসকল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে সেগুলো হচ্ছে: অনলাইনে অর্থ লেনদেনের সেবাদানকারী অথবা বিজ্ঞাপন দানকারী সকল প্রতিষ্ঠানের সাথে সাইটির সম্পর্ক চ্ছিন্ন করা, সকল ব্লগসাইট, অনলাইন ফোরাম এবং সার্চ ইঞ্জিন গুলো থেকে সাইটটির সকল লিংক মুছে ফেলতে বাধ্য করা এবং ইন্টারনেট সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান (ISP) গুলোর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সাইটটিতে প্রবেশ বন্ধ করা। বিলদুটি উত্থাপনের সাথে সাথে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। বিরোধিরা একে বাকস্বাধীনতা এবং সৃষ্টিশীলতার উপর আঘাত বলে প্রত্যাখ্যান করেন। wikipedia এর মতো প্রায় ৭০০০ সাইট এই আইনের প্রতিবাদে ১৮ জানুয়ারী, ২০১২ তারিখে তাদের সাইটগুলো বন্ধ রাখে অথবা এর প্রতিবাদে বিভিন্ন ছবি অথবা লিঙ্ক প্রকাশ করে।

এই প্রবন্ধে আমরা আই.পি অধিকারের ধারনা, এর উৎপত্তি, এর অসংগতি সমুহ, মানব সভ্যতার উপর এর নেতিবাচক প্রভাব এবং সবশেষে এ ব্যাপারে ইসলামের সমাধান নিয়ে আলোচনা করবো।

আই পি অধিকারের ধারনা:

বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ প্রধানত: তিন ধরনের – কপিরাইট, পেটেন্ট এবং ট্রেডমার্ক।

কপিরাইট বলতে কোন প্রকাশিত বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের উপর একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট কিছু অধিকারকে বোঝায়। এই অধিকার বলতে মুলতঃ কপি করার অধিকার হলেও তাতে আরো কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত যেমন এথেকে আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়া, একে অন্যকোন কাজের জন্য সাহায্যকারী উপকরন হিসাবে ব্যবহার করা ইত্যাদি।

পেটেন্ট এর মাধ্যমে কোন বৈজ্ঞানিক ধারনা, উৎপাদন প্রক্রিয়া বা আবিস্কারের উপর এর মালিকের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

ট্রেডমার্ক হচ্ছে কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ব্যবহৃত একটি বিশেষ চিহ্ন যার মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছে তাদের পন্য বা সেবাকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা হয়।

কোন কাজের কপিরাইট বা পেটেন্ট অর্জন করতে হলে কিছু বিষয় প্রমানিত হতে হয়। যেমন কাজটি যথেষ্ট মৌলিক, নতুন (novelty) বা আবিস্কারযোগ্য (non-obviousness)। এখানে লক্ষনীয় যে মৌলিকত্ব বা আবিস্কারযোগ্যতা বিষয়গুলো যথেষ্ট অস্পস্ট যা অনেকসময় আদালতে বিতর্কের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় এবং আইনজীবিদের দক্ষতার উপর নির্ভর করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাক্তি বা ছোট কোম্পানি গুলো বড় কোম্পানির সাথে আইনি লড়াইয়ে পেরে উঠে না।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:

বর্তমানে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইনের কারন হিসাবে আবিস্কারক বা লেখকের অধিকার রক্ষার কথা বলা হলেও তার শুরুটি হয়েছিল মধ্যযুগে বৃটিশ রাজতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে। ১৫ শতকের দিকে ছাপাখানা আবিস্কারের ফলে জনগনের মধ্যে রাজতন্ত্র এবং যাজকতন্ত্রের স্বার্থবিরোধী চিন্তাধারনা দ্রুত ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা দেখা দিলে ছাপাখানার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রন আরোপ করা হয়। এর মাধ্যমে জন্ম হয় কপিরাইট প্রথার। রাজতন্ত্রের অনুমতি সাপেক্ষে নির্দিষ্ট কিছু ছাপাখানার মালিকরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোন বই প্রকাশ করার অনুমতি পেত। পরবর্তীতে কপিরাইটের নামে অন্যান্য শিল্প যেমন লবন, চামড়া উৎপাদন, গানপাউডার, গ্লাস শিল্প ইত্যাদির উপর রাজতন্ত্র এবং তার অনুগত ব্যাক্তিদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয়।

IP অধিকারের অসংগতি এবং সমাজের উপর এর প্রভাব:

ব্যক্তি সম্পদের ধারনাটি মানুষের স্বভাবজাত এবং সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ এর চর্চা করেছে। অন্যদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ধারনাটি অপেক্ষাকৃত নতুন এবং তা একটি কৃত্রিম অধিকার। এই বুদ্ধিবৃত্তিক অধিকার বরং সম্পদের উপর ব্যক্তির বৈধ অধিকারকেই সীমাবদ্ধ করে ফেলে। কেউ যখন টাকার বিনিময়ে কোন যন্ত্র, বই অথবা যে কোন প্রকাশনার মালিকানা অর্জন করেন তখন স্বাভাবিক ভাবেই তিনি একে ব্যবহার করে লাভবান হবার অধিকার পান। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ধারনা এই মৌলিক অধিকারের প্রয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে।

বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইনের যৌক্তিকতার পিছনে শিল্প সাহিত্য এবং বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহের বিষয়টাকে তুলে ধরা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ধারনা ছাড়াই যুগে যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা হয়েছে। কপিরাইট আইনের প্রয়োগ ছাড়াই অনেক বড় মাপের শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ধারনাটি বরং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চাকে ভীষন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

একটি উদাহরনের মাধ্যমে আমরা তা বোঝার চেষ্টা করি:

১৭৬৪ সালের শেষের দিকে একটি এক সিলিন্ডার বিশিষ্ট সরল বাষ্পচালিত পাম্প মেরামতের সময় এর আরো উন্নত এবং কার্যকরি সংস্করনের কথা চিন্তা করেন স্কটল্যান্ডের কারিগর জেমস ওয়াট। পরবর্তি কয়েক মাস কঠোর পরিশ্রমের পর তিনি একটি উন্নত ইঞ্জিনের মডেল তৈরি করেন যাতে বাষ্প ঘনীভবনের জন্য একটি আলাদা চেম্বার রাখা হয়। ১৭৬৮ সালের তিনি তার নতুন উদ্ভাবিত ইঞ্জিনের পেটেন্ট এর জন্য আবেদন করেন। ১৭৭৫ সালে তিনি তার প্রভাবশালী ব্যবসায়িক অংশীদার শিল্পপতি ম্যাথু বোল্টনের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে পার্লামেন্টে একটি আইনপাশ করেন যার মাধ্যমে তার পেটেন্ট এর মেয়াদ ১৮০০ সাল পর্যন্ত বাড়াতে সক্ষম হোন। পেটেন্ট সুরক্ষিত হওয়ার পর জেমস ওয়াট তার ইঞ্জিনটিকে উন্নত করার পরিবর্তে সকল চেষ্টা ব্যয় করেন প্রতিদ্বন্দী ইঞ্জিনিয়ারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কাজে। ১৭৮১ সালে জোনাথন হর্নব্লোয়ার নামে একজন বিজ্ঞানী আরো উন্নত এবং সম্পুর্ন স্বাধীনভাবে ডিজাইনকৃত একটি ইঞ্জিনের উৎপাদন শুরু করলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয় এবং তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে কারাবরন করেন। ১৮০০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ জেমস ওয়াটের পেটেন্ট এর মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাস্পীয় ইঞ্জিনের তেমন কোন উন্নতি হয়নি। কোন বিজ্ঞানি জোনাথন সাহেবের পরিনতি বরন করার সাহস করেননি। জেমস ওয়াটের পেটেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অতি দ্রুত ইঞ্জিনের উন্নতি হতে থাকে। গড়ে প্রতিবছর ৪০০০ হর্সপাওয়ার যুক্ত হতে থাকে জেমস ওয়াটের সময় যার হার ছিল বছরে মাত্র ৭৫০ হর্সপাওয়ার। ১৮১০ থেকে ১৮৩৫ সালের মধ্যে ৫ গুন বেশি জ্বালানী দক্ষতা সম্পন্ন ইঞ্জিন উৎপাদিত হয়। শুধু তাই নয়, বাষ্পীয় ইঞ্জিনের বহুমূখি ব্যবহার শিল্প বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করে। বাষ্পচালিত ট্রেন এবং জাহাজের উৎপাদন যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা করে।

মজার ব্যপার হচ্ছে জেমস ওয়াট নিজেও তার উন্নত ইঞ্জিনের ডিজাইন করার কাজে বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন পেটেন্ট এর কারনে। ইঞ্জিনে ক্র্যাঙ্কশ্যফট এবং ফ্লাইহুইল প্রযুক্তির ব্যবহারের পেটেন্ট ছিল ইংরেজ বিজ্ঞানী জেমস পিকার্ডের অধিনে। ফলে জেমস ওয়াট তার ইঞ্জিনে এদের ব্যাবহার করতে পারেননি এবং কম দক্ষতা সম্পন্ন সৌর গিয়ার ব্যবহারে বাধ্য হন।

সুতরাং একথা বলা যায় যে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ধারনাটি শিল্প বিপ্লবকে প্রায় একশতাব্দী পিছিয়ে দেয়।

১৯৮০ সালে European Organization for Nuclear Research বা CERN এ কর্মরত একজন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ টিম বার্নার্স লী তার কম্পিউটারে রক্ষিত ফাইল অন্যদের সাথে শেয়ার করার একটি পদ্ধতি তৈরি করেন। এটি পরবর্তিতে ইন্টারনেটে পরিনত হয়। সাম্প্রতিক কালে তাকে ইন্টারনেট উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মাইলফলক কোনটি এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন ইন্টারনেটকে পেটেন্ট এর বাইরে রাখতে CERN কে রাজি করানোই ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন।

আজকের বিশ্বে আই পি অধিকারের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজে কিন্তু শুরুতে আন্তর্জাতিক ভাবে এর বাস্তবায়ন মেনে নেয়নি। কপিরাইট এবং পেটেন্টকৃত কাজের প্রধানতম রপ্তানীকারক দেশে পরিনত হওয়ার পর ১৯৮৯ সালে, বার্ন কনভেনশনের ১০৩ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র এতে স্বাক্ষর করে।

আন্তর্জাতিক ভাবে আই পি অধিকারের বাস্তবায়ন এবং অনুন্নত দেশগুলোর উপর এর প্রভাব:

১৮৮৩ সালে প্যারিস সম্মেলন এবং ১৮৮৬ সালে বার্ন সম্মেলনে আন্তর্জাতিক কপিরাইট চুক্তির মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্ব একটি সার্বজনীন কপিরাইট নীতির ব্যাপারে একমত হয়। ১৯৬৭ সালে বিশ্ব বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সংস্থা (World Intellectual Property Organization – WIPO) গঠিত হয় যা বিভিন্ন সদস্য দেশের Intellectual Property Office (IPO) গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের কাজ করে। কিন্তু সংস্থাটির আইন প্রয়োগের তেমন কোন ক্ষমতা ছিলনা। ১৯৯৫ সালে বিশ্ব বানিজ্য সংস্থা (WTO) আন্তর্জাতিক ভাবে Agreements on Trade-Related Aspects of Intellectual Property Rights – TRIPS এর মাধ্যমে আই পি অধিকার আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেয়। ১৫৪ টি সদস্যদেশের এই সংস্থাটি ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারি। এই ক্ষমতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই যখন TRIPS বাস্তবায়নের সাথে সাথে আফ্রিকার প্রায় আড়াই কোটি এইডস আক্রান্ত মানুষকে মৃত্যুর ঝুকিতে ঠেলে দেয়া হয়।

পেটেন্ট এর মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এখন আর শুধু সামরিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয় বরং ফল ফসল এবং গাছ গাছড়ার উপরও বিস্তৃত হয়েছে। যুগযুগ ধরে জনগনের মধ্যে প্রচলিত উৎপাদন প্রনালী গুলোতে বহুজাতীক কোম্পানিগুলোর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

ব্রাজিল জীববৈচিত্রের দিক দিয়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি দেশ যেখানে বিশ্বের ২২% উদ্ভিদের প্রজাতি জন্মে থাকে। কিন্তু এদের অর্ধেকের বেশিই এখন বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির দখলে।

টেক্সাসের রাইসটেক নামে একটি কোম্পানী ভারত এবং পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে চাষ হওয়া বাসমতি চালের পেটেন্টের জন্য আবেদন করে। জনমতের চাপে এর বিরুদ্ধে ভারত সরকার মামলা করতে বাধ্য হয়।

লন্ডন অবজার্ভারের একটি রিপোর্টে বলা হয়যে ভারত উপমহাদেশের শতাধিক গাছ-গাছড়া যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অফিসে রেজিস্ট্রেসনের অপেক্ষায় রয়েছে। ইতিমধ্যে নিম এবং হলুদের ঔষধি বিভিন্ন গুনাগুনের পেটেন্ট চলে গিয়েছে পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর হাতে। ট্রাইফোলিয়েট অরেঞ্জ নামে একধরনের কমলার চাষ বাংলাদেশে একসময় প্রচুর হতো। যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানী এর উপর ১৫ বছর গবেষনা চালিয়ে তার ডি এন এ ফিংগার প্রিন্ট নির্নয় করে তার পেটেন্ট করে।

উদ্ভিদের জেনেটিক বৈশিষ্টের উপর পেটেন্টের অধিকার হাইব্রিড ফসলের উপর গবেষনাকে উৎসাহিত করছে। অধিক উৎপাদনের আশায় কৃষকরা হাইব্রিড ফসলের দিকে ঝুকছে। এছাড়া সরকারি ভাবেও তাদের উপর হাইব্রিড বীজ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই হাইব্রিড বীজ পুনরায় উৎপাদন যোগ্য নয়। অর্থাৎ একবছরের উৎপাদিত ফসল পরের বছর বীজ হিসাবে ব্যাবহার করা যায়না। দীর্ঘমেয়াদে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে:

প্রথমত: বীজের জন্য বহুজাতিক কোম্পানীর প্রতি স্থায়ী নির্ভরতা তৈরী হবে এবং একসময় তাদের নির্ধারিত দামে বীজ কিনতে বাধ্য হবে কৃষকরা। কারণ তারাই হাইব্রিড বীজের বাজার একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রন করে এবং তাদের নামেই রয়েছে পেটেন্ট।

দ্বিতীয়ত: হাইব্রিড বীজের ব্যাবহারের ফলে একসময় দেশী প্রজাতীগুলো বিলুপ্ত হয়ে পড়বে (ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের অনেক প্রজাতীর ধান বিলুপ্ত হয়েছে অনেক প্রজাতী বিলুপ্তপ্রায়) ফলে বহুজাতিক কোম্পানীর বীজ না পাওয়া গেলে কৃষি উৎপাদন অসম্ভব হয়ে পড়বে। দেশীয় চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পুর্নতা নয় খাদ্যের জন্য বহুজাতিক কোম্পানীর প্রতি সম্পুর্ন নির্ভরশীলতা তৈরী হবে।

‘সবুজ বিপ্লব’ এর শ্লোগানে অধিক কৃষি উৎপাদনের নামে স্থানীয় কৃষিব্যবস্থা ধ্বংস করে বিদেশী বীজের প্রতি যে নির্ভরশীলতা তৈরী হচ্ছে তাতে লাভবান হচ্ছে বহুজাজতিক কোম্পানী, এসব বীজের পেটেন্ট শর্তে গ্যাট চুক্তির মেধাস্বত্ব আইন অনুযায়ী রয়ালিটি পাচ্ছে আমেরিকা আর ধ্বংস হচ্ছে দেশী প্রজাতি এবং পরিবেশ।

ইসলামের দৃষ্টিতে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি:

ইসলামে ব্যক্তিমালিকানা বলতে কোন বস্তু থেকে স্রষ্টার অনুমতি সাপেক্ষে লাভবান হওয়ার অধিকারকে বোঝায়। সুতরাং ইসলামে কোন বস্তুর মালিকানা ঐ বস্তু বা তা থেকে প্রাপ্ত লাভের উপর নির্ভর করেনা বরং ঐ বস্তুটির ব্যপারে এবং তা অর্জনের উপায়ের ব্যাপারে শরীয়ার অনুমতির উপর নির্ভর করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কিছু বস্তুর মালিকানাকে বৈধ এবং কিছু বস্তুর মালিকানাকে অবৈধ করেছেন। তেমনি বস্তুর মালিকানা অর্জনের কিছু পদ্ধতিকে যেমন ক্রয়বিক্রয়, উপহার ইত্যাদিকে বৈধ এবং কিছু পদ্ধতি যেমন জুয়া, সূদ ইত্যাদিকে অবৈধ করেছেন।

ইসলাম সম্পদের শরীয়া অনুমোদিত বৈধ ব্যবহারের অধিকারকে সংরক্ষন করে। কোন আবিস্কারক তার আবিস্কারকে বিক্রি বা হস্তান্তরের মাধ্যমে লাভবান হতে পারেন। একই ভাবে কোন ব্যাক্তি তার কেনা বই, সফটওয়্যার ইত্যাদি শরীয়া নির্ধারিত উপায়ে ব্যবহারের অধিকার সংরক্ষন করেন যার মধ্যে রয়েছে বিক্রি, কপি তৈরি বা উপহার দেয়া ইত্যাদি। কিন্তু মূল লেখক বা উদ্ভাবকের নাম পরিবর্তন করা বৈধ হবে না কারন সেক্ষেত্রে তা হবে মিথ্যাচার যার অনুমতি নেই। এটি লেখক বা উদ্ভাবকের নৈতিক অধিকারের পর্যায়ভুক্ত। যেহেতু পুজিবাদী ব্যবস্থায় সবক্ষেত্রে বস্তুগত লাভের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয় তাই এই বিষয়টিকেও আর্থিক লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে দেখা হয়ে থাকে। যেসকল ধর্মনিরপেক্ষ আইনের ভিত্তিতে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ যেমন বই, সফটওয়্যার বা বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের নির্দিষ্ট ব্যবহার নির্দিষ্ট কিছু ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রনে থাকে ইসলামী শরীয়াতে তার কোন ভিত্তি নেই। ইসলামের ক্র‌য় বিক্রয়ের শর্ত অনুযায়ী ক্রেতা বস্তুটির উপর সম্পুর্ন মালিকানা অর্জন করেন।

আয়িশা (রা) হতে বর্নিত, তিনি বলেন – বারীরা এসে বললেন, আমি প্রতি বছর এক উকিয়া করে নয় উকিয়া আদায় করার শর্তে কিতাবাতের চুক্তি করেছি। এ ব্যাপারে আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আয়িশা (রা) বললেন, তোমার মালিক পক্ষ সম্মত হলে আমি উক্ত পরিমাণ এককালীন দান করে তোমাকে আজাদ করতে পারি এবং তোমার ওয়ালা হবে আমার জন্য। তিনি তার মালিকের কাছে গেলেন, তারা তার এই শর্ত মানতে অস্বীকার করল। তখন তিনি বললেন, বিষয়টি আমি তাদের কাছে উত্থাপন করেছিলাম, কিন্তু ওয়ালা তাদেরই হবে, এ শর্ত ছাড়া তারা মানতে অসম্মতি প্রকাশ করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা) বিষয়টি শুনে এ সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন। আমি ঘটনাটি তাকে খুলে বললাম। তখন তিনি বললেন, তাকে নিয়ে নাও এবং আজাদ করে দাও। ওয়ালা তাদের হবে এ শর্ত মেনে নাও, (এতে কিছু আসে যায় না)। কেননা, যে আজাদ করবে, ওয়ালা তারই হবে। আয়িশা (রা) বলেন, এরপর রাসুলুল্লাহ (সা) সাহাবীগনের সমাবেশে দাঁড়িয়ে আল্লাহ’র হামদ ও সানা পাঠ করলেন আর বললেন, তোমাদের কিছু লোকের কি হল? এমন সব শর্ত তারা আরোপ করে, যা আল্লাহ’র কিতাবে নেই। এমন সব শর্ত, যা আল্লাহ’র কিতাবে নেই, তা বাতিল বলে গন্য হবে; এমনকি সে শর্ত শতবার আরোপ করলেও। কেননা আল্লাহ’র হুকুমই যথার্থ এবং আল্লাহ’র শর্তই নির্ভরযোগ্য। তোমাদের কিছু লোকের কি হল? তারা এমন কথা বলে যে, হে অমুক, তুমি আজাদ করে দাও, ওয়ালা (অভিভাবকত্ব) আমারই থাকবে। অথচ যে আজাদ করবে, সেই ওয়ালার অধিকারী হবে।

এই হাদীসের শব্দচয়ন (Mantooq) এই ইঙ্গিত বহন করে যে, কোন শর্ত যা আল্লাহ’র কিতাব এবং তার রাসুলের সুন্নাহ’র সাথে সাঙ্ঘর্ষিক তা পালনীয় হবে না। এছাড়া আল্লাহ’র রাসুল (সা) বলেছেন, “মুসলমান গন তাদের চুক্তির শর্ত পালনে বাধ্য, যতক্ষন পর্যন্ত তা কোন হালালকে বাধাগ্রস্ত না করে বা হারামের অনুমতি না দেয়।”

সুতরাং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের অধিকারের নামে যদি তার বৈধ ব্যবহারকে বাধাগ্রস্ত করা হয় তাহলে তা হবে আল্লাহ’র কিতাব এবং রাসুলের সুন্নাহ’র পরিপন্থি কারন তা শরীয়া নির্ধারিত ক্রয় বিক্রয়ের চুক্তির বিপরীত যেখানে যে কেউ তার ক্রয় কৃত বস্তু থেকে বৈধভাবে লাভবান হওয়ার অধিকার পেয়ে থাকেন।

বাংলাদেশে পেটেন্ট আগ্রাসন – টিফা থেকে টিকফা:

যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সাল থেকে প্রায় দশ বছর ধরে বাংলাদেশে টিফা (Trade and Investment Framework Agreement) বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। অসংখ্য বার দুই দেশের মধ্য এর খসড়া আদান প্রদান হলেও কোন সরকারই তা বাস্তবায়নে সফল হয়নি। ব্যপক সমালোচিত এবং জনগনের কাছে প্রত্যাখ্যাত এই টিফা পরিবর্তিত আকারে টিকফা (Trade and Investment Cooperation Framework Agreement) নামে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয় হিলারী ক্লিনটনের সাম্প্রতিক সফরে। সরাসরি না বললেও চুক্তিটি যে প্রায় ১০ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দিতে চাওয়া টিফা চুক্তিরই ছদ্ম নাম সেটা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এর কথা থেকে স্পষ্ট হয়: “তাড়াহুড়ো করে এ চুক্তি করা হচ্ছে না। দীর্ঘ প্রায় দশ বছর ধরে এর প্রক্রিয়া ও এ সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এর একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে”। গত ২৬-০৭-২০১১ তারিখে প্রথম আলো লিখেছে : “প্রায় ১০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ রূপরেখা চুক্তিটি (টিফা), শেষ পর্যন্ত তা করা হয়নি। এর বদলে টিইসিএফ করা হচ্ছে টিফার আদলেই। টিফা নামটি যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে থাকলেও নতুন নামের প্রস্তাবটি দিয়েছে বাংলাদেশই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।”

এই সকল বানিজ্যিক চুক্তির অন্যতম দিক হচ্ছে আন্তর্জাতিক আই পি অধিকার সমূহের বাস্তবায়ন।

টিফা চুক্তির প্রস্তাবনা ১৫ তে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার (Agreements on Trade-Related Aspects of Intellectual Property Rights – TRIPS) বিষয়ক চুক্তি বা অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি রক্ষার প্রচলিত নীতির কার্জকর প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। অথচ ২০০৫ এ ডব্লিও টি ও এর দেয়া ঘোষণা অনুসারে বাংলাদেশ সহ অন্যান্য এলডিসি (Least Developed Countries) দেশগুলো ২০১৩ সাল পর্যন্ত ট্রেডমার্ক, কপিরাইট, পেটেন্ট ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সম্পর্ক আইনের আওতার বাইরে থাকার সুযোগ পেয়েছে আর ফার্মাসিউটিক্যালসগুলো পেয়েছে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। এর সুযোগে বাংলাদেশে ঔষধ কোম্পানি গুলো বিশ্বের প্রায় ৭৫ টি দেশে ঔষধ রপ্তানির সুযোগ পেয়ে থাকে।

এ ব্যপারে সন্দেহ নেই যে এই চুক্তির অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে বাধ্য করবে ট্রিপস বাস্তবায়ন করতে। এর ফলে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস বা ঔষধ শিল্প, কম্পিউটার-সফওয়ারস সহ গোটা তথ্যপ্রযুক্তি খাত আমেরিকার কম্পানিগুলোর পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক ইত্যাদির লাইসেন্স খরচ বহন করতে করতে দেউলিয়া হয়ে যাবে। ২০০৮ সালে Business Software Alliance (BSA) এর করা এক সমীক্ষা অনুসারে গোটা এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সফ্টওয়ার ”পাইরেসির” হার সবচেয়ে বেশি- ৯২% আর ৯০% পাইরেসি নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে শ্রীলংকা। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত শ্রীলংকা-আমেরিকা ৭ম টিফা বৈঠকে আমেরিকার বাণিজ্য প্রতিনিধি মাইকেল ডিলানির নেতৃত্বাধীন বাণিজ্য প্রতিনিধি দল এ বিষয়ে শ্রীলংকার উপর তীব্র চাপ প্রয়োগ করে। বৈঠকে মাইকেল ডিলানি বলেনঃ “We’d like to see a strengthened focus on intellectual property protection and strengthened enforcement.” অর্থাৎ ” আমরা দেখতে চাই মেধাসত্ত্ব সংরক্ষণের উপর জোর দেয়া হচ্ছে এবং এ আইন বাস্তবায়ন জোরদার হচ্ছে।” সফটওয়্যার পাইরেসিতে ২য় স্থান অধিকারকারী শ্রীলংকার উপর যে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে তা থেকে সহজেই অনুমেয় ১ম স্থান অধিকারী বাংলাদেশের অবস্থা কি হবে।

উপসংহার

বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ধারনা মূলতঃ পুজিবাদি পরাশক্তিগুলোর সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখার একটি মাধ্যম। উন্নত প্রযুক্তি এবং উৎপাদন পদ্ধতির অধিকারী হবার পর তারা এই জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। এর মাধ্যমে তারা চায় যেন অবশিষ্ট বিশ্ব প্রযুক্তি ও উৎপাদনের জন্য তাদের উপর নির্ভরশীল থাকে এবং তাদের উৎপাদিত পন্যের বাজারে পরিনত হয়।

একটি পুর্নাংগ জীবন ব্যাবস্থা হিসেবে অন্য যেকোন বিষয়ের মত বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ব্যাপারেও ইসলামের একটি সুস্পষ্ট অবস্থান রয়েছে। মুসলমানদের অবশ্যই পুঁজিবাদি শোষনের হাতিয়ার এ সকল আইন বর্জন করা উচিত। ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থার অধীনে শিল্প-সাহিত্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল তাতে কোনরকম বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ আইনের প্রয়োজন পড়েনি। ইউরোপ যখন অন্ধকার যুগ পার করছিল তখন মুসলিমগন কর্ডোভা, আলেকজান্দ্রিয়া এবং বাগদাদের মত শহর গুলোতে বিশাল লাইব্রেরী গড়ে তুলেছিল। ভবিষ্যত খিলাফত রাষ্ট্র অবশ্যই আবারো এরকম জ্ঞানভান্ডার গড়ে তুলতে সক্ষম হবে এবং তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য একে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌছে দিবে – কোন রকম কপিরাইট বা পেটেন্ট এর বাধা ছাড়াই।

মোঃ জাফর সাদিক

Leave a Reply