সত্য গ্রহণে প্রধান বাধাসমূহ ও আত্মপর্যালোচনা

بسم الله الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله

সত্য জেনে তা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যেসব প্রধান বাধাসমূহ কাজ করে তার একটি ক্ষুদ্র পর্যালোচনায় এই প্রয়াস।

পূর্ববর্তীদের অন্ধ অনুসরন: অধিকাংশ মানুষেরই সত্য গ্রহণে অন্যতম প্রধান বাধা হচ্ছে তাদের পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরন। রাসূল (صلى الله عليه وسلم) এর সত্যের আহবানে মক্কার মুশরিকদের তা গ্রহণে অন্যতম অন্তরায় ছিলো তাদের পূর্ববর্তীদের সুন্নাতে জাহিলিয়াহ্’র অন্ধ অনুসরন। বর্তমান প্রেক্ষাপট ও এর ব্যত্যয় নয়।

কুরআন কারীমে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:

وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ قَالُواْ بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لاَ يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلاَ يَهْتَدُونَ

“আর যখন তাদেরকে কেউ বলে যে, সেই হুকুমেরই আনুগত্য কর যা আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেছেন, তখন তারা বলে কখনো না, আমরা তো সে বিষয়ের অনুসরণ করব। যাতে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে দেখেছি। যদি ও তাদের বাপ দাদারা কিছু জানতো না, জানতো না সরল পথও।”

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ قَالُواْ حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ شَيْئًا وَلاَ يَهْتَدُونَ

“যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ্’র নাযিলকৃত বিধান এবং রসূলের দিকে এস, তখন তারা বলে, আমাদের জন্য তাই যথেষ্ট, যার উপর আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে পেয়েছি। যদি তাদের বাপ-দাদারা কোন জ্ঞান না রাখে এবং হেদায়েত প্রাপ্ত না হয় তবুও কি তারা তাই করবে?”

এভাবে, করআনের বিভিন্ন সূরায় এই ধরনের মানুষের কথা বিধৃত হয়েছে।

বস্তুগত উন্নত সম্প্রদায়ের অনুকরণ: বস্তুগত উন্নত সম্প্রদায়ের অনুকরন সত্য গ্রহণে মানুষকে বাধা দেয়। বস্তুগতভাবে যেসব জাতিকে মানুষ উন্নত দেখে তাদের অনুকরনে লিপ্ত হয় এই ভেবে যে, তাদের অনুকরনে তারা ও উন্নতি সাধনে সফলতা লাভ করবে। কিন্তু, আমাদেরকে এটা মনে রাখতে হবে যে ইসলামের উন্নয়ন বস্তুগত নয় আত্মিক। রাসূল (صلى الله عليه وسلم) এবং খুলাফায়ে রাশিদা যে মসজিদ থেকে বিশ্বশাসণের প্রয়াস পেয়েছিলেন তার ছালা ছিলো খেজুর পাতার অথচ কর্ডোভার সুরম্য মসজিদ আমাদের দী্র্ঘশ্বাসকে প্রলম্বিত করে বৈকি! তাই, বস্তুগত উন্নয়নের এই ভ্রমও মরিচিকার ন্যায় ধোকায় ফেলছে মানুষকে।

কুরআন কারীমে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:

“وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الْغُرُورِ”

“আর পার্থিব জীবন ধোকা ছাড়া আর কোন সম্পদ নয়।“

বর্তমান, তৃতীয় বিশ্বে অধিকাংশ মানুষের বিভ্রান্তি এটাই।

প্রবৃত্তির অনুসরণ: প্রবৃত্তির অনুসরণ সত্য গ্রহণে অন্যতম প্রধান অন্তরায়। মানুষের বস্তুবাদী এবং ভোগবাদী চাহিদা প্রবৃত্তিজাত। মানুষ তার এই নিম্নগামী তাড়নার বশবর্তী হয়ে পড়লে তার স্বভাবজাত নৈতিকতা এবং বিবেকবোধ হারিয়ে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরুপণের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।তাই, বর্তমান বিশ্ব নৈতিকতার ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।

কুরআন কারীমে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:

أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَن يَهْدِيهِ مِن بَعْدِ اللَّهِ أَفَلا تَذَكَّرُونَ

“আপনি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছেন, যে তার প্রবৃত্তিকে (খেয়াল-খুশীকে) স্বীয় উপাস্য স্হির করেছে? আল্লাহ্ জেনে শুনে তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তার কান ও অন্তরে মহর এটে দিয়েছেন এবং তার চোখের উপর রেখেছন পর্দা। অতএব, আল্লাহ্’র পর কে তাকে পথ প্রদর্শন করবে? তোমরা কি চিন্তাভাবনা কর না?”

এছাড়াও, মানুষ আত্মপক্ষ সমর্থন, অজ্ঞতা, অহংবোধ, পারিপার্শ্বিকতার কারণে সৃষ্ট স্নায়ু-অবসাদগ্রস্হতা; সর্বোপরি সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে উদাসীনতার এবং উন্নাসিকতার কারণে সত্য গ্রহণে ব্যর্থ হয়।

বর্তমান সময়ের নাস্তিকতা, নারীবাদী, বস্তুবাদ, ভোগবাদ, পূজিবাদ প্রভৃতি এসব কারণের ফলমাত্র।
বর্তমান সময়ের অস্হিরতায় পূজিবাদী সমাজব্যবস্থায় তরুণ কিংবা বার্ধক্যে উপনীত মানুষ নিজের অস্তিত্ব নিয়ে যে উন্নাসিকতায় মেতেছে তার প্রলেপ হচ্ছে ভোগে মত্ত থাকার প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটানো।
এটা মরুভূমির উটের সে রোগের মত যাতে সে অতিরিক্ত পিপাসার্ত হয়ে মাত্রাতিরিক্ত পানি পান করে মারা যায়।

তাই, বর্তমান সময়ের যে কোন তরুণের জীবন দৈনন্দিনকতার ভিত্তিতে নিজেকে প্রবৃত্তির কাছে সমর্পনে কাটে; যেখানে তার জীবন বিভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ। এক বিভ্রান্তি ধাবিত করছে অন্যটির দিকে। আর, যারা এর সাথে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হচ্ছে তারা আত্মাহুতি কিংবা মাদকে সেবছে নিজেদেরকে।

তাই, বিশ্বমানবতার মুক্তি কেবল সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুধাবণ করে, সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে আত্মসমর্পনে। আল্লাহ্’র এই সৃষ্টি অনর্থক নয়। তবে, এটা অনুধাবণ করে কেবল বোধ-সম্প্ন লোকেরাই।

কুরআন কারীমে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:

. إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاخْتِلافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِّأُولِي الأَلْبَابِ
الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىَ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلاً سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ .

“নিশ্চয়ই আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে এবং দিবা-রাত্রির আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহ্’কে স্মরণ করে এবং চিন্তা ও গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষযে, (তারা বলে) হে আমাদের প্রতিপালক! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদেরকে তুমি দোযখের (আগুনের) শাস্তি থেকে বাচাও।“

আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের বোঝার তাওফীক দিন।

امين .
سبحانك اللهم و بحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك و أتوب إليك

সায়্যিদ মাহমুদ গজনবী

____________________________
[১] সূরা বাকারাহ্: ১৭০
[২] সূরা মায়িদাহ্: ১০৪
[৩] সূরা আল-ই-ইমরান: ১৮৫
[৪] সূরা জাছিয়াহ্: ২৩
[৫] সূরা আল-ই-ইমরান: ১৯০-১৯১

Leave a Reply