বর্তমান বিশ্বে তিন ধরনের মতাদর্শ বিদ্যমান আছে।
১- ইসলাম।
২- গনতান্ত্রিক পুঁজিবাদ।
৩- সমাজতন্ত্র।
গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ (الديمقراطية الرأسمالية)
এটি পশ্চিমা বিশ্ব এবং মার্কিনীদের মতবাদ। এই মতবাদ ধর্মকে রাষ্ট্র এবং জীবন থেকে আলাদা রাখার মূল নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।
“Render unto Caeser what is Caesar’s and unto God what is God’s”
বলা হচ্ছে “যা কিছু সিজারের (রাজার) তা তার মত কর, আর যা কিছু খোদার তা তার (খোদার) ইচ্ছার উপর ছেড়ে দাও।” এ কারনে এই মতবাদে মানুষের জীবন ব্যবস্থার প্রবর্তক মানুষ নিজেই। এটি কুফুরী দৃষ্টি ভঙ্গি এবং ইসলামের সম্পূর্ন বিপরীত মতবাদ। কারণ বিধান প্রবর্তক এক মাত্র আল্লাহ তা’আলা এবং তিনি সম্পূর্ন এককভাবেই মানুষের জীবনব্যবস্থা প্রনয়নকারী। তিনি রাষ্ট্রকে ইসলামী বিধি-বিধানের অংশে পরিনত করেছেন এবং জীবনের প্রতিটি বিষয়কে শরীআতের নীতি মোতাবেক যাপন করা বাধ্যতামূলক করেছেন। গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদকে জীবন ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহন করা কিংবা এর চিন্তা-ভাবনাকে অবলম্বন করা মুসলমানদের জন্য হারাম। কারণ এর আদর্শ ও আইন-কানুন সবই কুফুরী এবং ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।
অধিকার বা স্বাধীনতা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
পুঁজিবাদী জীবনাদর্শে যে বিষয়গুলোর উপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়, তার অন্যতম হচ্ছে ব্যক্তির বিভিন্ন প্রকার স্বাধীনতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি। এই স্বাধীনতাগুলো হল বিশ্বাসের স্বাধীনতা, মতামতের স্বাধীনতা, মালিকানার স্বাধীনতা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা। স্বার্থসর্বস্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতির গোড়াপত্তনই হয়েছে মলিকানার স্বাধীনতার ফল স্বরূপ। এর ফলশ্রুতিতেই পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন জাতিকে উপনিবেশে পরিনত করে তাদের ধন-সম্পদ লুট করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে একচেটিয়াত্বের সুযোগ তৈরী করে নিচ্ছে।
উপরোক্ত চার প্রকার স্বাধীনতাই ইসলামী আকীদার সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ কোন মুসলমান আকীদা ও বিশ্বাসগতভাবে স্বাধীন নয়। তাই কেউ যদি মুরতাদ হয়ে যায় অর্থাৎ ইসলাম ত্যাগ করে, তাহলে ইসলামের বিধান হচ্ছে তাকে বন্দি করে রাখা এবং সে যদি তওবা না করে, তাহলে তাকে হত্যা করা। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইরশাদ করেন, “যে তার দ্বীন পরিবর্তন করে, তাকে হত্যা কর।”
এমনিভাবে মত প্রকাশের ব্যাপারেও মুসলমানরা স্বাধীন নয়। বরং ইসলামের মতই একজন মুসলমানের মত। ইসলাম পরিপন্থী কোন মত পোষণ করা মুসলমানের জন্য জায়েয নয়।
কোন মুসলমান মালিকানার ব্যাপারেও স্বাধীন নয়। সে শুধু শরঈ ভিত্তিতেই কোন কিছুর মালিক হতে পারে। নিজের ইচ্ছা মতো কোন কিছুর মালিকানা দাবী করতে পারেনা।
শরীয়ত মালিকানা লাভের যে সব উপায় নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা ব্যতীত অন্য কোন মাধ্যমে সে কোন বস্তুর মালিক হতে পারেনা। শরীয়তের নিষিদ্ধ পথে মালিকানা অর্জন করা কখনও মুসলমানের জন্য বৈধ নয়। তাই একজন মুসলমানের জন্য সুদ, একচেটিয়াত্ব, মজুতদারী অথবা মদ, শুকর বিক্রি করে বা অন্য কোন নিষিদ্ধ উপায়ে মালিকানা লাভ করা নিষিদ্ধ।
ইসলামে ব্যক্তি স্বাধীনতারও কোন অস্তিত্ব নেই। কোন মুসলমান ব্যক্তিজীবনে স্বাধীন নয়। বরং প্রত্যেকেই শরীয়তের অধীন। সুতরাং কেউ যদি নামায পড়া ছেড়ে দেয় কিংবা রোযা না রাখে অথবা নেশা করতে শুরু করে কিংবা ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়,তাহলে তাকে শাস্তি দিতে হবে। এমনি ভাবে মহিলারা যদি বেপর্দায় বাইরে চলা ফেরা করে,তাহলে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে। অতএব, পশ্চিমা পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে সব স্বাধীনতার কথা বলা হয় ইসলামে এমন স্বাধীনতার কোন অবকাশ নেই। এই লাগামহীন স্বাধীনতার চিন্তা সম্পূর্ন ভাবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।
পুঁজিবাদী মতাদর্শের অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হচ্ছে গণতন্ত্র
গণতন্ত্র সম্পর্কে ইসলামের মতামত
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হচ্ছে “জনগণের কর্তৃত্বাধীন, জনগণের জন্য, জনগণ দ্বারা পরিচালিত শাসন ব্যবস্থা।” গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বুনিয়াদি কথা হচ্ছে- সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে মানুষই সকল ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বের অধিকারী। সকল বিধি-বিধিান কার্যকর করার ক্ষমতাও মানুষের। মানুষ নিজেই নিজের ইচ্ছা মত বিধি-বিধিান প্রনয়ন করবে। সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে তাদের উপর কর্তৃত্ব করার আর কেউ নেই। তারা যে ভাবে ইচ্ছা সে ভাবে আইন প্রনয়ন ও প্রয়োগ করার অধিকারী। যদি কোন আইন রহিত করার ইচ্ছা হয়, তাও মানুষ করতে পারে। এ কাজে যদি মানুষ সরাসরি নিজে অংশ নিতে না পারে, তাহলে তারা এমন প্রতিনিধি নির্বাচন করবে, যে তাদের পক্ষ থেকে আইন প্রনয়ণ করার অধিকার রাখবে। যেহেতু দেশের সকল জনগণের পক্ষে একযোগে সরকার পরিচালনা করা বড়ই দুরূহ ব্যাপার, তাই মানুষ নিজেদের প্রণীত আইনগুলো কার্যকর করার জন্য (অর্থাৎ শাসনকার্য পরিচালনার জন্য) জন প্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকে। মোট কথা পশ্চিমা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে জনগণই ক্ষমতার মূল উৎস। জনগণই শাসক এবং জনগণই আইন প্রবর্তক।
গণতন্ত্র নামী এ ব্যবস্থাটি কুফুরী। কারন এটি মানুষের নিজের বানানো ব্যবস্থা, ইসলামী শরীআতী ব্যবস্থা নয়। সুতরাং এই ব্যবস্থা দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করার অর্থ হচ্ছে কুফুর দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করা। তাই এই ব্যবস্থার প্রতি মানুষকে আহ্বান করার অর্থ কুফুরী ব্যবস্থার প্রতি মানুষকে আহ্বান করা। অতএব কোন অবস্থাতেই গণতন্ত্রের প্রতি আহ্বান করা বা তা অবলম্বন করা জায়েয নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ইসলামী শরীয়তের বিপরীত।
কেননা মুসলমান মাত্রই সকল কাজের ক্ষেত্রে আল্লাহ্র আহ্কাম মেনে চলতে বাধ্য। মুসলমান আল্লাহ্র গোলাম। সে শুধুমাত্র আল্লাহ্র আদেশ ও নিষেধানুযায়ী সকল কাজ সম্পাদন করবে।
মুসলিম উম্মাহ্’র জন্য এই বৈধতা নেই যে, তারা নিজেদের খেয়াল খুশীমত আচরণ করবে। কারণ তাদের এই সার্বভৌমত্ব নেই। সকল সার্বভৌমত্ব শরীআতের তথা আল্লাহ্র। তাই উম্মাহ্র আইন প্রবর্তন করার কোন অধিকার নেই। আইন প্রণেতা হলেন একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা। সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্ একত্রিত হয়েও যদি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে হারাম করা কোন কিছুকে হালাল করতে চায়, তবু তারা তা করার অধিকার রাখেনা।
যেমন সুদ, মজুতদারী, ব্যাভিচার, মদপান ইত্যাদি হারামগুলোর কোন একটিকে হালাল করার জন্য যদি সমগ্র উম্মাহ মিলেও আইন প্রনয়ণ করে, তবু তাকে হালাল বলা যাবে না।
কোন মুসলমান যদি অব্যাহত ভাবে এ ধরনের কোন কিছু করার চেষ্টা করে, তাহলে প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। তবে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বান্দাকে শাসনের দায়িত্ব তথা তাঁর বিধান কার্যকর করা ও তা সমাজে প্রচলন ঘটানোর অধিকার অর্পন করেছেন। উম্মাহ্’র অধিকার রয়েছে নিজের শাসক (খলীফা) নির্বাচন বা নিয়োগ করার। এটা এ জন্য করা হয় যেন শাসক আল্লাহ্র হুকুম কার্যকর করার ব্যাপারে উম্মাহ’র প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। শাসক নিযুক্ত করার পদ্ধতিও (বাই’আত) আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। এই পদ্ধতি দ্বারাই সার্বভৌমত্ব, অধিকার ও কর্তৃত্বের পার্থক্য নির্ণয় হয়ে যায়। উম্মাহ্র অধিকার হচ্ছে শাসক নির্বাচন করা। কর্তৃত্বের দায়িত্ব হচ্ছে খলীফার আর শাসনের মালিকানা এবং সার্বভৌমত্ব হচ্ছে আল্লাহ্র।
সমাজতন্ত্র (الشيوعية)
সমাজতন্ত্র তথা কমিউনিজম হচ্ছে একটি বস্তুবাদী মতবাদ। যা বস্তু ছাড়া সব কিছুকেই অস্বীকার করে। এই মতবাদের দাবী হলো বস্তুই জগতের মূল উৎস; বস্তুর কোন আদি অন্ত নেই; এই বস্তু কোন স্রষ্টার সৃষ্টি নয় এবং সৃষ্টিকর্তা বলতে কিছুই নেই; এমনি ভাবে কেয়ামত দিবসেরও কোন বাস্তবতা নেই। এই মতবাদ ধর্মকে জনগণ ও জাতির জন্য আফিমের মত ক্ষতিকর মনে করে।
এই বস্তুবাদী মতাদর্শ বস্তু ও ইতিহাসের বিবর্তন তত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই তত্ত্বানুসারে বস্তু নিজেই সকল সৃষ্টির মূল উৎস। আর বস্তুর বিবর্তনের মাধ্যমেই জগতের সব কিছু উৎপত্তি লাভ করে। কমিউনিজমের তত্ত্ব অনুসারে সমাজব্যবস্থা উৎপাদনের হাতিয়ার থেকে উৎসারিত আর উৎপাদনের হাতিয়ারের উন্নয়নের সাথে সাথে সমাজ ব্যবস্থারও উন্নতি ঘটে। এ মতবাদে সমাজ বলা হয় একটা ব্যাপক সমষ্টিকে, যা ভুমি, উৎপাদনের হাতিয়ার, প্রকৃতি এবং মানুষের সমন্বয়ে গঠিত। এই সব একই জিনিষ এবং তা হচ্ছে বস্তু। যখন প্রকৃতি ও প্রকৃতির মধ্যস্থিত বস্তুর উন্নতি সাধিত হয়, তখন তার সাথে সাথে মানুষ এবং সমাজেরও উন্নতি সাধিত হয়।
একারনেই বস্তুবাদী মতাদর্শানুযায়ী সমাজ সদা বিবর্তনশীল। যদি সমাজের বিবর্তন ঘটে, তাহলে মানুষেরও বিবর্তন ঘটে। সমাজের সাথে সাথে মানুষও এমন ভাবে এগিয়ে যায় যেমনি ভাবে চাকার সাথে স্পোকগুলোও এগুতে বাধ্য হয়। কমিউনিজম উৎপাদন উপাদানের ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকার করেনা। এই মতবাদে সব কিছুর মালিকানা রাষ্ট্রের। কমিউনিজম একটি কুফুরী মতবাদ। এর চিন্তা কুফুরী, এর-ব্যবস্থা কুফুরী এবং সামগ্রিক ভাবেই তা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।
ইসলাম বলেছে ও দলিল দ্বারা প্রমান করেছে যে, বস্তু হচ্ছে সৃষ্টি। এটা আদৌ “আযালী” বা অনাদি-অনন্ত নয়। একে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তা এক সময় শেষ হয়ে যাবে। মানুষ, জগত-সমূহ এবং এতে যা কিছু আছে সবকিছু একমাত্র সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ্ তা’আলার মাখলূক বা সৃষ্টি। জীবন ব্যবস্থা আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই আসবে, বস্তুর উন্নতি কিংবা উৎপাদন উপাদান বা কোন মানুষের পক্ষ থেকে নয়। ইসলাম সমাজের যে ব্যাখ্যা দিয়েছে সে অনুযায়ী সমাজ হলো মানুষ, মানুষের চিন্তা, অনুভূতি এবং ব্যবস্থাদির সমষ্টি। সমাজের পরিচয় নির্ণীত হয় সেখানে প্রচলিত মতাদর্শের পরিচয় অনুযায়ী। যদি কোন সমাজে ইসলামী মতাদর্শের প্রচলন এবং কর্তৃত্ব থাকে, তাহলে সে সমাজকে বলা হবে ইসলামী সমাজ; এখন সেখানকার উৎপাদন ব্যবস্থায় যে ধরনের হাতিয়ারেরই প্রাধান্য থাকুকনা কেন। অনুরূপ ভাবে যে সমাজে পুঁজিবাদী গণতন্ত্র কার্যকর থাকে, তাকে বলা হয় পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক সমাজ। যে সমাজে কমিউনিজম কার্যকর থাকে, তাকে বলা হয় কমিউনিষ্ট সমাজ যদিও সে সমাজে প্রচলিত উৎপাদন যন্ত্রপাতি হুবহু সেগুলোই থাকে, যে গুলো হয়তো বিদ্যমান আছে কোন পুঁজিবাদী সমাজে।