সমাজ ও এর উপাদানসমূহ

সমাজ বলা হয় মানুষের এমন সমষ্টিকে যা একই চিন্তা, একই অনুভূতি-এবং একই ব্যবস্থার বন্ধনে আবদ্ধ। সমাজ হচ্ছে অনেক ব্যক্তির এমন সমন্বয়ের নাম, যেখানে বিভিন্ন প্রকার সম্পর্ক বিদ্যমান। শুধু কতিপয় মানুষ একত্রিত হওয়াকেই সমাজ বলেনা। কারন অনেক মানুষ কোথাও একত্রিত হলে তাকে একটি দল বা সমাবেশ বলা যেতে পারে, একে সমাজ বলা যায় না। যে সব উপাদান একটি সমাজকে সংগঠিত করে, সে গুলো হচ্ছে কতিপয় সম্পর্ক তথা রীতি নীতি। অন্য কথায় বলা যায় সমাজ হচ্ছে ব্যক্তি, চিন্তা, আবেগ-অনুভূতি এবং নিয়ম পদ্ধতিগুলোর সমষ্টির নাম।   তাই কোন সমাজকে পরিশুদ্ধ করতে হলে সে সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিদের চিন্তা, অনুভূতি এবং সেখানে প্রচলিত নিয়ম-নীতি, শাসনব্যবস্থা ইত্যাদির শুদ্ধতা সাধনের মাধ্যমেই কেবল তা করা সম্ভব। বিভিন্ন সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস, আবেগ-অনুভূতি, সমস্যা সমাধানের নিয়ম-পদ্ধতিগুলো ভিন্ন ভিন্ন। ঠিক এ কারণেই সমাজও হয় ভিন্ন ভিন্ন। যেমন ইসলামী সমাজ, সমাজতান্ত্রিক সমাজ, পুঁজিবাদী সমাজ ইত্যাদি।

পশ্চিমা সভ্যতা জীবনের সব বিষয়কে হালকাভাবে দেখে তাই সমাজ সম্পর্কে পশ্চিমা পূঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও অগভীর হওয়াই স্বাভাবিক। তারা সমাজকে শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তিমানুষের সমষ্টি বলেই মনে করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় মার্গারেট থ্যাচার একবার এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতায় বলেছিলেন, “সমাজ হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে কিছু ব্যক্তি ও পরিবারের সমষ্টি মাত্র।”

মুসলিম উম্মাহ্‌র অধঃপতনের এই দীর্ঘ সময়কালে অনেক সৎ সংস্কারক ও অনেক সাহসী আন্দোলনের আবির্ভাব ঘটেছে। তারা আন্তরিকভাবেই উম্মাহ্‌র এই খারাপ অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন বা করছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের মধ্যে অনেকেই সমাজ সম্পর্কে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা অনেকাংশেই প্রভাবিত হয়েছেন- অর্থাৎ তারাও মনে করেছেন সমাজ হলো আসলে অনেকগুলো ব্যক্তি। তাই তাঁরা চেষ্টা করেছেন ব্যক্তিকে ভাল মুসলমানে পরিণত করতে; তাকে ভাল আদব কায়দা, ধর্মীয় রীতি নীতি শেখাতে এবং চিন্তা করেছেন যে অনেকগুলো ব্যক্তি যখন ভাল হয়ে যাবে তখন সমাজ ঠিক হয়ে যাবে। যদিও তাদের আন্তরিক চেষ্টার ফলে অনেক মানুষ সে সব আন্দোলন ও কর্মসূচীতে অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো সমাজের বাস্তব অবস্থা অর্থাৎ সমাজে বিদ্যমান অপরাধ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা, বিশৃংখলা, নৈরাজ্য ইত্যাদির তো কোনও পরিবর্তনই হয়নি বরং এগুলো দিন দিন বেড়েই চলেছে।

সমাজ সর্ম্পকে গভীরতর বিশ্লেষণ: 

আমরা যদি সমাজের সামগ্রিক ও গভীরতর বিশ্লেষণ পেতে চাই তাহলে বাস্তবে মানুষ বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে শুরু করতে হবে। আমরা মানুষের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখব যে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কিছু জৈবিক চাহিদা ও প্রবৃত্তি আছে। যেমন, তাকে খাদ্য গ্রহণ ও পানীয় পান করতে হয় (জৈবিক চাহিদা); তার মধ্যে অধিকতর সম্পদ ও অর্থ উপার্জন করার ও তা দিয়ে জীবনমান উন্নত করার আকাংখা আছে; তার স্বভাবগত প্রবণতা হচ্ছে বৈরী পরিবেশে নিজেকে রক্ষা করা এবং বেঁচে থাকা (টিকে থাকার প্রবৃত্তি)। এছাড়াও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তার স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে এবং সে সংসার করতে চায় (জনন প্রবৃত্তি)। নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ, মুসলমান- অমুসলমান সবার জন্যই এগুলো অনস্বীকার্য বাস্তবতা।

জৈবিক চাহিদা ও প্রবৃত্তিগুলো পূরণের প্রয়োজন ও তাড়নাই মানুষকে পারস্পরিক সম্পর্ক ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসে। মানুষ একা বিচ্ছিন্নভাবে এসব চাহিদা ও প্রবৃত্তি পূরণ করতে পারে না। তাই মানুষ একটা সমাজের মধ্যে থাকে যাতে করে তারা পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সমঝোতার ভিত্তিতে এসব চাহিদা পূরণ করতে পারে।

মানুষ যখন পরস্পরের সাথে ক্রিয়া করে বা সম্পর্ক স্থাপন করে তখন বাকী প্রাণীজগতের তুলনায় সে মৌলিকভাবে ভিন্ন। মানুষের চিন্তা করার এক অনন্য ক্ষমতা আছে যার সাহায্যে সে বিভিন্ন ধারণায় (concept) উপনীত হতে পারে যেগুলো তার জৈবিক চাহিদা ও প্রবৃত্তিগুলো পূরণের উপায় বা পদ্ধতি ঠিক করে দেয়। অর্থাৎ এই ধারণা বা বিশ্বাসগুলো তার চাহিদা ও প্রবৃত্তিগুলোকে কিছু শৃংখলা ও নিয়মের অধীনে নিয়ে আসে।

তাই মানুষ যখন কোথাও দলবদ্ধ হয়ে সমাজ প্রতিষ্ঠা করে তখন তার ভিত্তি হিসাবে কাজ করে এমন কিছু ধারণা, বিশ্বাস ও আবেগ-অনুভূতি যা তাদের সবার মধ্যে বিদ্যমান। সেই সাথে তারা কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তাদের চাহিদা ও প্রবৃত্তিগুলো পূরণের পারস্পরিক সমঝোতায় উপনীত হয় যা তাদের বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অথবা বিশ্বাস থেকে উৎসারিত। তারপর তারা একটি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে যা বাস্তবে এসব নিয়ম-পদ্ধতি প্রয়োগ ও রক্ষা করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এই কর্তৃপক্ষটিই রাষ্ট্র বা সরকার।

অতএব সমাজ নিম্নোক্ত উপাদানগুলোর সমন্বয়ে গঠিত:

১. ব্যক্তি
২. ব্যক্তিবর্গের (জনসাধারণের) মধ্যে প্রচলিত বা লালিত সাধারণ (common) ধ্যানধারনা বা বিশ্বাস
৩. জনগণের সাধারণ (common) বিশ্বাস প্রসূত আবেগ-অনুভূতি
৪. তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের নিয়ম পদ্ধতি এবং তা বাস্তবায়ন ও রক্ষা করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ (রাষ্ট্র/সরকার/সামাজিক নেতৃত্ব ইত্যাদি)।

সমাজে ব্যক্তিদের মধ্যে প্রচলিত সাধারণ (common) বিশ্বাসগুলোই সামাজিক চিন্তা ও অনুভূতি হিসেবে প্রকাশ পায়, যা জীবনের প্রতিক্ষেত্রে ব্যক্তির আচরণ এবং বিভিনড়ব মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ককে কতগুলো নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসে। এই চিন্তা ও বিশ্বাসগুলো তাদের কাজের মানদন্ড ঠিক করে এবং সমাজ ব্যবস্থার সাথে তাদের সম্পর্ককেও বিন্যস্ত করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আমরা কিভাবে অস্তিত্বে এলাম? আমাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কি? আমাদের মৃত্যুর পরে কি ঘটবে? ইত্যাদি মৌলিক প্রশ্নের জবাবে যখন বলা হয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ্‌র ইবাদত করা আর মৃত্যুর পর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে বিচার দিবস আর জান্নাত অথবা জাহান্নাম এবং জনগণ যখন চিন্তা-ভাবনা করে বুঝেশুনে এই বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করে তখন তা তাদের জীবনের কার্যাবলীর ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ধরনের সর্বজনগ্রাহ্য মানদন্ডের জন্ম দেয়। সে ক্ষেত্রে জনগণ মহান স্রষ্টা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুল (সা) এর আদেশ ও নিষেধকেই তাদের কাজের মাপকাঠি হিসেবে গ্রহন করে। কেননা রাসুল (সা) বলেছেন,


তোমাদের কেউই (সত্যিকারভাবে) বিশ্বাস করে না, যতক্ষণ না আমি যা নিয়ে এসেছি সে অনুসারে তার প্রবণতা তৈরী হয়“। এবং আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন,


“(আমরা) আল্লাহ্‌র কাছ থেকে আমাদের রং নিই, রঞ্জিত করার ক্ষেত্রে কে আল্লাহ্‌’র চাইতে বেশী উত্তম? আমরা তাঁরই ইবাদতকারী।” [সূরা বাকারা:১৩৮]

সমাজের কোন বড় কিংবা প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী যে সাধারণ (common) চিন্তা ভাবনাগুলো ধারণ করে, ব্যাপকতর পরিসরে সেগুলো দ্বারাই গোটা সমাজের সাধারণ অনুভূতিগুলো তৈরী হয়। একটি ইসলামিক সমাজের পছন্দ- অপছন্দ, এর লোকাচার ও অনুরাগ-অনুভূতি কুরআন ও সুন্নাহ’র রঙে রঞ্জিত হবে। এসব সাধারণ চিন্তা ও অনুভূতিগুলোই সাধারণত জনমত হিসেবে পরিচিত।

জনগণের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এই বন্ধন ও নিয়ন্ত্রক সমূহের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল সরকার, যাকে অবশ্যই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সরকার সরাসরি জনমতকে নতুনভাবে ছাঁচ দিতে পারে, রাষ্ট্রের ভিতরে জনগণের কার্যাবলী এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে ইসলামিক রাষ্ট্রের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করতে পারে। সরাসরি আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এবং অন্যান্যভাবে, যেমন বিশেষ কোন মতবাদের প্রচার ও মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে এ কাজগুলো হয়ে থাকে। সমাজে প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের (যেমন সরকারের) ভূমিকা কি হওয়া উচিত তা একটি বিখ্যাত হাদীসে বিবৃত হয়েছে,


যেখানে রাসূল (সা) বলেছেন,
“যারা আল্লাহ্‌র হুকুম মেনে চলে তাদের সাথে থেকে যারা সেগুলো (আল্লাহ্‌’র হুকুম)-কে নিজেদের প্রবৃত্তির খেয়ালে লঙ্ঘন করে, (এরা উভয়ই) যেন তাদের মত যারা একই জাহাজে আরোহণ করে। তাদের একাংশ জাহাজের উপরের অংশে তাদের জায়গা করে নিয়েছে এবং অন্যরা এর নীচের অংশে নিজেদের জায়গা করে নেয়। যখন নিচের লোকদের পিপাসা নিবৃত্ত করার প্রয়োজন হয় তখন তাদেরকে জাহাজের উপরের অংশের লোকদের অতিক্রম করে যেতে হয়। (তাই) তারা (নিচের অংশের লোকেরা) নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে নিল, ‘আমরা যদি জাহাজের নীচের দিকে একটা ফুটো করে নিই তাহলে জাহাজের উপরের অংশের লোকদের কোন সমস্যা করব না।’ এখন যদি উপরের অংশের অধিকারীরা নিচের ডেক-এর লোকদেরকে এ কাজ করতে দেয় তবে নিশ্চিতভাবেই তারা সবাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। অবশ্য তারা (উপরের অংশের লোক) যদি তাদের (নীচের লোকদের)কে এ কাজ থেকে বিরত রাখে, (তবে) তারা (উপরের অংশের লোক) রক্ষা পাবে এবং এভাবে (জাহাজের) সবাই রক্ষা পাবে। ” (বুখারী )


সুতরাং সমাজ ব্যবস্থার একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, সমাজকে এমন সব নির্দিষ্ট কার্যাবলী থেকে বিরত রাখা, যা ঘটলে তা হবে পুরো জাতির জন্য ক্ষতিকর। এ ধরণের কার্যাবলীর মধ্যে মদ্যপান, ব্যাভিচার, চুরি, ধর্মত্যাগ উল্লেখযোগ্য। এসব ক্ষেত্রে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া শুধুমাত্র ব্যক্তিকে পরিশুদ্ধ করার জন্যই যে প্রয়োজন তা নয় বরং গোটা জাতি ও সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্যও এ ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। হয়রত ওসমান ইবনে আফ্‌ফান (রাঃ) এর উক্তিতেও বলা হয়েছে, “যারা কুরআনের শিক্ষা দ্বারা বিরত হয় না, আল্লাহ্‌ তাদেরকে সুলতানের ক্ষমতা দিয়ে বিরত করেন”।

যেহেতু ব্যক্তি, জনগণের সাধারণ (common) চিন্তা-অনুভূতি-আবেগ, তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের নিয়ম পদ্ধতি এবং তা বাস্তবায়ন ও রক্ষা করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ ইত্যাদির সমন্বয়ে সমাজ গঠিত হয়, সেহেতু কোন সমাজের বেশীরভাগ লোক মুসলমান হলেও যে চিন্তাভাবনা তারা নিজেদের ভেতর লালন করে সেগুলো যদি পুঁজিবাদী তথা ভোগবাদী ও স্বেচ্ছাচারী হয়; যে অনুভূতি তারা বহন করে তা যদি হয় সংকীর্ণ দেশতান্ত্রিক বা বর্ণ/ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী অথবা যে রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা তাদের সম্পর্কগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে তা যদি হয় পুঁজিবাদী-তথা আল্লাহ্‌র বদলে মানুষের সার্বভৌমত্ব ভিত্তিক তবে সে সমাজকে ইসলামি সমাজ বলা যাবে না।  

Leave a Reply