(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি আদনান খান রচিত “Geopolitical Myths” বইটির বাংলা অনুবাদের একাংশ হতে গৃহীত)
বিশ্বব্যাপী পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, সম্পদের অপ্রতুলতা এবং গণতন্ত্রের অভাব দারিদ্র্যের সাধারণ কারণসমূহের মধ্যে প্রধান। সমাজবিজ্ঞানী ও অন্যান্য থিঙ্ক ট্যাঙ্কের মধ্যে যদিও এ ব্যাপারে কোন ঐক্যমত্য নেই। এ ব্যাপারে খুব প্রাধান্য বিস্তারকারী ধারণা হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতির সাথে পুঁজিবাদের বিকাশই হল এ সমস্যার একমাত্র সমাধান। কিন্তু খুব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, খাদ্যের অপ্রতুলতা নয়, বরং অন্যান্য কিছু বাস্তবতা শুধুমাত্র মুসলিম বিশ্ব নয় পুরো তৃতীয় বিশ্বে দরিদ্রতার জন্য দায়ী।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংক এবং এদের কাঠামোগত পরিবর্তন নীতি (Structural Adjustment Policy) মিশর, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশের বিবিধ অর্থনৈতিক সংকট তৈরির পেছনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে। দরিদ্রতা মুক্তির উপর তাদের নিজস্ব প্রেসক্রিপশন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কাছে বিক্রয় করে থাকে। এসব সংস্থা প্রদত্ত নীতিসমূহের মধ্যে রয়েছে শস্যের মজুদ না রাখা বা কমিয়ে আনা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত খাবারের উপর কর হ্রাস, সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের উপর থেকে ভর্তুকি উঠিয়ে নেয়া প্রভৃতি। অন্যান্য দরিদ্র দেশসমূহ থেকে আমদানির বদলে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে ক্রয়ের সুযোগ সৃষ্টি করে তারা। বাজার অর্থনীতি ও ব্যক্তিখাতের বিকাশের মাধ্যমে অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করা ও একে দারিদ্রতা বিমোচনের পথ হিসেবে দেখানো হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতার জন্য পাকিস্তানের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন দরকার। এসময় বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল পাকিস্তানকে এসব খাতে সরকারী বিনিয়োগ কমিয়ে বরং রপ্তানীর দিকে আগে মনোযোগী হতে পরামর্শ দিয়েছে। তারা এমন সব খাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় যেতে বলে যেগুলোতে পাকিস্তান অনগ্রসর। আর এভাবে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়ে।
দারিদ্র্যের অপর কারণগুলোর মধ্যে একটি হল ঋণ। আফ্রিকাকে ঔপনিবেশিক সময়ের ঋণ পরিশোধ করবার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। এ ধরণের দেনার কারণ হচ্ছে অসদুপায়ে উচ্চ সুদে ঔপনিবেশবাদী রাষ্ট্রসমূহের ঋণ গ্রহণ। আবার অনেক সময় দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরশাসকদের বিলাসিতায় অপচয়ের জন্য ধনী দেশসমূহ ঋণ দিয়েছে যা ‘ঘৃন্য ঋন’ হিসাবে পরিচিত। উদাহরণ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা ২৮ বিলিয়ন ডলারের (যা বর্তমানে ৪৬ বিলিয়ন) “বর্নবাদ জনিত ঋন” এ জর্জরিত। বর্নবাদ পরবর্তি আফ্রিকার উপর বর্নবাদ শাসনামলের ঋন চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ১৯৯৮ সালে এ.সি.টি.এস.এ (এ.সি.টি.এস.এ: অ্যাকশন ফর সাউদার্ন আফ্রিকা) হিসেব করে দেখেছে যে, বর্নবাদ বজায় রাখবার জন্য ১১ বিলিয়ন ডলার (যা বর্তমানে ১৮ বিলিয়ন ডলার) ধার করেছে। আর প্রতিবেশী দেশসমুহও এ জন্য ১৭ বিলিয়ন ডলার (যা বর্তমানে ২৮ বিলিয়ন) ঋণ গ্রহণ করেছে। শতকরা ৭৪ ভাগের উপরে আফ্রিকান ঋণে জর্জরিত থাকায় পুরো মহাদেশ জুড়ে অস্থিতিশীলতা ও সংঘাত বজায় আছে।
ঔপনিবেশিকতা তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রতার অন্যতম কারণ। উপনিবেশবাদ পশ্চিমাদের প্রতি নির্ভরশীলতাকে প্রলম্বিত করেছে। এ কারণে খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ অংশের উপর পশ্চিমা আধিপত্য ও হস্তক্ষেপ বজায় ছিল। ঔপনিবেশিক আমল থেকে আফ্রিকার শ্রম পশ্চিমাদের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে এবং সেদেশের জনগণকে পশ্চিমে উৎপাদিত পণ্য সাধ্যের অতীত মূল্যে ক্রয় করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
বর্তমান বৈশ্বিক কৃষি ব্যবস্থাপনা প্রাথমিক সময়ের মত কেবলমাত্র কৃষকের নিজস্ব প্রয়োজন মেটানোর জন্য পরিচালিত হয় না। ১৯৬০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাসমূহ এ ধরণের ব্যবস্থা এবং সরকারকে খাদ্য সরবরাহের উপর হস্তক্ষেপের সুযোগ থেকে বের হয়ে আসবার জন্য কৌশল প্রণয়ন করেছে। লাভের অঙ্কটাকে বাড়িয়ে নেবার জন্য দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক কোম্পানীগুলো এ সুযোগে এগিয়ে এসেছে। পণ্যদ্রব্যের মূল্যের ব্যাপক হ্রাসবৃদ্ধিতে সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ এখন আর নেই। সেকারণে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশের জনগণ কে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার কর্তৃক বেধে দেয়া মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে হয়। বিশ্ব মন্দা চলাকালীন সময়ে কিংবা তার আগে অনুমাননির্ভর আর্থিক ব্যবস্থাপনা খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে। শুরু থেকেই বিলাসজাত পণ্যদ্রব্য আমদানি ও রপ্তানি ছিল বৈশ্বিক ব্যবসা। কিন্তু ১৯৬০ সাল থেকে খাদ্য দ্রব্য উৎপাদন আঞ্চলিক পরিমন্ডল থেকে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে রূপান্তরিত হয়।
কেবলমাত্র নিজস্ব চাহিদা পূরণের জন্য যারা খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করে তাদের চেয়ে যারা রপ্তানীর জন্য উৎপাদন করে তাদেরকে বিশ্ব বাণিজ্যিক নীতিসমূহ উৎসাহিত করে। যদিও গ্রীষ্মকালে বৃটিশ কলম্বিয়া এবং ক্যালিফোর্ণিয়া উভয় অঞ্চলের কৃষকেরা টমেটো উৎপাদন করে, তারপরও তাদের জন্য লাভজনক হচ্ছে এগুলো নিজ এলাকায় বিক্রয়ের চেয়ে রপ্তানী করা। অথচ ক্রমবর্ধমান পরিবহন ব্যয় পণ্যসমূহের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ কারণে এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের কিছু কিছু অংশে প্রান্তিক চাষীদের দেখা যায় না বললেই চলে। মনোক্রপিং, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার মাধ্যমে কৃষির ব্যাপক শিল্পায়নের কারণে প্রান্তিক চাষীরা সফল হতে পারছে না। জেনেটিক রূপান্তরের জন্য গড়ে উঠা মনসান্তো, আরচার ড্যানিয়েলস,মিডল্যান্ড এবং কারগিল এর মত কোম্পানিসমূহ বিশাল অঙ্কের মুনাফা করছে।
উন্নত বিশ্ব দাবী করছে যে, অধিক জনসংখ্যার কারণে খাদ্যে অপ্রতুলতার দরুণ খাদ্য সংকট তীব্রতর হচ্ছে। খাদ্যের অপ্রতুলতার দোহাই দিয়ে খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমুল্যের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়। তবে এরকম উচ্চফলনশীল ও দক্ষ কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাপনা থাকা সত্ত্বেও কেন প্রায় এক বিলিয়ন লোক ক্ষুধার্ত থাকে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। সমস্যা আসলে আন্তর্জাতিক খাদ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যেই: বিশ্বব্যাপী কৃষিপণ্য বন্টন ব্যবস্থা এবং বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থাপনার একচেটিয়া কর্তৃত্বেও (মনোপলি) মধ্যে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দরিদ্র দেশসমূহে ধনী দেশ ও বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর অশুভ পদচারণার মাধ্যমে উপার্জনের ক্ষেত্রস্থল বানানোয় সেসব দেশের কৃষির উপর কুপ্রভাব পড়েছে। অসম বানিজ্য চুক্তি; প্রধান ফসলসমূহের উৎপাদনের উপর অতি খবরদারি; বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা প্রভৃতি সংস্থার নিয়ন্ত্রন ও আধিপত্য দরিদ্র দেশসমূহের কৃষির মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছে।
কাঠামোগত পরিবর্তনের (Structural Adjustment) মত নীতির মাধ্যমে বিশ্বসংস্থাসমূহ উন্নয়নশীল দেশসমূহকে দরিদ্র মানুষের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাখাতে বরাদ্দকৃত অর্থই শুধু নয়, বরং কৃষিখাতে বরাদ্দকৃত অর্থও সংকোচনে বাধ্য করে। দেশজ শিল্পের জন্য বিদেশী পণ্যের উপর বাণিজ্য বাধা দুরীকরণসহ অন্যান্য গৃহীত সুবিধার বিলোপসাধন ও বিদেশী কোম্পানীগুলোকে সহজে ব্যবসা করবার মত পরিবেশ তৈরির ব্যবস্থা করতেও বাধ্য করে (যদিও ধনী দেশসমূহ সে তুলনায় বিদেশী পণ্যের প্রবেশের পথ সুগম করে না)। এছাড়াও দরিদ্র দেশসমুহকে ঋণের ব্যয়ভার বহনের জন্য খাদ্যদ্রব্য রপ্তানির মাধ্যমে ডলার উপার্জনের দিকে উৎসাহিত করা হয়। সেকারণে একই ধরণের ফসল বছরের পর বছর উৎপাদনের জন্য ফসলের বৈচিত্র ব্যাহত হয় এবং ফলে ইকোসিস্টেমে ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে জমির উর্বরতা বিনষ্ট হয় ও রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরতা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
ক্রমবর্ধমান দরিদ্রতা ও অসমতা দরিদ্র দেশসমূহে দুর্নীতিকে বাড়িয়ে দিয়ে পরিস্থিতিকে আরও প্রতিকূল করছে। দরিদ্রদেশকে ধনীদেশের খাদ্য সহায়তা প্রদানের নামে অতিরিক্ত খাদ্য বিক্রি করা; উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের কৃষিতে ব্যাপক ভর্তুকি প্রদান, প্রভৃতি তৃতীয় বিশ্বের খাদ্য সংকট ও দরিদ্রতাকে ঘনীভূত করছে।
পশ্চিমাদের নীতির কারণেই তৃতীয় বিশ্ব দরিদ্র এবং খাদ্যশস্যের অপ্রতুলতা নয় বরং উন্নত বিশ্বের অপব্যয়ের কারণেই সৃষ্ট খাদ্যসংকটের ফলে তারা দরিদ্রই থাকবে:
– বিশ্বের জনসংখ্যার শতকরা ২০ ভাগ হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর মোট কৃষি উৎপাদনের ৮০ ভাগ পশ্চিমারা ভোগ করে
– মোট পণ্যদ্রব্যের শতকরা ৮৬ ভাগ ভোগ করে
– মোট দুধের ৭৫ ভাগ ভোগ করে
– মোট কাঠের ৭০ ভাগ ভোগ করে
– মোট পানির ৬২ ভাগ ভোগ করে
– মোট জ্বালানীর ৪৮ ভাগ ভোগ করে
– মোট মাছ এবং মাংসের ৪৫ ভাগ ভোগ করে
পৃথিবীতে মানুষের প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য রয়েছে; পশ্চিমারাই যার সিংহভাগ ভোগ করছে।